জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ আইন ২০২২-এর খসড়া প্রকাশ
সোহেল রহমান : দেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর লক্ষ্যে ‘জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ আইন, ২০২২’-এর খসড়া প্রণয়ন করেছে সরকার। মঙ্গলবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ এ-সংক্রান্ত আইনের খসড়ার প্রকাশ করেছে। অর্থ বিভাগের () এ লিঙ্কটি ব্যবহার করে আগামী ১২ এপ্রিল পর্যন্ত খসড়া আইনটির বিষয়ে মতামত দেয়া যাবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।
খসড়া আইন অনুযায়ী, এই আইন কার্যকরের পর সরকার যথাশীঘ্র সম্ভব আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, ‘জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ’ নামে একটি কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করবে। কর্তৃপক্ষ একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হবে এবং এর স্থায়ী ধারাবাহিকতা ও সাধারণ সীলমোহর থাকবে এবং এই আইন বা তদধীন প্রণীত বিধি বা প্রবিধান সাপেক্ষে, কর্তৃপক্ষের স্থাবর বা অস্থাবর উভয় প্রকার সম্পত্তি অর্জন করবার, অধিকারে রাখবার বা হস্তান্তর করবার ক্ষমতা থাকবে এবং কর্তৃপক্ষ নিজ নাম ব্যবহার করে মামলা দায়ের করতে পারিবে এবং কর্তৃপক্ষের বিরূদ্ধেও মামলা দায়ের করা যাবে।
কর্তৃপক্ষের প্রধান কার্যালয় হবে ঢাকায় এবং কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনবোধে, সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে, দেশের যে কোন স্থানে উহার শাখা কার্যালয় স্থাপন করতে পারবে।
আইনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে খসড়ায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫(ঘ) অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত আয়ত্তাতীত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে নাগরিকদের সরকারি সাহায্যলাভের অধিকার রয়েছে; এবং যেহেতু দেশের মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধিজনিত কারণে ক্রমবর্ধমানবয়স্ক জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় আনয়ন করা প্রয়োজন; এবং যেহেতু ভবিষ্যতে কর্মক্ষম জনসংখ্যার হ্রাসজনিত কারণে নির্ভরশীলতারহার বৃদ্ধি পাবে; এবং যেহেতু পেনশন তহবিলের ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ, পেনশন স্কিমে অংশগ্রহণকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং এতদ্সংক্রান্ত অন্যান্য কার্যাবলী সম্পাদনের নিমিত্ত জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠাসহ আনুষঙ্গিক বিষয়ে বিধান করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়; সেহেতু, এ আইন করা হল।’
খসড়ায় বলা হয়েছে, একজন নির্বাহী চেয়ারম্যান ও চারজন সদস্য সমন্বয়ে কর্তৃপক্ষ গঠিত হবে। নির্বাহী চেয়ারম্যান ও সদস্যরা সরকার কর্তৃক নিযুক্ত হবেন এবং তাদের চাকরির মেয়াদ ও শর্ত সরকার কর্তৃক এ আইনের অধীন প্রণীত বিধি দ্বারা নির্ধারিত হইবে। তবে বিধি প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত গেজেটে আদেশ জারীর মাধ্যমে সরকার নির্ধারণ করতে পারবে। কর্তৃপক্ষসহ সর্বজনীনপেনশন ব্যবস্থাপনার সহিত সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ব্যয় সরকার নির্বাহ করবে।
কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব ও কার্যাবলীর বিষয়ে খসড়ায় বলা হয়েছে, (ক) সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি চালু, ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন নিশ্চিতকরণ; (খ) সর্বজনীনপেনশন পদ্ধতির আওতায় উহারচাঁদাদাতাগণের স্বার্থ সংরক্ষণ; (গ) সর্বজনীন পেনশন স্কিম গ্রহণ, স্কিমে প্রবেশ যোগ্যতা, শর্তসমূহ নির্ধারণ, অনুমোদন, স্কিম পরিচালনা, তত্ত্বাবধান এবং পেনশন তহবিলের পুঞ্জিভূত জমার বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা; (ঘ) পেনশন স্কীমে চাঁদাদাতাদের জমাকৃত অর্থের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ; (ঙ) চাঁদাদাতাদের অভিযোগ নিষ্পত্তি ও প্রতিকার প্রদান নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সরকারের অনুমোদন ক্রমে প্রয়োজনীয় প্রবিধান প্রণয়ন; (চ) কর্তৃপক্ষ স্বয়ং অথবা অপর কোনো কার্যালয় বা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে কর্তৃত্ব প্রদানের মাধ্যমে সর্বজনীনপেনশন ব্যবস্থাপনা,
বাস্তবায়ন বা উহার বিষয়ে কোন গবেষণার নিমিত্ত তথ্য সংগ্রহ বা গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা; (ছ) জনসাধারণের মধ্যে সর্বজনীনপেনশনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য, অবসরকালীন নিরাপত্তা ও পেনশন সম্পর্কে সম্যক ধারণা প্রদান ও বহুল প্রচারের মাধ্যমে পেনশন স্কীমে অংশগ্রহণ উৎসাহিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ; (ঝ) সর্বজনীনপেনশন স্কীমের সাথে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মচারীগণের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় শিক্ষা ওপ্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ; (ঞ) সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে ফি বা অন্যান্য চার্জ নির্ধারণ; (ট) নির্ধারিত স্থানএবংসময়ে, হিসাব সংরক্ষণ বই ও অন্যান্য দালিলিক কাগজপত্র প্রকাশ; এবং (ঠ) সর্বজনীনপেনশন বা পেনশন তহবিল বা উহার সহিত সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়ে কোন অভিযোগ বা বিরোধ নিষ্পত্তির বা অনিয়ম সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা গ্রহণ।
এছাড়াও আইনের উদ্দেশ্য পূরণে কর্তৃপক্ষ সরকারের অনুমোদনক্রমে নিজ নামে ঋণ গ্রহণ করতে পারবে। সর্বজনীন পেনশন স্কিম বা এই স্কিমের আওতাধীন কোন কার্যক্রম, স্কিম বা প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা কর্মচারী এই আইনের কোনো ধারা বা এর অধীনে প্রণীত কোনো বিধি বা প্রবিধানের কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে আদালতের মাধ্যমে ওই ব্যক্তি বা কর্মচারীর এক বা একাধিক ব্যাংক হিসাব ক্রোক করতে পারবে।
খসড়ায় বলা হয়েছে, কর্তৃপক্ষের অধীনে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি পেনশন ‘গভর্নিং বোর্ড’ থাকবে। এর চেয়ারম্যান হবেন অর্থমন্ত্রী এবং সদস্য সচিব হবেন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান। গভর্নিং বোর্ড বৎসরে ন্যূনতম চারটি সভা করবে। আইনের উদ্দেশ্য পূরণে গভর্নিং বোর্ড এ আইনের অধীন প্রবিধান প্রণয়নসহ কর্তৃপক্ষের যে কোনো নীতি বা কৌশল অথবা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক উত্থাপিত কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ প্রদান করবে এবং পেনশন তহবিলের অর্থ সরকারি সিকিউরিটি, কম ঝুঁকিপূর্ণ অন্যান্য সিকিউরিটিজ, লাভজনক অবকাঠামো ইত্যাদি খাতে বিনিয়োগের জন্য নির্ধারিত গাইডলাইন অনুমোদন এবং সময়ে সময়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ বা দিক-নির্দেশনা প্রদান করবে।
খসড়ায় বলা হয়েছে, আইনের অধীনে ‘জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ তহবিল’ নামে কর্তৃপক্ষের একটি তহবিল থাকবে এবং এ তহবিলের উৎস হবেÑ (ক) সরকার কর্তৃক প্রদত্ত অনুদান; (খ) আইনের অধীন আদায়যোগ্য ফি ও চার্জ; (গ) কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত সেবা বাবদ প্রাপ্ত অর্থ; (ঘ) সরকারের পূর্ব-অনুমোদনক্রমে গৃহীত ঋণ এবং (ঙ) অন্য কোন উৎস থেকে প্রাপ্ত অর্থ।
তহবিলের অর্থ কর্তৃপক্ষের নামে কোন তফসিলি ব্যাংকে জমা রাখা হবে এবং কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত পদ্ধতিতে এ তহবিল থেকে অর্থ উঠানো যাবে। এ তহবিলের অর্থ থেকে কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান, সদস্য এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, পারিশ্রমিক, সম্মানী ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য ব্যয় নির্বাহ করা হবে।
এছাড়া একটি ‘সর্বজনীন পেনশন তহবিল’ গঠনের কথা উল্লেখ করে খসড়ায় বলা হয়েছে, পেনশন বাবদ জমাকৃত অর্থ সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে ‘সর্বজনীন পেনশন তহবিল’ গঠন করা হবে। সর্বজনীন পেনশন তহবিলে চাঁদাদাতার চাঁদা জমা, জমার হিসাব সংরক্ষণ, পুঞ্জিভূত অর্থের সুষ্ঠু ও নিরাপদ বিনিয়োগ এবং পেনশন প্রদানসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কার্যক্রম সম্পাদন করা হবে। এ তহবিলে অর্থের উৎস হবেÑ (অ) পেনশন ব্যবস্থায় নিবন্ধিত চাঁদাদাতার চাঁদা; (আ) প্রতিষ্ঠানসমূহের অংশগ্রহণমূলক চাঁদা; (ই) বিনিয়োগকৃত অর্থের পুঞ্জিভূত মুনাফা; (ঈ) নি¤œ আয়ের বা দুঃস্থ চাঁদাদাতাদের জন্য সরকার কর্তৃক প্রদত্ত অনুদান; এবং (উ) অন্যান্য সূত্র থেকে আয় ইত্যাদি।
খসড়ায় বলা হয়েছে, (ক) সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনায় অন্তর্ভুক্তির পর একজন চাঁদাদাতা ধারাবাহিকভাবে কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা প্রদান সাপেক্ষে মাসিক পেনশন পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবে এবং চাঁদাদাতার বয়স ৬০ বছর পূর্তিতে পেনশন তহবিলে পুঞ্জিভূত মুনাফাসহ জমার বিপরীতে পেনশন প্রদান করা হবে; (খ) প্রতিটি চাঁদাদাতার জন্য একটি পৃথক ও স্বতন্ত্র পেনশন হিসাব থাকবে, যা এ আইনের অধীনে প্রণীত বিধি দ্বারা পরিচালিত হবে; (গ) চাকরিরত চাঁদাদাতারা চাকরি পরিবর্তন করলেও পূর্ববর্তী হিসাব নতুন কর্মস্থলের বিপরীতে স্থানান্তরিত হইবে, নতুনভাবে হিসাব খোলার প্রয়োজন হবে না; (ঘ) কর্তৃপক্ষ কর্তৃক মাসিক সর্বনি¤œ চাঁদার হার নির্ধারিত হবে। মাসিক ও ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে চাঁদা প্রদান করা যাবে এবং অগ্রীম ও কিস্তিতে জমা প্রদানের সুযোগ থাকবে; (ঙ) মাসিক চাঁদা প্রদানে বিলম্ব হলে বিলম্ব ফিসহ বকেয়া চাঁদা প্রদানের মাধ্যমে পেনশন হিসাব সচল রাখা যাবে এবং ওই বিলম্ব ফি চাঁদাদাতার নিজ হিসাবে জমা হবে; (চ) পেনশনাররা আজীবন অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত পেনশন সুবিধা ভোগ করবেন; (ছ) পেনশনে থাকাকালীন ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বে মৃত্যুবরণ করলে পেনশনারের নমিনি অবশিষ্ট সময়কালের (মূল পেনশনারের বয়স ৭৫ বছর পর্যন্ত) জন্য মাসিক পেনশন প্রাপ্য হবেন; (জ) কমপক্ষে ১০ বৎসর চাঁদা প্রদান করার পূর্বে চাঁদাদাতা মৃত্যুবরণ করলে জমাকৃত অর্থ মুনাফাসহ নমিনি-কে ফেরত দেয়া হইবে; (ঝ) পেনশন তহবিলে জমাকৃত অর্থ কোন পর্যায়ে এককালীন উত্তোলনের সুযোগ থাকবে না।তবে চাঁদাদাতার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জমাকৃত অর্থের সর্ব্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ হিসাবে উত্তোলন করা যাবে যা ধার্যকৃত ফি সহ পরিশোধকরিতেহইবে। ফি সহ পরিশোধিত অর্থচাঁদাদাতার নিজ হিসাবেই জমা হইবে; (ঞ) পেনশনের জন্য নির্ধারিত চাঁদা বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করিয়া কর রেয়াতের জন্য বিবেচিত হইবে এবং মাসিক পেনশন বাবদ প্রাপ্ত অর্থ আয়কর মুক্ত থাকিবে; (ট) সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতিতে সরকারি বা আধা-সরকারি বা স্বায়ত্বশাসিত বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করতে পারবে। এক্ষেত্রে কর্মী ও প্রতিষ্ঠানের চাঁদার অংশ জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত হবে; এবং (ঠ) সরকার কর্তৃক সময় সময় প্রজ্ঞাপন জারী হওয়া সাপেক্ষে, নি¤œ আয়সীমার নিচের নাগরিকদের অথবা দুঃস্থ চাঁদাদাতার ক্ষেত্রে পেনশন তহবিলে মাসিক চাঁদার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে প্রদান করতে পারবে।