কর অব্যাহতির লাগাম টেনে ধরতে চায় এনবিআর
অর্থনীতি ডেস্ক : বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছে চিঠি লিখে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেছেন, উন্নয়ন প্রকল্পে ‘সরাসরি’ কর অব্যাহতি দেয়া যাবে না। এর পরিবর্তে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম আমদানির মাধ্যমে শুল্ক-কর পরিশোধ করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। যে পরিমাণ শুল্ক-কর পরিশোধ করা হবে, পরে তা ফেরত বা রিফান্ড দেয়া হবে।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নে শুল্ক-কর ছাড়সহ নানা রকম সুবিধা দিচ্ছে সরকার। উদ্দেশ্য: প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করা। মূলত জনকল্যাণে রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে এ সুবিধা দেয়া হয়েছে। মেগাপ্রকল্পের বাইরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার অধীনে বাস্তবায়নাধীন বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পও কর অব্যাহতির সুবিধা ভোগ করছে। পাশাপাশি বেসরকারি খাতেও নানাভাবে ব্যাপক কর ছাড় দেয়া হয়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) মনে করে, প্রকল্পসহ বিভিন্ন খাতে কর অব্যাহতি দেয়া এক ধরনের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে, যা রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর পথে বাধা হিসেবে কাজ করছে। দেশে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির তুলনায় কর অনুপাত অত্যন্ত কম। এমন বাস্তবতায় উন্নয়ন প্রকল্পে কর অব্যাহতির লাগাম টেনে ধরতে চায় এনবিআর। এ জন্য প্রকল্পে কর ছাড়ের যে বিদ্যমান নিয়ম আছে, তা পরিবর্তন করে বিকল্প প্রস্তাব করছে সংস্থাটি।
বাংলাদেশে জিডিপির তুলনায় কর আদায়ের পরিমাণ বিশ্বে সবচেয়ে কম। এটি এখন ৯ শতাংশের নিচে। প্রতিবেশী ছোট অর্থনীতির দেশ নেপালে কর-জিডিপি অনুপাত ১২ শতাংশ। নানা পদক্ষেপ নেয়ার পরও অনেক দিন ধরে একই জায়গায় আছি আমরা। কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে হলে এই সংস্কৃতি থেকে বের হতে হবে।
গত সপ্তাহে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছে লিখিত চিঠিতে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেছেন, উন্নয়ন প্রকল্পে ‘সরাসরি’ কর অব্যাহতি দেয়া যাবে না। এর পরিবর্তে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম আমদানির মাধ্যমে শুল্ক-কর পরিশোধ করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। যে পরিমাণ শুল্ক-কর পরিশোধ করা হবে, পরে তা ফেরত বা রিফান্ড দেয়া হবে। এ জন্য প্রতি বছর বাজেটে আলাদা বরাদ্দ রাখা যেতে পারে।
রাজস্ব বোর্ড আরও বলেছে, প্রকল্প প্রণয়নের সময় যে ব্যয় প্রাক্কলন করা হবে, তার সঙ্গে শুল্ক ও কর বাবদ কত লাগবে তা একসঙ্গে যুক্ত করে মোট ব্যয় নির্ধারণ করতে হবে। এখন প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয়ের সঙ্গে শুল্ক ও কর যুক্ত করা হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কর মওকুফের বিশেষ সুবিধা নেয়া হয় এনবিআর থেকে এসআরও জারির মাধ্যমে।
এনবিআরের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বাংলাদেশে জিডিপির তুলনায় কর আদায়ের পরিমাণ বিশ্বে সবচেয়ে কম। এটি এখন ৯ শতাংশের নিচে। প্রতিবেশী ছোট অর্থনীতির দেশ নেপালে কর-জিডিপি অনুপাত ১২ শতাংশ। নানা পদক্ষেপ নেয়ার পরও অনেক দিন ধরে একই জায়গায় আছি আমরা। কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে হলে এই সংস্কৃতি থেকে বের হতে হবে।
রাজস্ব বোর্ড কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যেসব ক্ষেত্রে কর অব্যাহিত বা মওকুফের সুবিধা দেয়া হয়, তার একটি তালিকা আছে। এর মধ্যে উন্নয়ন প্রকল্পে সুবিধা দেয়ার কথা বলা আছে।
বর্তমানে প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ, কাঁচামাল আমদানিতে কর অব্যাহতির সুবিধা দেয়া হয়। এর বাইরে যেসব কর্মকর্তা কনসালট্যান্ট হিসেবে নিয়োগ পান তাদের বেতন-ভাতা বা আয় করমুক্ত। যে মন্ত্রণালয় বা বিভাগ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পর্যালোচনার পর আদেশ (এসআরও) জারি করে কর ছাড়ের এ সুবিধা দেয় এনবিআর।
রাজস্ব আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়-বিভাগের সচিবদের কাছে লিখিত চিঠিতে এনবিআরের চেয়ারম্যান উল্লেখ করেন মূলত বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে শুল্ক-কর অব্যাহতি আমাদের অবস্থানের উন্নতিতে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা।
এ কর আদায় করা গেলে প্রকৃত কর-জিডিপি অনুপাত বর্তমানের দ্বিগুণ হবে। এর ফলে বাংলাদেশের উন্নয়নকে অধিক মাত্রায় ত্বরান্বিত করা সম্ভব বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
চেয়ারম্যান জানান, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটতে চলেছে বাংলাদেশের। কিন্তু এখনও কর জিডিপির অনুপাত ১০ শতাংশের নিচে। কর জিডিপির অনুপাত না বাড়ার পেছনে বাধাগুলোর অন্যতম কর অব্যাহতি। কর অব্যাহতির কারণে অনেক সময় এনবিআর রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারে না।
কর অব্যাহতির বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর একটি অনুশাসন তুলে ধরে এনবিআর চেয়ারম্যান চিঠিতে উল্লেখ করেন: ২০১৬ সালের ১০ মে শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলনকক্ষে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের উপস্থিতিতে উচ্চপর্যায়ের সভায় অব্যাহতির পরিবর্তে প্রযোজ্য শুল্ক-কর পরিশোধ সাপেক্ষে পণ্য ছাড়ের মাধ্যমে কর জিডিপির হার বৃদ্ধির বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছিল। আমরা ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে চাই।
কতটি উন্নয়ন প্রকল্পে এ পর্যন্ত কর সুবিধা দেয়া হয়েছে, তার কোনো তথ্য-উপাত্ত এনবিআরের কাছে নেই। তবে রাজস্ব বোর্ড বলেছে, এ সুবিধা দেয়ার কারণে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে। অধিকাংশ মেগাপ্রকল্প কর মওকুফ সুবিধা ভোগ করছে। এর বাইরে বড় বড় প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে এ সুবিধা দিয়েছে সরকার।
তবে সবচেয়ে বেশি কর সুবিধা পাচ্ছে বিদ্যুৎ খাত। এ খাতের সব বড় প্রকল্পই কর অব্যাহিত ভোগ করছে। এ ছাড়া অবকাঠামো খাতের বড় প্রকল্পগুলো একই রকম সুবিধা পাচ্ছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার অধীনে প্রায় দেড় হাজার প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন।
যোগাযোগ করা হলে পরিকল্পনা সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, উন্নয়ন প্রকল্পে শুল্ক-কর পরিশোধের বিষয়ে এনবিআর থেকে যে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, তার সঙ্গে আমি একমত। আমরা প্রস্তাবটি আমলে নিয়েছি এবং কীভাবে এর বাস্তবায়ন করা যায়, তা নিয়ে পর্যালোচনা করা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কয়টি প্রকল্প কর মওকুফ সুবিধা ভোগ করছে, এর তথ্য আমাদের কাছে নেই। তবে তথ্যটি থাকা উচিত।
এনবিআরের সাবেক সদস্য আমিনুর রহমান বলেন, কর অব্যাহতি, কর অবকাশ, কর রেয়াত কিংবা ছাড় দেয়া হয় দেশের বৃহত্তর অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে। যদিও এ সুবিধা দেয়ার ফলে রাজস্বের সাময়িক ক্ষতি হয়। তবে এর উদ্দেশ্য হচ্ছে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করে সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা।
তিনি বলেন, এ কথা সত্য যে আমাদের দেশে কর অব্যাহিত বেশি। অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবিত হয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় এ সুবিধা দেয়া হয়। এটা ঠিক নয়। এ জন্য কর অব্যাহতির তালিকা পর্যালোচনা করার সময় এসেছে। তবে ভেবে-চিন্তে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এনবিআরের সমীক্ষা : কর অব্যাহতির বিষয়ে গত বছর একটি সমীক্ষা চালায় এনবিআর। এতে বলা হয়েছে, বিভিন্ন খাতে অব্যাহতি দেয়ার ফলে প্রতি বছর রাজস্ব ক্ষতি হয় ২ দশমিক ২৮ শতাংশ, টাকার অঙ্কে প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকা।
খাত হিসেবে বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশে কয়েকটি খাতকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে মাত্র ৮ মাসে প্রায় পৌনে ৪ হাজার কোটি টাকা অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। খাতগুলো হলো: মোটরসাইকেল, মোবাইল, কম্পিউটার, ওয়াশিং মেশিন, কম্প্রেসার, এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডার, লিফট ও মাইক্রোবাস।
এনবিআর সূত্র মতে, ছোট-বড় উন্নয়ন প্রকল্প, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ও সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্পে কর অব্যাহতি দিয়ে আসছে এনবিআর। এ ছাড়া মন্ত্রণালয়, সরকারি সংস্থা, বিভিন্ন বাহিনী ও প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন উন্নয়ন খাতে কর অব্যাহতি দেয়া হয়। অন্যদিকে বিনিয়োগ বাড়াতে তথ্যপ্রযুক্তি খাত, বেজা-বেপজায় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ এবং শিল্প স্থাপনে কর অব্যাহতি দেয়া হয়। সূত্র : নিউজবাংলা