১০ বছরের দুটি গাছ থেকে একটি ছোট পরিবারের বাৎসরিক ভরণপোষণ সম্ভব বাড়ছে ঔষধিগুণে ভরপুর নিমের কদর
মতিনুজ্জামান মিটু : অভূতপূর্ব ঔষধি গাছ নিমের বহুবিধ উপকারের কথা কমবেশি সবাই জানে। প্রাণী ও উদ্ভিদকূলের জন্য এত উপকারী গাছ আজ পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। এজন্য নিমকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে দামি বৃক্ষ। নিমের এগুণাগুণের কথা বিবেচনায় নিয়েই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নিমকে একুশ শতকের বৃক্ষ বলে ঘোষণা দেয়। খ্রিস্টের জন্মের ৫ হাজার বছর আগে থেকেই ভারত উপমহাদেশে নিমের অস্তিত্ব ছিল বলে জানা যায়। নিমের গুণাগুণ সম্পর্কে প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের ধারণা থাকলেও এনিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা শুরু হয়েছে হাল আমলে। ভারত উপমহাদেশে নিম নিয়ে গবেষণা শুরু হয় ১৯৪২ সালে। পশ্চিমা বিশ্বে গবেষণা শুরু হয়েছে আরও অনেক পরে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিম নিয়ে গবেষণা শুরু হয় ১৯৭২ সালে। বাংলাদেশে এযাবত নিম নিয়ে কোন গবেষণা হয়েছে কিনা জানা যায়নি। তবে বর্তমান সময়ে মানুষের মধ্যে নিম নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ দেখা যায়। এর ব্যবহার ও চাষাবাদ নিয়ে মানুষের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও শিক্ষাবিদ কৃষিবিদ ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম আরও জানান, নিম এক বিশেষ উপকারী বন্ধু বৃক্ষ। নিমের জনপ্রিয়তা অনাদিকাল থেকে চলে আসছে। এগাছের পাতা থেকে বাকল, শিকড় থেকে ফুল, ফল থেকে বীজ সবগুলোই আবশ্যকীয়ভাবে কাজে লাগে। নিমের গুণ অতুলনীয়। নিম অনেক দ্রুতবর্ধনশীল গাছ। নিম বহুবর্ষজীবী মাঝারি ধরনের চিরহরিৎ বৃক্ষ। পরিপক্ব বয়সে ১৫ থেকে ২০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। তবে শুকনো জায়গায় পত্রঝরা বৃক্ষের মতো আচরণ করে। গাছ সাধারণত গোড়ার ব্যাসার্ধ ৬০ থেকে ৮০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়। গাছ বা মোটা ডালের বাকলের রঙ গাঢ় এবং অমসৃণ হলেও অপেক্ষাকৃত কচি ডালের রঙ খয়েরি। গাছের বাকল অপেক্ষকৃত মোটা। ডালের চারদিকে ওপর নিচে করে ৩০ থেকে ৩৫ সেন্টিমিটার লম্বা যৌগিকপত্র জন্মে। প্রতিটি পাতায় ১০ থেকে ১৭টি করে কিনারা খাঁজকাটা পত্রক থাকে। প্রতিটি পত্রক ৬ থেকে ৮ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। পাতায় জোড় এবং বিজোড় সংখ্যক পত্রক উভয়ই থাকতে পারে। সারা বছর পাতা গজায়। তবে বসন্তে পাতা ঝরাকালে বেশির ভাগ পাতা ঝরে যায়। ৪৫০ থেকে ১১৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত নিমগাছের জন্য উত্তম। তবে যেখানে বৃষ্টি কম সেখানেও নিম খুব ভালোভাবে বাড়ে। যার প্রমাণ সৌদি আরবের পবিত্র নগরীর আরাফাতের ময়দান। নিম খরা সহনশীল। নিম ফল পাখির প্রিয় খাদ্য। বর্ষায় নিম ফল পাকলে শালিকসহ আরও অনেক পাখি এসে নিম গাছে ভিড় জমায়। নিম হিন্দুদের পবিত্র বৃক্ষ। দেবতার মূর্তি তৈরির কাজে নিম গাছের ব্যবহার বহুল প্রচলিত।
নিম বাংলাদেশের সর্বত্র দেখা গেলেও উত্তরাঞ্চলে বেশি পাওয়া যায়। বলা হয় এর আদি নিবাস বাংলাদেশ, ভারত আর মিয়ানমারে। এ গাছটি বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান সৌদি আরবে জন্মে। বর্তমানে এউপমহাদেশেসহ উষ্ণ ও আর্দ্র অঞ্চলীয় সবদেশেই নিমগাছের বিভিন্ন প্রজাতি ছড়িয়ে আছে। সৌদি আরবের আরাফাত ময়দানে বাংলাদেশের নিম গাছের হাজার লাখো সংখ্যা গর্বিত করে। কেননা এত দূরে বাংলাদেশের নিম সারি সারিভাবে দাঁড়িয়ে জানান দেয় বাংলার ঐতিহ্যের মূর্ত প্রতীক হয়ে। বলা হয় কেউ যদি নিমতলে বিশ্রাম নেয় কিংবা শুয়ে ঘুমায় তাহলে তার বিমার কমে যায় সুস্থ থাকে মনেপ্রাণে শরীরে অধিকতর স্বস্তি আসে। এজন্য ঘরের আশপাশে দু-চারটি নিমের গাছ লাগিয়ে টিকিয়ে রাখতে হয়।
নিম বা ইন্ডিয়ান লাইলাক প্রাপ্ত বয়স্ক হতে প্রায় ১০ বছর সময় লাগে। এটি হচ্ছে সাধারণ নিম। এছাড়া আরও ২ প্রকার নিম আছে যা হচ্ছে মহানিম বা ঘোড়ানিম। এটি সাধারণ নিমের মতো বহু গুণে গুণান্বিত নয়। অপরটি হলো মিঠো নিম, এটি তেমন তেতো নয়। এটি দেশের পাহাড়ি অঞ্চল মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে পাওয়া যায় এবং সবজি হিসেবেও এর বহুল ব্যবহার প্রচলিত।
পবিত্র বৃক্ষ ও এদেশীয় গাছ নিম পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত মনীষীদের জীবনের সঙ্গে জড়িত। নিম পরিবেশ রক্ষা, দারিদ্র্যবিমোচন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ব্যাপক অবদান রাখে; নিম থেকে উৎপাদিত হয় প্রাকৃতিক প্রসাধনী, ওষুধ, জৈবসার ও কীটবিতাড়ক উপাদান; নিম স্বাস্থ্য রক্ষাকারী, রূপচর্চা, কৃষিতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়; নিমকাঠ ঘূণে ধরে না, নিমের আসবাবপত্র ব্যবহারে ত্বকের ক্যান্সার হয় না; নিম পানি স্তর ধরে রাখে শীতল ছায়া দেয় ও ভাইরাসরোধী; উপকারিতা বিবেচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নিমকে ঘোষণা করেছে একুশ শতকের বৃক্ষ হিসেবে; নিম শিল্প বিপ্লবের ফলে উদ্ভূত দূষণ নিয়ন্ত্রণ করে; নিম ঝড়-ঝাঞ্ঝা ও ঝড় থেকে রক্ষা করে এবং নদীভাঙন ঠেকায়; নিমের সব অংশই ব্যবহারযোগ্য ও উপকারী; নিম মাটির লবণাক্ততা রোধ করে এবং অম্ল ও ক্ষারের সমতা ফেরায়; নিম গাছ বাতাস শীতল রাখে এবং অন্যান্য গাছের তুলনায় নিম গাছের নিচে তাপমাত্রা থেকে ২ ডিগ্রি কম থাকে; নিমপাতা গুঁড়া ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে উপকারী; নিমগাছ দ্রুতবর্ধনশীল এবং কাঠ খুব দামি; নিম যে কোনো মাটিতে জন্মে ও স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠে; নিম পরিবেশেবান্ধব ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় অদ্বিতীয়। ১০ বছর বয়সের দুটি নিম গাছের পাতা ও বীজ বিক্রি করে ৫ জনের পরিবারের সারা বছরের ভরণপোষণ সম্ভব; এক একরের বয়স্ক পরিপক্ব নিম গাছ থেকে বছরে ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করা যায়; নিম ফুলের মধু অন্যান্য ফুলের মধুর তুলনায় অধিক পুষ্টিকর ও ঔষধিগুণ সম্পন্ন; নিম মাটির ক্ষয় ও মরুময়তা রোধ করে; কৃষি বনায়ন বা কৃষি জমির আইলে নিম গাছ লাগালে ক্ষতিকর পোকামাকড়ের উপদ্রব কম হয়; নিম থেকে তৈরি ওষুধ, প্রসাধনী, জৈবসার ও কীট বিতাড়ক হিসেবে সারা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত; নিমের পাতা, ছাল-বাকল, বীজ ও কাঠসহ সব অংশই রফতানিযোগ্য; নিমগাছ গরু ছাগলে খায় না এবং বাঁচে ৪০০ বছরের অধিক; নিমের জৈবকীট বিতাড়ক ও সার, উপকারী কোনো কীট পতঙ্গ বা ব্যাকটেরিয়ার ক্ষতি করে না; নিমের তেল দিয়ে প্রদীপ জ্বালানো যায়; নিম পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান বৃক্ষ।
নিমের ছাল, ফুল, ফল, বীজে ও তেলে বিভিন্ন ধরনের তিক্ত উপাদান যেমন: স্যাপোনিন, এলকালয়েড নিমবিডিন, নিম্বন, নিম্বিনিন, নিম্বডল, ট্রাইটারপেনয়েড, সালনিন, এজাডিরাকটিন, জৈব এসিড, মেলিয়ানোন, নিম্বোলাইড, কুয়ারসেটিন ও গ্লাইকোসাইড, ট্যানিন, মারগোসিন, এজমডারিন এসব থাকে। যা হরেক রকমের কাজে লাগে।
সাধারণত নিমগাছ খোলামেলা জায়গায় বেশি দেখা যায়। রাস্তার আশপাশে, সমতল ভূমিতে ও নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় সব ধরনের মাটিতে নিমগাছ জন্মে। তবে বেলে, দো-আঁশ মাটিতে ভালো হয়। নিমগাছে মার্চ থেকে মে মাসে ফুল ফোটে। নিম ফল জুন থেকে আগস্ট মাসে পাকলে তখন বীজ সংগ্রহ করতে হয়। বর্ষাকালে নিমের চারা লাগানোর উপযুক্ত সময়।
উপমহাদেশের সুপরিচিত নাম নিম বসন্ত ও বায়ু শোধনকারী হিসেবে দুনিয়া সেরা। পূর্ব আফ্রিকায় এ গাছ মৌরোবিইনি নামে পরিচিত। কেননা এ গাছ দিয়ে অনেক রোগের উপশম হয়। রক্ত পরিষ্কারক, জীবাণুনাশক, চর্মরোগ, ব্রন, কৃমি ও ক্ষত আরও কত ব্যাধি থেকে পরিত্রাণ দেয়। শরীরে জ্বলাপোড়া, এলার্জি ও মুখের দুর্গন্ধনাশক। দাঁতের রক্তপড়া বন্ধ করে এবং দাঁতের মাড়ি সবল করে। তাছাড়া জন্ডিস প্রশমক। নিম দিয়ে অন্তত ৫০টি রোগ সারানো যায় বলে শতাব্দীর ইতিহাস সাক্ষী দেয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষিত একুশ শতকের বৃক্ষ এবং বর্তমান বিশ্বেও সবচেয়ে গুণধর আলোচিত ভেষজ নিম থেকে তৈরি হয় বিভিন্ন নিম সামগ্রী। বাজারে নিমের যেসব পণ্য পাওয়া যায় তার মধ্যে রয়েছে; নিম চা, নিম ক্যাপসুল, নিম ডায়বেটিকস ক্যাপসুল, নিম চুল রক্ষাকারী ও খুশকিনাশক, নিম জৈবসার, নিম জৈববালাইনাশক, নিম পিওর অয়েল, নিম হারবাল বিউটি প্যাক, নিম হারবাল ফেসওয়াশ, নিম হারবাল কেশতেল, নিম শ্যাম্পু, নিম হারবাল টুথ পাউডার, নিমটুথ পেস্ট, নিম বেবি সোপ, নিম হারবাল হানি সোপ, বিউটি সোপ, স্কিন কেয়ার সোপসহ আরও অনেক নিম সামগ্রী।