সয়াবিন তেল নিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের দুই ধরনের তথ্য
সোহেল রহমান ও আখতারুজ্জামান : বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর দেশের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পরিচালনা করে অবৈধভাবে মজুত করার অপরাধে বিপুল পরিমাণ সয়াবিন তেল জব্দ করেছে। শুধু সোমবারই ঢাকা ও চট্টগ্রামে ৪৪ হাজার ৫৮০ লিটার সয়াবিন তেল জব্দ করেছে সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি। ভোক্তা অধিদপ্তরের এই তথ্যই বলে দিচ্ছে যে কালোবাজারি ব্যবসায়ীদের কারণেই ভোজ্যতেলের দাম অসাভাবিকভাবে বাড়ছে।
এদিকে সোমবার সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্যমন্ত্রী বলছেন, বিশ্ববাজারে সয়াবিনের দাম বাড়ার কারণে বাংলাদেশে বাজারে দাম বেড়েছে। তিনি আবার এটাও বলেছেন যে, তেল বাজার থেকে উধাও করার কারসাজি করেছে ব্যবসায়ীরা। সেই সঙ্গে ব্যবসায়ীরা কথা রাখেনি, রোজায় তেলের দাম না বাড়ানোর অনুরোধ তারা রাখেনি।
সোমবার জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর রাজধানীর ডেমরা এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৩ প্রতিষ্ঠানের গুদাম থেকে ২৯ হাজার ৫৮০ লিটার ভোজ্যতেল উদ্ধার করেছে। নির্ধারিত মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্যে ভোজ্যতেল বিক্রির অপরাধে ৫০ হাজার টাকা করে ৩ প্রতিষ্ঠানকে মোট ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে। পরে তেল সরকারি রেটে বিক্রির নির্দেশ প্রদান করে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
অন্যদিকে একই দিন চট্টগ্রামের পাহাড়তলী বাজারের বিল্লি লেইনের সিরাজ সওদাগরের সিরাজ স্টোর দোকানের গুদাম জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে ১৫ হাজার লিটার সয়াবিন তেল জব্দ করে। পরে ঐ দোকানিকে এক লাখ ৭০ হাজার টাকা জরিমানা তেলগুলো ১৬০ টাকা দরে খোলা বাজারে বেচে দিয়েছেন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে ১৮ লাখ টনের বেশি তেল আমদানি করা হয়েছে। ফলে দেশে তেলের কোনো সঙ্কট হওয়ার কথা নয়। কারণ বাংলাদেশে বছরে প্রায় ২০ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। নিজস্ব যোগান বাদ দিয়ে বছরে ১৮ লাখ টন ভোজ্যতেল আমদানি করতে হয়। সেই হিসেবে দেশের বাজারে ভোজ্যতেলের সংকটের কোনো আশঙ্কা নেই। তার পরেও ব্যবসায়ীরা নিজেদের মতো করে প্রতিনিয়ত ভোজ্যতেলের দাম বাড়াচ্ছে।
কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সয়াবিন তেলের কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়েছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী তেল মজুত করে রেখেছেন। এতে করে সয়াবিনের দাম অসাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারের যথাযথ মনিটরিং না থাকার সুযোগ নিয়েছে ব্যবসায়ীরা। যারা দাম বৃদ্ধির পেছনে কাজ করছে তাদেরকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় বাজার সাভাবিক হবে না বলে তিনি জানান।
বেসরকারি ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনশাস কনজ্যুমার্স সোসাইটি (সিসিএস)-এর নির্বাহী পরিচালক পলাশ মাহমুদ বলেন, ঈদুল ফিতরের পর সয়াবিন তেলের মূল্য লিটারে ৩৮ টাকা বৃদ্ধির পরেও বাজারে তেলের সঙ্কট সৃষ্টি করা হয়েছে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের তদারকিতে বিভিন্ন ডিলার ও ব্যবসায়ীদের গোপনে মজুত করা তেল উদ্ধার হচ্ছে। এতে প্রমাণিত হয়, ভোজ্যতেলের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টির মাধ্যমে ভোক্তা সাধারণকে জিম্মি করে অতিরিক্ত মূল্য আদায় করা হচ্ছে।
বলে মন্তব্য করেছেন ।
সোমবার সচিবালয়ে ভোজ্যতেলের বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ভোজ্যতেলের দাম না বাড়ানো এবং সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে অনুরোধের পরও ব্যবসায়ীরা কথা রাখেননি। আমরা ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু তাদের বিশ্বাস করা ভুল ছিল। এটাই আমাদের ব্যর্থতা।
পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে তিনি বলেন, গত ফেব্রুয়ারি মাসে তেলের মূল্য নির্ধারণের পর আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্য বৃদ্ধির ফলে রোজার মধ্যেই আরেকবার দাম বাড়ানোই ভালো ছিল। কিন্তু রোজায় যাতে মানুষের কষ্ট না হয় সেজন্য মিল মালিকদের অনুরোধ করে দাম বাড়ানো কিছুটা বিলম্বিত করা হয়েছিল। মিল মালিকরা মেনে নিলেও খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতারা ঠিকই দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। ঈদের পর তেলের দাম বাড়তে পারে, সেই তথ্য ব্যবসায়ীদের কাছে আগে থেকেই ছিল। তাই ডিলার ও খুচরা পর্যায়ে যে যেভাবে পেরেছে পণ্য মজুদ করেছে। অনেক ব্যবসায়ী পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েছেন।
তেলের সঙ্কট তৈরি করা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে- জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, কোথায় কোথায় কারসাজি হয়েছে, কোথায় সমস্যা হয়েছে, তা ইতিমধ্যে চিহ্নিত। চিহ্নিত ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তবে কাজটি কিন্তু খুচরা পর্যায়ে হয়েছে। আমাদের ভোক্তা অধিকার যেখানেই এ ধরনের ঘটনা পাচ্ছে তাদের জরিমানা-মামলা করছে। আমরা অ্যাসোসিয়েশনকে বলেছি তাদেরও ব্যবস্থা নিতে হবে। মিল মালিকদেরও করতে হবে মনিটরিং। কোন কোন জায়গায় এ ধরনের ডিলার আছে তাদের ডিলারশিপ বাতিল করা হতে পারে। আইনগতভাবে যেখানে যেটা দরকার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। প্রয়োজনে র্যাবের সহযোগিতা নেয়া হবে।
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে, সেটা সত্যি। সাধারণ মানুষের কষ্ট হচ্ছে এটাও সত্যি। আমরা মাত্র ১০ শতাংশ তেল উৎপাদন করি। কিন্তু ৯০ শতাংশই বিদেশ থেকে আসে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলে দাম কত বেড়েছে তা মিডিয়ায় আসা উচিত। বেশিরভাগ গণমাধ্যম শুধু দেশে তেলের দাম বৃদ্ধি নিয়ে কথা বলছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি নিয়ে কেউ কথা বলছে না। নেপাল, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ প্রায় সব দেশেই তেলের দাম বেড়েছে। গত এক বা দেড় মাসে গ্লোবাল মার্কেটে দামের কেমন তারতম্য সেটা নিয়ে কোনো সংবাদ প্রকাশ করা হচ্ছে না। আবার দাম কমলে সেটাও বলা উচিত। লন্ডনে এক লিটার তেল ফিক্সআপ করে দেয়া হয়েছে, জার্মানিতে তেলই পাওয়া যাচ্ছে না- সে কথাটা জানা দরকার। যুদ্ধ অনেকদিন চললে দাম আরও বাড়তে পারে।
আগামীতে তেলের দাম বাড়বে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সত্য যতই কঠিন হোক, তা মেনে নিতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশে তেলের মূল্যবৃদ্ধির বাস্তবতা মেনে নিতে হবে। তবে আমরা আন্তর্জাতিক বাজার মনিটর করবো। আশপাশের দেশগুলো দেখে বিবেচনা করবো সবকিছু। যতদূর দাম কমানো যায় সে চেষ্টা করবো। এলসি কত দামে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ক্লিয়ার করা হলো সেটা ধরে তেলের দাম নির্ধারণ হয়। সোমবার ২৫০ টাকা হয়েছে, সেটা ধরে কিন্তু দাম নির্ধারণ হচ্ছে না। সোমবারের দামে যদি ফিক্স করতাম তাহলে রোববার টনপ্রতি তেলের দাম ছিল ১৯৫০ ডলার।
প্রসঙ্গক্রমে বাণিজ্যমন্ত্রী জানান, তেলের উচ্চ মূল্যে দরিদ্র মানুষকে সুরক্ষা দিতে সরকার নতুন উদ্যোগ নিচ্ছে। মূল্যস্ফীতির চাপ এড়াতে সরকার টিসিবি’র ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে জুন মাসে আবারও ১ কোটি দরিদ্র পরিবারকে সাশ্রয়ী মূল্যে ভোজ্যতেলসহ অন্যান্য পণ্য সরবরাহ করবে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত সিটি গ্রুপের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান বলেন, তেলের সরবরাহ কিছুটা কমেছে। তবে বাজারে যে সংকট দেখানো হচ্ছে, পরিস্থিতি ততটা খারাপ নয়। দোকানদার যদি পণ্য মজুদ করে সেই দায় উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের নয় বলে দাবি করেন তিনি।