আমদানি ব্যয় বাড়ায় কমছে রিজার্ভ আমদানির লাগাম টেনে রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় বাড়াতে বলছেন অর্থনীতিবিদরা
মো. আখতারুজ্জামান : প্রতিনিয়ত বাড়ছে আমদানি ব্যয়। রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় সেই তুলনায় বাড়ছে না। ফলে আমদানি ব্যয় মিটাতে গিয়ে বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। এখনই আমাদনি ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরে রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় বাড়াতে বলছেন অর্থনীতিবিদরা।
এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) রেকর্ড আমদানি বিল পরিশোধের পর বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ ৪২ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। যা গত দেড় বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। যা দেশিও মুদ্রায় ৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা। ২০২০ সালের নভেম্বরে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪১ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার।
গত ৫ মে আকুর মার্চ-এপ্রিল মেয়াদের ২ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলারের আমদানি বিল পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে কখনই আকুর এতো বেশি বিল শোধ করেনি বাংলাদেশ। এর ফলে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক ৪১ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
বর্তমানের আমদানির খরচ হিসাবে এই রিজার্ভ দিয়ে পাঁচ মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে। যদিও সাত-আট মাস আগেও ১০ মাসের আমদানি খরচ মেটানোর রিজার্ভ ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমাদের রেমিটেন্স ব্যবহারে শর্তক হতে হবে। আমাদের এই মহুর্তে প্রয়োজন নেই এমন পণ্য আমদানি থেকে বেরত থাকতে হবে। যে হারে রিজার্ভ কমতেছে এটা ভালো লক্ষ্য নয়। এই অবস্থান থেকে বেড়িয়ে আসার পথ খুজতে হবে। আমাদের যাতে রিজার্ভ বাড়ে সেইদিকে মনোযোগ দিতে হবে। রপ্তানি আয় কিভাবে বাড়নো যায় সেটা দেখতে হবে। পাশপাশি প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স যাতে আরও বাড়ে সেজন্য যেসব দেশে আমাদের প্রবাসীরা রয়েছেন সেব দেশে কূনৈতিক সম্পর্ক আরও বাড়াতে হবে। তারা যাতে আমাদের শ্রমিকদের সুযোগ সুবিধা বাড়ায়, সে বিষয়ে আলোচনা করতে হবে। নতুন নতুন দেশে কিভাবে আমাদের শ্রমিকদের পাঠানো যায় সে বিষয়ে বিভিন্ন ফোরামে কথা বলতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, মহামারি করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার পর থেকেই দেশে আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। ২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার আগে মাসে আমদানি খাতে গড়ে ৪ থেকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার খরচ হতো। করোনার মধ্যে তা কমে গড়ে ৩ থেকে সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।
কিন্তু চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের শুরু থেকেই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আমদানি ব্যয়। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ৫ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়। আগস্টে তা বেড়ে ৬ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। সেপ্টেম্বরে তা গিয়ে ঠেকে ৭ বিলিয়ন ডলারে।
অক্টোবরে পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয় ৭ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার। নভেম্বরে তা বেড়ে ৭.৮৫ বিলিয়ন ডলারে উঠে। ডিসেম্বরে তা আরও বেড়ে ৮ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে।
জানুয়ারি মাসে ৮ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। সবশেষ ফেব্রুয়ারি মাসে আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৮ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমদানি বাড়লে রিজার্ভ কমবে এটাই স্বাভাবিক। তবে এতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। এখনও মোটামুটি সন্তোষজনক রিজার্ভ আছে। তবে, যে করেই হোক এখন আমদানিতে লাগাম টানতে হবে। একইসঙ্গে রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় আরও বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় ব্যবসায়ীরা উৎপাদন বাড়িয়েছে। ফলে মূলধনি যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামালসহ সব ধরনের পণ্যেও আমদানি বাড়ছে। জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিও আমদানি খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে। সব মিলিয়ে আমদানিতে রিজার্ভ থেকে আগের চেয়ে বেশি খরচ হচ্ছে।
চলতি বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আকুর নভেম্বর-ডিসেম্বর মেয়াদের ১ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলারের বিল শোধের পর এই সূচক ফের ৪৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। রপ্তানি আয় বাড়ায় এবং রেমিটেন্স প্রবাহে গতি ফেরায় পরে তা বেড়ে ৪৬ বিলিয়ন ডলারে উঠে।
মার্চের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে আকুর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসের ২ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়। সমন্বয় করার পর রিজার্ভ ৪৩ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। এরপর গত দুই মাসে তা কিছুটা বেড়ে ৪৪ থেকে ৪৪ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে উঠানামা করে।