স্বত্বাধিকার নিশ্চিত করলে আমের বাণিজ্যিক সুবিধা পাবে নিবন্ধনকারী
মতিনুজ্জামান মিটু : বর্তমানে বাংলাদেশের আম পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও রপ্তানি হচ্ছে। ভবিষ্যতে বাণিজ্যিকভাবে আমের রপ্তানি আরও প্রসারিত হবে। কিন্তু বাংলাদেশ নিজস্ব জাতের ওপর স্বত্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আগে অন্যদেশ ঐ জাতের ওপর স্বত্বাধিকার নিশ্চিত করলে নিবন্ধনকারী দেশকে বাণিজ্যিক সুবিধার অংশীদারী দিতে হবে। এতে দেশ বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন থেকে বঞ্চিত হবে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভিদ কৌলিসম্পদ কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ রেজওয়ান মোল্লা আরও জানান, বাংলাদেশে আমের জনপ্রিয় দেশীয় জাতগুলো ভৌগোলিক নির্দেশক হিসেবে নিবন্ধনের জন্য সংশ্লিষ্ট গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকার দেশের স্থানীয় ও নিবন্ধিত জাতের ওপর স্বত্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় অতিদ্রুত কার্যকরি পদক্ষেপ নেবে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এ পর্যন্ত আমের ১৪টি জাত উদ্ভাবন করেছে। এই জাতগুলো বাংলাদেশের আবহাওয়া উপযোগী হওয়ায় সারাদেশে এর চাষাবাদ ও বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। আগে আমের উৎপাদন বৃহত্তর রাজশাহী এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হলেও এখন দেশের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলে আমের ব্যাপক চাষাবাদ বেড়েছে। এক্ষেত্রে বারি আম-৩ এর চাষাবাদ সারাদেশ জুড়ে একটি বিপ্লব তৈরি করেছে। এ ছাড়াও আমের দীর্ঘ সময়ের চাহিদার সহজলভ্যতা বজায় রাখতে আমের নাবি জাত বারি আম-৪ উদ্ভাবন করা হয়েছে। বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের স্বাদের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে কাঁচামিঠা বারি আম-৯ ও দৃষ্টিনন্দন বারি আম-৭ এবং সারা বছর আমের প্রাপ্যতা বজায় রাখতে বারি আম-১১ উদ্ভাবন হয়েছে।
এ বিজ্ঞানী জানান, রবিশংকর ও অন্যান্যরা ভারতকে আমের উৎপত্তিস্থল অরিজিন বিবেচনার ক্ষেত্রে আমের বৈচিত্র্যের প্রাচুর্যতাকেও মানদন্ড হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশেও উল্লেখযোগ্যভাবে আমের বৈচিত্র্য রয়েছে। বৃটিশ ভারতের বাঙলা প্রদেশে তথা বর্তমান বাংলাদেশে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আম উৎপাদন হতো। সে গৌরব বর্তমানে অতীত।
বিশ্ব খাদ্য সংস্থা’র ২০১৭ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৫২টি বিভিন্ন জাতের আমের মধ্যে প্রধানত ৩১টি জাতের বাণিজ্যিক চাষাবাদ হচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের তথ্য মতে প্রায় ৮টি বহুল সমাদৃত ভৌগোলিক নির্দেশক আমের জাত রয়েছে। এগুলো হচ্ছে ফজলি, ল্যাংরা, গোপালভোগ, খিরসাপাত, আশ্বিনা, লক্ষণভোগ, সূর্যপুরী ও হাড়িভাঙ্গা।
এসব জাতে বিভিন্ন জিনগত বৈশিষ্ট্যের মধ্য হতে স্বাদ, গন্ধ ও অন্যান্য মানগত বৈশিষ্ট্য ওই নির্দিষ্ট এলাকার আবহাওয়া ও জলবায়ুর ওপর নিবিড়ভাবে নির্ভরশীল এবং এই জাতগুলোর ভৌগোলিক পরিবর্তনের কারণে এদের উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলোও পরবর্তিত হয়ে যায়।
বাংলাদেশের এসব ভৌগোলিক নির্দেশক ফসলের অবস্থান, চাষাবাদের ইতিহাস, ফসলগুলোর বিস্তারিত জিনগত বৈশিষ্ট্যায়নের (অঙ্গসংস্থানগত ও মলিকুলার) তথ্যের অপ্রতুলতার কারণে অন্যদেশের বায়োপাইরেসির মাধ্যমে এসব ফসলের স্বত্বাধিকার বা প্যাটেন্ট লাভের সুযোগ রয়েছে। ইতোমধ্যে জামদানি, ফজলি আম, রংপুরে লাইম কে অন্য দেশ ওইদেশের সম্পদ হিসাবে স্বত্বাধিকার বা প্যাটেন্ট নেওয়া হয়েছে। এধরনের বায়োপাইরেসি রোধকল্পে বাংলাদেশ সরকার দেরিতে হলেও আমাদের দেশীয় বিভিন্ন ফসলসহ অন্যান্য সম্পদের প্যাটেন্ট প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় খিরসাপাত আমকে ডিপার্টমেন্ট অব প্যাটেন্ট, ডিজাইন অ্যান্ড টেডমার্ক (ডিপিডিটি) ভৌগোলিক নির্দেশক জাত হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। যা ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ওই ফসলের ওই জাতের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের এনএটিপি ফেজ-১ প্রকল্পের অর্থায়নে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) বিভিন্ন ফসলের অবমুক্ত জাত এবং ওইসব ফসলের ভৌগোলিক নির্দেশক জাতগুলোর অবস্থান, চাষাবাদের ইতিহাস, তাদের শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য (অঙ্গসংস্থানগত ও মলিকুলার) সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য সম্বলিত একটি পূর্ণাঙ্গ ডাটাবেজ তৈরির লক্ষ্যে ক্যারেক্টারাইজেশন অফ ইমপরটেন্ট প্লান্ট জেনেটিক রিসোর্স শিরোনামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এপ্রকল্পের আওতায় বারি উদ্ভাবিত নয়টি আমের জাতসহ নয়টি বহুল সমাদৃত ভৌগোলিক নির্দেশক জাতের অবস্থান, চাষাবাদের ইতিহাস ও বিস্তারিত বৈশিষ্ট্যায়ন (অঙ্গসংস্থানগত ও মলিকুলার) সম্পর্কিত গবেষণা কার্যক্রম শেষ করা হয়েছে। এসব তথ্য সম্বলিত একটি নিবন্ধ আন্তর্জাতিক সাময়িকী জার্নাল অব হর্টিকালচার অ্যান্ড ফরেস্ট্রিতে প্রকাশিত হয়েছে। নিবন্ধনটির তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায় প্রতিটি জাতের অবস্থান ও চাষাবাদের ইতিহাসের পাশাপাশি আমের ১০২টি অঙ্গসংস্থানিক বৈশিষ্ট্যের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে যার মধ্যে ১৫টি গাছের, ২০টি পাতার, ২২ ফুলের, ৩৩টি ফলের, ১০টি স্টোন এবং ৫টি বীজ সংক্রান্ত। এ ছাড়াও ২৫টি মাইক্রোস্যাটেলাইট মার্কারের মাধ্যমে ডিএনএ প্রোফাইল তৈরি করা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রতিটি জাতের স্বতন্ত্র অঙ্গসংস্থানিক ও ডিএনএ প্রোফাইল চিহ্নিত করা হয়েছে। যা ওই জাতের শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য হিসেবে পরিগণিত হয়। এ ছাড়াও ওইসব জাতগুলো জন্মস্থান সম্পর্কিত ইতিহাস উল্লেখ করা হয়েছে এবং তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে সব চেয়ে পুরাতন গাছকে বিবেচনা করা হয়। ওই এলাকার বয়োবৃদ্ধ লোকজনের কাছ থেকে জাতটির চাষাবাদের ইতিহাস সংগ্রহ করা হয়। এ ক্ষেত্রে সূর্যপুরী আমের ইতিহাস সংগ্রহের উদাহরণ উল্লেখ করা যায়।
সূর্যপুরী বাংলাদেশের আমের একটি উল্লেখযোগ্য ভৌগোলিক নির্দেশক জাত। এই জাতের উৎপত্তিস্থল ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গি উপজেলার হরিণমারি ইউনিয়নের অন্তর্গত হরিণমারি নয়াপাড়া গ্রামে। এই গ্রামের সব চেয়ে পুরানো গাছটির বয়স ২০০ বছর এবং এর বিস্তৃতি ২ একর জায়গার ওপর। ধারণা করা হয় এগাছ থেকে আশেপাশের এলাকায় ওই জাতের বিস্তারলাভ করেছে। এইভাবে প্রতিটি জাতে উৎপত্তিস্থল ও চাষাবাদের ইতিহাস সংক্রান্ত তথ্য এই নিবন্ধটিতে সন্নিবেশিত হয়েছে। যা ভবিষ্যতে এসব জাতের ওপর বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণক হিসাবে বিবেচিত হবে।
সুতরাং এই নিবন্ধটি বাংলাদেশের ৯টি অবমুক্তজাত ও ৯টি ভৌগোলিক নির্দেশক জাত হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এ ছাড়াও আরও যেসব সমাদৃত ও নিবন্ধিত জাত রয়েছে তাদের ক্ষেত্রেও এই ধরনের পূর্ণাঙ্গ তথ্য সম্বলিত প্রকাশনা দরকার, যা ভবিষ্যতে ওইসব জাতগুলোর ওপর বাংলাদেশের জাত হিসাবে স্বত্বাধিকার লাভের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণক হিসাবে ভূমিকা পালন করতে পারে।
আম হচ্ছে একটি খুবই সুস্বাদু, পুষ্টিকর ও দৃষ্টি নন্দন জনপ্রিয় ফল। সারা পৃথিবী জুড়েই এর চাষাবাদ হয়। তবে ট্রপিকাল ও সাবট্রপিকাল অঞ্চলের চাষাবাদ বেশি হয়। এসব অঞ্চলেই বিভিন্ন ধরনের আমের চাষাবাদ দেখা যায়। যা বিভিন্ন শ্রেণীর ভোক্তাদের চাহিদা পূরণে ফ্রেশ ফল হিসাবে অথবা প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে। বর্তমানে মানুষের আর্থিক সঙ্গতি বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষ মৌলিক খাদ্য গ্রহণের পাশাপাশি অধিক পুষ্টিকর ও অন্যান্য গুণাগুণ সম্পন্ন খাদ্য গ্রহণের দিকে ঝুঁকছে।