জনপ্রিয় হচ্ছে ঘাস সংরক্ষণ প্রক্রিয়া সম্প্রসারণ হচ্ছে সাইলেজের বাজার
মতিনুজ্জামান মিটু : বাংলাদেশের প্রাণিস¤পদ খাত ক্রমাগত বাড়ছে। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের সফল অংশীদার এখাতে মানুষের আত্মকর্মসংস্থানও বাড়ছে। প্রাণিজ আমিষের চাহিদা এখন দেশের উৎপাদিত গবাদীপ্রাণি থেকেই পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে। দেশের চারণভূমির পরিমাণ দিন দিন কমছে। দানাদার খাদ্যের দামও ক্রমাগত বাড়ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে খামারিদের প্রাণিখাদ্য বিশেষ করে ঘাস যাওয়ানো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্ষাকালে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ঘাসের অভাব পূরণে ভূমিকা পালন করতে পারে সাইলেজ।
প্রাণিস¤পদ সম্প্রসারণ কর্মকর্তা (এনএটিপি-২) ডা. মো. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, সাইলেজ আধুনিক খামারিদের কাছে খুবই পরিচিত পদ্ধতি। সাইলেজ মূলত সবুজ ঘাস সংরক্ষণ করার একটি পদ্ধতি। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে সবুজ ঘাসের পুষ্টি উপাদান সঠিক রেখে বায়ুশূন্য অবস্থায় সবুজ ঘাসকে ভবিষ্যতের জন্য প্রক্রিয়াজাত করে রাখার প্রক্রিয়াই সাইলেজ।
সাইলেজ পুষ্টিকর একটি গোখাদ্য তৈরীর প্রক্রিয়া। যার রয়েছে বহুবিধ উপকারিতা। ভালভাবে পচন করা হলে সাইলেজের শর্করা খাবারকে পরিপাকযোগ্য এসিডে পরিণত, যা গরুর খাদ্যের পুষ্টিগুণ বাড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি সাইলেজে ব্যবহৃত সব পুষ্টি উপাদান খাবারকে নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করে। প্রাকৃতিক ভাবে চরে যাওয়া ঘাসের চেয়ে অনেক বেশি খাদ্য উপাদান পাওয়া যায়। এতে শক্তির অপচয় অনেক কম হয়। দুগ্ধবতী গাভীর শারীরিক এবং দুধ উৎপাদনে প্রচুর পরিমাণে শক্তি, আমিষ ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান দরকার। ভাল মানস¤পন্ন সাইলেজের মধ্যে প্রচুর পরিমাণ শক্তি, প্রোটিন, ভিটামিন, ফাইবার রয়েছে। যা গাভীর দুধ উৎপাদন অনেকাংশে বাড়িয়ে দিতে পারে। পরিপাক ক্রিয়া স্বাভাবিক ও ভাল রাখে।
চারণ ভূমিতে চরানোর ফলে ঘাসের উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায়। অন্যদিকে সাইলেজ বানানোর ফলে জমিতে ঘাসের উৎপাদন বাড়ে। মাঠ থেকে বেশি মাত্রায় ঘাস সংগ্রহ করে সাইলেজ বানানো হলে সংকটকালীন সময়ে গরুর চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। শুকনো খড় বা ঘাস রাখার জন্য বেশি জায়গার দরকার হয়, অন্যদিকে সাইলেজ সংরক্ষণে অল্প জায়গা লাগে। সাইলেজে পরিপাকযোগ্য এনার্জির পরিমাণ বেশি। প্রতি কেজিতে ৯ থেকে ১২ মেগাজুল এনার্জি পাওয়া যায়।
সাইলেজের মধ্যে এনার্জি, আমিষ ও দরকারি ফ্যাট থাকায় গাভীর পরিপাক ক্রিয়া স্বাভাবিক ও দুধ উৎপাদন বাড়াতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। সাইলেজ সঠিক মাত্রায় খাওয়ানো হলে প্রজনন প্রক্রিয়া ভাল থাকে। বর্ষা মৌসুমে সবুজ ঘাসে ময়েশ্চার বেশি থাকার কারণে শুকাতে সমস্যা হয়, আর শুকনো হলে পুষ্টিমান কমে যায়। তাই সারাবছর সঠিক পুষ্টিমান সমৃদ্ধ ঘাস গরুকে খাওয়াতে সাইলেজ হতে পারে উত্তম প্রক্রিয়া। কাঁচা ঘাসের চেয়ে এপ্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ করে রাখা ঘাসের গুণগত ও খাদ্যমান বেশি। যেমন : দূর্বা, বাকসা, আরাইল, সেচিসহ বিভিন্ন ধরণের দেশীয় ঘাস, যেমন: ধৈঞ্চা, ইপিল-ইপিলসহ নানা ধরণের গাছের পাতা এবং নেপিয়ার, পাকচং, জার্মান, ভূট্টা, সুদান, পারা, সরগমসহ উন্নত জাতের ঘাস সাইলেজ তৈরি করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
সাইলেজ স্বভাবিক ঘাসের মতই প্রাণিকে খাওয়ানো যায়। সাইলেজ সবুজ ঘাসের চাহিদা পূরণ করে। সব বয়সের প্রাণিকে সহজে খাওয়ানো যায়। অল্প করে অভ্যাস করিয়ে বেশি করে খাওয়ানো যায়। সঠিক ভাবে পরিচর্যার পাশাপাশি নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণ সাইলেজ খাওয়ানো হলে গরুর মাংশ উৎপাদন অনেকাংশে বাড়ে। নিয়মিত টিকাদান, কৃমিমুক্ত রাখা এবং দানাদার খাবারের সঙ্গে সাইলেজ খাওয়ানোর ফলে খুব চমৎকার ফলাফল পাওয়া যায়।
গরুর ওজন অনুযায়ী ২ থেকে ৩শতাংশ হারে সাইলেজ দিনে ২ থেকে ৩ বার খাওয়ানো যায়। সাইলেজের মধ্যে কোন রাসায়নিক বা ইউরিয়া না থাকায় এতে খাওয়ানো কোন সতর্কতা বা ঝুঁকিও নেই। সাইলেজের মধ্যে ঘাসের সব উপাদান উপাদান সংমিশ্রণ থাকার ফলে পর্যাপ্ত এনার্জি, প্রোটিন, ফ্যাটসহ অন্যান্য উপকরণ থাকায় দুধ উৎপাদন বাড়ানোসহ প্রজনন ক্ষমতা ভাল রাখে। নিয়মিত সাইলেজ সঠিক নিয়মে খাওয়ালে গরু যথাসময়ে হীটে না আসা, গর্ভধারন না হওয়া, বাচ্চা প্রসবে বিলম্ব হওয়া ইত্যাদি কোন সমস্যা থাকেনা। বাছুরকে অল্প অল্প করে সাইলেজ খাওয়ালে বাছুরের পরিপাক ক্রিয়া স্বাভাবিক এবং বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়। এভাবে সংরক্ষিত ভুট্টা বা ঘাস প্রতি ১০০ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১০ কেজি হিসাবে ব্যবহার করা যায়।
বাংলাদেশে সাইলেজের নতুন মার্কেট সম্পর্কে ডা. মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সাইলেজের পুষ্টি এবং উপকারিতা জেনে খামারিরা নিজেরা সাইলেজ উৎপাদনে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। তাছাড়া দেশের কিছু কিছু কোম্পানি আধুনিক নিয়মে সাইলেজ উৎপাদন করে বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করছে। ইয়ন বায়ো সাইয়েন্স লিমিটেডসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এবং নতুন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তরা সাইলেজের বাণিজ্যিকীকরণে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। সাইলেজ অন্য খাবারের চেয়ে অনেকটা সাশ্রয়ী বিশেষ করে শুকনো খড় খাওয়ানোর চেয়ে সাইলেজ খাওয়ানো অনেক ভাল এবং খামারিরা এপ্রক্রিয়া অনুসরণ করে লাভবান হচ্ছে। এদেশের প্রাণিসম্পদ সেক্টরে সাইলেজ অনেক পুরনো একটি পদ্ধতি। তবে সাইলেজের এমন উপকারিতা খামারিরা এখনো সেইভাবে আয়ত্ত করতে পারেননি।