দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে গেছে ৪৫ কোটি টাকার সুরক্ষা সামগ্রী
অর্থনীতি ডেস্ক : করোনা মহামারিতে যখন একের পর এক অর্ডার বাতিল হচ্ছিল তখন পার্সোনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট- পিপিই, মাস্ক, গ্লাভস রপ্তানি করে টিকে থাকে দেশের তৈরি পোশাক খাত। শুধু তাই নয়, ২০২০ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের মতো নিয়ন্ত্রিত বাজারে অর্ডার পাওয়ার পর মাত্র দুই মাসের মধ্যে ৬৫ লাখ পিস পিপিই তৈরি করে পাঠানো হয়। ওই বছরের ২৫ মে করোনাভাইরাস মোকাবিলার জন্য বেক্সিমকোর তৈরি পিপিই’র প্রথম চালান পাঠানো হয় যুক্তরাষ্ট্রে। এরপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে পিপিই, মাস্ক, গ্লাভসসহ মেডিক্যাল সামগ্রী।
২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া মহামারি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে হাসপাতালগুলোতে পিপিই সবচেয়ে বেশি জরুরি ছিল। তাই পোশাক মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) উদ্যোগ নেয় পিপিইসহ সামগ্রী তৈরির।
বিজিএমইএর তথ্য বলছে, ২০২০ সালের শুরুতে যখন অর্ডার বাতিল হচ্ছিল, ঠিক তখন কারখানাগুলো মেডিক্যাল সামগ্রী তৈরি করার দিকে নজর দেওয়ায় পরিস্থিতির উন্নতি ঘটে। মহামারির শুরুতে অন্তত ৩০টি কারখানা পিপিই তৈরি করে।
বিজিএমইএ’র তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ মাসে যুক্তরাষ্ট্রে ৫২ লাখ ৫২ হাজার ৬০৫ ইউএস ডলারের পিপিই, মাস্ক, গ্লাভসসহ মেডিক্যাল সামগ্রী রপ্তানি করে বাংলাদেশ। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৪৫ কোটি টাকা ১৭ লাখ টাকা।
বিজিএমইএ’র তথ্য বলছে, বর্তমানে বাংলাদেশের ১৪টি কারখানা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা পিপিইসহ মেডিক্যাল সামগ্রী নিচ্ছেন। বাংলাদেশ গত এক বছরে (২০২১) পার্সোনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট-পিপিই রপ্তানি করেছে ১৩ লাখ ৭১ হাজার ২৪৫ পিস। এরমধ্যে এই এক বছরে প্রায় তিন লাখ সেট পিপিই, মাস্ক, গ্লাভসসহ মেডিক্যাল সামগ্রী পাঠানো হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ’র পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, করোনা মহামারির সময়ে উদ্যোক্তাদের অনেকেই পিপিই, মাস্ক, গ্লাভসসহ মেডিক্যাল সামগ্রী তৈরির উদ্যোগ নেন। গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের অনেকেই কারখানাগুলো পিপিই প্ল্যান্টে রূপান্তর করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে এখন বিশ্বমানের পিপিই তৈরি হচ্ছে, যা যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়।
সার্জিক্যাল মাস্ক রপ্তানি : গত ২০২০-২১ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে বাংলাদেশ থেকে এক কোটি ১৮ লাখ মার্কিন ডলার বা ১০৩ কোটি টাকার সার্জিক্যাল মাস্ক রপ্তানি হয়েছে। আর চলতি অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানি হয়েছে দুই লাখ ডলার বা এক কোটি ৮২ লাখ টাকার মাস্ক। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, অর্থবছরের প্রথম আট মাসে এন-৯৫, কেএন-৯৫-এর মতো সর্বোচ্চ মানের ওভেন মাস্ক রপ্তানি ১৫৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে বিশেষায়িত মাস্ক রপ্তানিতে। গত আট মাসে বাংলাদেশ থেকে এন-৯৫, কেএন-৯৫, এফএফপি-২, পি-২, ডিএসের মতো বিশেষায়িত ওভেন মাস্ক রপ্তানি হয়েছে ১৯ কোটি ৮৫ লাখ ডলারের। আগের অর্থবছরের একই সময়ে বিশেষায়িত মাস্ক রপ্তানি হয়েছিল সাত কোটি ৭৮ লাখ ডলারের। চলতি অর্থবছরে এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫৫ শতাংশের বেশি। মোট ৪৮টি দেশে এই মাস্ক রপ্তানি হলেও এর বেশির ভাগ গেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে। এই একটি দেশেই রপ্তানি হয়েছে ১৮ কোটি ৫৮ লাখ ডলারের মাস্ক।
গত অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে এক কোটি ১৮ লাখ ডলার বা ১০৩ কোটি টাকার তিন স্তরবিশিষ্ট সার্জিক্যাল মাস্ক রপ্তানি হয়েছিল বিশ্বের ২৪টি দেশে। এর মধ্যে শুধু তুরস্কেই রপ্তানি হয়েছিল ৮৬ লাখ ৫৬ হাজার ডলারের পণ্য। তবে চলতি অর্থবছরে এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে সার্জিক্যাল মাস্ক নেয়নি তুরস্ক।
পিপিই রপ্তানি : ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২০-২১ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে বাংলাদেশ থেকে ৬২ কোটি ৭৬ লাখ ডলার বা পাঁচ হাজার ৪৬০ কোটি টাকার বেশি ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী (পিপিই) রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২২ কোটি ৪৪ লাখ ডলার বেশি। এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এর মধ্যে পিপিই গাউন রপ্তানি হয়েছে ৩০ কোটি ৪৫ লাখ ডলারের। গত বছর একই সময়ে পিপিই গাউন রপ্তানি হয়েছিল ১৯ কোটি ৭৭ লাখ ডলারের। গাউন রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫৪ শতাংশ। পিপিই গাউন রপ্তানির ৯ কোটি ১৫ লাখ ডলার বা ৩০ শতাংশই গেছে জার্মানিতে।
করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পিপিই সামগ্রী সংগ্রহে প্রতিযোগিতা শুরু হয় বিশ্বজুড়ে। এই সুযোগে বাংলাদেশে পিপিই পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানির সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে গুরুত্ব পেতে শুরু করে।
বাডুজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন এক্সপোর্ট কম্পিটিটিভনেস ফর জবস (ইসিফোরজে) প্রকল্পের আওতায় পিপিই উৎপাদনে অর্থায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংকের এগিয়ে আসায় এ খাতে বিনিয়োগ গতি পায়। বিশ্বব্যাংক এ জন্য ১৭ দশমিক ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা প্রদান করার ঘোষণা দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রপ্তানি : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে বাডুজ্য যুদ্ধের সুফল পাচ্ছে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার বাডুজ্য যুদ্ধ মেড ইন বাংলাদেশ ব্র্যান্ডের রপ্তানিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। গত মার্চ মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে গত বছরের চেয়ে ৮১.৬৯ শতাংশ এবং এ খাতে ৮১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। বিজিএমইএ তথ্য অনুযায়ী, গত বছর একই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৪৪৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএর সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, বাংলাদেশ পোশাক পণ্যের গুণগত মান আগের চেয়ে উন্নত করেছে এবং উন্নত প্রযুক্তির সুবিধা গ্রহণ করেছে। একইসঙ্গে মেড ইন বাংলাদেশ ব্র্যান্ডও বিশ্বব্যাপী ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ বহির্বিশ্বের নাগরিকদের জন্য পোশাক তৈরিতে একটি নির্ভরযোগ্য দেশে পরিণত হয়েছে। বিজিএমইএ’র তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ মাসে যুক্তরাজ্যে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ৫৬ শতাংশ, কানাডায় ৭৭ শতাংশ, ইইউতে ৬৩ শতাংশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডেনিম এবং সুতির ট্রাউজার্স রপ্তানিতে বাংলাদেশ শীর্ষ। সেখানে শার্ট এবং অন্তর্বাস রপ্তানিতে বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে।
মার্কিন বাডুজ্য বিভাগের একটি অনুমোদিত অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেল (ওটেক্সা) এর তথ্যমতে, ২০২১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের গার্মেন্টস এবং টেক্সটাইল রপ্তানির পরিমাণ ৭৪০ কোটি মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে এবং রপ্তানিতে বাংলাদেশ চতুর্থ স্থান দখল করেছে।
আর চলতি বছরের প্রথম ৩ মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) বাংলাদেশ থেকে ২৪৮ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে অর্থের হিসাবে যে পরিমাণ পোশাক রপ্তানি হয়েছে, তা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬২ দশমিক ২৩ শতাংশ বেশি। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ মূলত ডেনিম, সুতির ট্রাউজার, শার্ট, স্কার্ট, ব্লাউজ, অন্তর্বাস এবং ব্রেসিয়ার ইত্যাদি রপ্তানি করে থাকে। মার্চ মাসে গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি করে ৩৯৩ কোটি মার্কিন ডলার আয় হয়েছে। এর মধ্যে ৮১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
কার্যাদেশের প্রবণতা দেখে মনে হচ্ছে, এ বছরের শেষ নাগাদ বাংলাদেশ প্রতি মাসে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি রপ্তানি করতে সক্ষম হবে। সেক্ষেত্রে, বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজার থেকে বছরে ১২ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করতে সক্ষম হবে। সূত্র : বাংলাট্রিবিউন