আমবাগান কেনাবেচায় মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমাতে মোবাইল অ্যাপস প্রচারণা বাড়াতে হবে
মতিনুজ্জামান মিটু: বিদায় নেবে গাছে থাকা অবস্থায় আমের ফলন নিরুপনের অনুমান নির্ভর ব্যবস্থা। মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে সহজেই হবে আমের ফলন প্রাক্কলন। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ফল বিভাগের উর্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. শরফ উদ্দিন বিভিন্ন সূত্রের বরাতে জানান, আমের বাগান ১ থেকে ১০ বছরের জন্য কেনাবেচা হয়। আবার এক মৌসুমেই ৩ থেকে ৪ বার কেনাবেবচা হয়ে থাকে। দেশের ব্যবসায়ীরা অনুমান করে আম বাগানগুলো কিনে থাকেন। এক সঙ্গে দল বেঁধে কয়েকজন অনুমানের ভিত্তিতে গাছের আমের সংখ্যা নির্ণয়ের পর বাগান মালিকের সঙ্গে দরদাম করে আম গাছ ও বাগান কেনেন। আম গাছে থাকা অবস্থায় আমের ফলন অনুমান অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। কিন্তু বর্তমানে মোবাইল ব্যবহার করে আমের ফলন নিরূপণ করা যায়। যা আম বাগান কেনাবেচার কাজে অনেক সহায়ক হতে পারে বলে গবেষকরা জানান।
ছোট-বড় সবার পছন্দের ফল আম এদেশের একটি গুরুত্বপূর্ন অর্থকরী ফসল। দেশের মানুষের পুষ্টি চাহিদা মেটাতে আম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে আম উৎপাদনে বাংলাদেশ সপ্তম অবস্থানে। আমের প্রধান চাষাবাদ চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী জেলাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু বর্তমানে দেশের ২৩ জেলায় আমের বাণিজ্যিক চাষাবাদ হচ্ছে। আম উৎপাদনকারী প্রধান জেলাগুলো হলো চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, পাবনা, কষ্টিয়া, রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, টাঙ্গাইল, জামালপুর, মেহেরপুর, ঝিনাইদাহ, দর্শনা, চুয়াডাঙ্গা, নড়াইল, যশোর, সাতক্ষীরা, গোপালগঞ্জ, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি এবং বান্দরবান। প্রতি বছর বাড়ছে আম চাষাবাদের এলাকা এবং সেই সঙ্গে বাড়ছে আমের ফলন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার উইং এর ২০২০-২১ অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী অনুযায়ী এদেশে ১লাখ ৯৮ হাজার ৫৭৮ হেক্টর জমিতে চাষ করলে উৎপাদিত হয় ২৫ লাখ ৫৭০ টন আম। এদেশে প্রতি বছর নতুন আমের বাগান সম্প্রসারিত হচ্ছে। ধানের নায্যমূল্য নিশ্চিত না হওয়ার কারণে ধানচাষিরা ঝুকছেন আম চাষের ওপর।
এদিকে আম গবেষকরা চেষ্ঠা চালিয়া যাচ্ছেন প্রতি বছর ফল দিতে সক্ষম এমন নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতি বছর ফলদানকারী ১২ টি জাত উদ্ভাবন করেছেন। উদ্ভাবিত জাতগুলো বিভিন্ন জেলায় বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ হচ্ছে। আমের গুণগতমান নিশ্চিত করণের জন্য উদ্ভাবন করা হয়েছে আমের আধুনিক উৎপাদন কলাকৌশল যার মধ্যে সার ব্যবস্থাপনা, সেচ ব্যবস্থাপনা, রোগবালাই ও পোকামাকড় দমন ব্যবস্থাপনা। আমকে শতভাগ মাছি পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য এবং আমে বালাইনাশকের ব্যবহার কমাতে উদ্ভাবন করা হয়েছে ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি। আমচাষিকে সব ধরণের সহযোগিতা দিতে মাঠ পর্যায়ে কর্মতে আছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দক্ষ জনবল।
ফলে আমচাষিরা আমের ভালোফলন পাচ্ছেন। তবে কখনও কখনও আমের নায্যমূল্য পাওয়া থেকে বিরত থাকেন। এই বিষয়টি নিয়েও গবেষকরা গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। বারি’র বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত চেষ্টায় মোবাইল অ্যাপসটি উদ্ভাবনের পর কয়েক বছর কেটে গেছে। কিন্তু আজও মাঠ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়নি সম্ভাবনাময় এপ্রযুক্তিটি। প্রয়োজনীয় জানাশোনার অভাবে ব্যবহৃত হচ্ছেনা এমোবাইল অ্যাপস। আমের কেনাবেচা কিন্তু অন্য ফল ফসলের মতো নয়। বহুবর্ষজীবি হওয়ায় এক বাগান কয়েকবার কেনাবেচা হয়। কোন কোন সময় দেখা যায়, এক মৌসুমেই কয়েকবার হাত বদল হয়। আবার কেউ কেউ ৩ থেকে ৫ বছরের বা দীর্ঘ মেয়াদের জন্য আমবাগান বিক্রি করে থাকেন। যখনই আম বাগান কেনাবেচা হয় তারা কিন্তু আমের ফলন অনুমান করতে ক্রেতারা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে থাকেন। ফলে ক্রেতা-বিক্রেতার দামাদামি করার তেমন সুযোগ থাকে না।
এই অবস্থা থেকে উত্তরণের কোন উপায় ছিলনা আমবাগান মালিকদের। আমবাগান কেনাবেচায় মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কোন ভাবেই কমানো সম্ভব হচ্ছিল না। কৃষি গবেষকরা এই বিষয়ে অবগত ছিলেন কিন্তু সমাধানের তেমন কোন উপায় তাদের হাতে ছিল না। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মার্ণে রূপকল্প-২০২১ সামনে রেখে কৃষির বিভিন্ন সেক্টরে বিভিন্ন অ্যাপসের ব্যবহার শুরু হয়েছে। বারি উদ্ভাবিত প্রযুক্তিগুলোকে হাতের মুঠোই আনতে উদ্ভাবন করা হয়েছে মোবাইল ভিত্তিক অ্যাপস ‘কৃষি প্রযুক্তি ভা-ার’। এ অ্যাপস ব্যবহার করে বিশ্বের যে কোন জায়গা থেকে বারি উদ্ভাবিত প্রযুক্তিগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে। চাষি ভাইয়েরা ইচ্ছে করলেই ঘরে বসে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট হতে উদ্ভাবিত যে কোন ফল-ফসলের চাষবাস, পরিচর্যা, রোগ-বালাই দমন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন।
আমবাগান কেনাবেচায় আমের ফলন নির্ধারণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখন থেকে মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে আগাম জানা যাবে আমের ফলন। ইমেজ এনালাইসিসের মাধ্যমে যে কোন জাতের ফলন আগাম নির্নয় করা সম্ভব হবে। এই অ্যাপস দিয়ে আমের ফলন প্রাক্কলন করতে প্রয়োজন হবে আমসহ গাছের ছবি, এই ছবি এনালাইসিস করে আমের সংখ্যা বের করা হবে। আমগাছের বয়স অনেক বেশি হলে বা ক্যানোপির বিস্তার বেশি হলে একটি গাছের কয়েকটি ইমেজ নেওয়ার দরকার হতে পারে। এরপর প্রত্যেক জাতের আমের গড় ওজন দিয়ে গুন করলে ফলন বের হবে।
এ ম্যাগো অ্যাপস ব্যবহার করে অত্যন্ত স্বল্প খরচে ও কম সময়ে অনেকাংশে নির্ভুলভাবে আমের ফলন প্রাক্কলন সম্ভব হবে। অথচ বর্তমানে আম গাছের ফলন প্রাক্কলনের প্রধান ও একমাত্র উপায় হলো প্রতিটি গাছের আম গননা করে প্রাপ্ত সংখ্যাকে প্রত্যেক জাতের গড় ওজন দিয়ে গুন করে ফলন প্রাক্কলন করা হয়। বাগানের মালিক এভাবে ফলন বের করার দুঃসাহস কখনও করেন না। শুধুমাত্র দালাল বা ফড়িয়ারা এভাবে আমের ফলন অনুমান করে আম বাগান কিনে থাকেন। ফলে আমবাগান মালিক বা আমচাষির ক্ষতির সম্ভবনা বেশি থাকে। অপরপক্ষে দালাল বা ফড়িয়াদের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
এপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে সারাদেশের আমের ফলন ও নির্নয় করা সম্ভব। এক বছর আমের দাম বেশি হয় এবং অন্য বছর একবারে দাম কমে যায়। দেশের আগাম ফলন জানা থাকলে আম সংরক্ষন, বাজারজাতকরণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রপ্তানি বিষয়ে সঠিক পরিকল্পনা করা সম্ভব। বিবিএস এর তথ্য বিশ্লেষন করে পরিকল্পনা করলে তা তেমন কাজে আসবে না। বারি উদ্ভাবিত ম্যাংগো অ্যাপস ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিটি আম গাছের ফলন, প্রতিটি বাগানের ফলন সঠিকভাবে প্রাক্কলন করা সম্ভব। প্রাপ্ত প্রাক্কলিত ফলনের ওপর ভিত্তি করে আম বাগান কেনা-বেচা করে আম বাগান মালিক, কৃষক, আড়ৎদার, বাগানক্রেতা সবাই প্রতারণার হাত হতে রক্ষা পাবেন। এদেশে উৎপাদিত আমের সম্ভাবনা অনেক। দেশি ও বিদেশি বাজারে ক্রমাগতভাবে বাড়ছে সুস্বাদু আমের চাহিদা।