যুদ্ধ নয়, শান্তি-উন্নতি চাই : প্রধানমন্ত্রী
অর্থনীতি ডেস্ক : বৈশ্বিক করোনাভাইরাস মহামারির ধকল না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ যুদ্ধ, সংঘাত চায় না; এ দেশ চায় শান্তি ও উন্নতি।
ঝুঁকি জেনেও বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ চাইলে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে বাংলাদেশ আরও শান্তিরক্ষী পাঠাতে প্রস্তুত রয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
ঢাকায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে রোববার সকালে আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত ছিলেন সরকারপ্রধান।
বক্তব্যে যুদ্ধ নিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘করোনাভাইরাসের মতো মহামারি অতিক্রম করতে করতে আবার একটা যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে, যা সারা বিশ্বের অর্থনীতির ওপর আজকে একটা প্রভাব ফেলেছে। আমরা কোনো সংঘাত চাই না; যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই। সারা বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক, সেটাই আমাদের কাম্য।’
‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ বলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে পররাষ্ট্রনীতি দিয়ে গেছেন, তা এখনও অনুসরণ করা হচ্ছে বলে জানান বঙ্গবন্ধুকন্যা।
তিনি বলেন, ‘আমরা সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখেই দেশের আর্থসামাজিক উন্নতি করার দিকে মনোনিবেশ করেছি। বাংলাদেশ সব সময় চায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক। আমরা যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই। সংঘাত না, আমরা উন্নতি চাই।’
বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ আরও শান্তিরক্ষী পাঠাতে প্রস্তুত জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতিসংঘের আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রয়োজনীয়সংখ্যক শান্তিরক্ষী, আরও প্রয়োজন হলে আমরা পাঠাতে প্রস্তুত। এটুকু জাতিসংঘকে বলতে পারি।’
বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের পতাকাকে সমুন্নত রেখে আত্মবিশ্বাস, সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিয়োজিত বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।
শান্তিরক্ষীদের উদ্দেশে সরকারপ্রধান বলেন, ‘আপনারা বাংলাদেশকে বিশ্বে একটি শক্তিশালী শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবেন, বিশ্বে বাংলাদেশের পতাকাকে সমুন্নত রাখবেন, এই আমাদের প্রত্যাশা।
‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী এবং পুলিশ বাহিনীর সব শান্তিরক্ষী বিশ্বব্যাপী শান্তি রক্ষা কার্যক্রমে পেশাদারত্ব ও সততা বজায় রেখে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করবেন। নিজেদের জীবনকে যেমন সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করবেন, দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়, সেভাবেও আপনারা কাজ করবেন, সেটাই আমরা চাই।’
সমসাময়িক বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিশ্বশান্তি নিশ্চিত করা অতীতের চেয়ে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘প্রযুক্তির দ্রুত প্রসার ও অগ্রযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রীয় এবং অরাষ্ট্রীয় অপশক্তিগুলো নতুন হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। ফলে বর্তমানে জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনগুলোতে শান্তিরক্ষীদের বহুমাত্রিক ও জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে।’
জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা অপারেশনে এই নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শান্তিরক্ষীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জামাদি দিয়ে প্রস্তুত করে তোলা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
‘পিপল পিস প্রোগ্রেস: দ্য পাওয়ার অফ পার্টনারশিপস’ প্রতিপাদ্য নিয়ে এবার উদযাপন হচ্ছে আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস। এদিন বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ আরও জোরালো ভূমিকা রাখবে বলে অঙ্গীকার করেন সরকারপ্রধান।
তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, আমাদের সশস্ত্র বাহিনী এবং পুলিশ বাহিনীর তরুণ সদস্যগণ ২১ শতকের বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম।’
জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে ৩৪ বছর ধরে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব দক্ষতা ও সফলতার সঙ্গে পালন করে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘ মিশনে কার্যকর অংশগ্রহণ বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় আমাদের অবস্থানকে সুসংহত করেছে।
একই সঙ্গে সামরিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের দেশের পারস্পরিক কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।’
শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা দেশের জন্য বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছেন বলেও জানান সরকারপ্রধান। তিনি বলেন, ‘যা আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে যাচ্ছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অধীনে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সদা প্রস্তুত। এ মুহূর্তে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় ১২১টি দেশের ৭৫ হাজার ৫১৬ জন শান্তিরক্ষী নিয়োজিত রয়েছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশের ৬ হাজার ৮২৫ জন শান্তিরক্ষী রয়েছেন, যা বিশ্বে নিয়োজিত সর্বমোট শান্তিরক্ষীর ৯ দশমিক ২ শতাংশ।
‘বর্তমানে বাংলাদেশের ৫১৯ জন নারী শান্তিরক্ষী বিশ্ব শান্তি রক্ষা কার্যক্রমে নিয়োজিত আছেন। আমি জেনে আনন্দিত যে, বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী এবং পুলিশ বাহিনী তাদের মহিলা শান্তিরক্ষীদের অংশগ্রহণ পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি করছে।’
সাউথ সুদান, লেবানন, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকান ও কঙ্গোতে শান্তি রক্ষায় নিয়োজিত বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ওই সময় তিনি বলেন, ‘শান্তি রক্ষা করা একটা মহৎ কাজ। আর সব থেকে বড় কথা যে, আমাদের যারা কাজ করেন, প্রত্যেকের ভেতরে একটা মানবিক গুণ আছে। যে গুণ দিয়ে শুধু শান্তি রক্ষায় নয়, অনেক মানবিক কাজও আমাদের শান্তিরক্ষী মিশনের সদস্যরা করে থাকেন।’
শান্তিরক্ষীদের ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল করছেন। বিশ্বশান্তি রক্ষা করার মহৎ দায়িত্ব আমরা পেয়েছি। এটা আমাদের যথাযথভাবে পালন করতে হবে।’
বিশ্বশান্তি রক্ষায় বাংলাদেশের নারীদের ভূমিকাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘শান্তি রক্ষা মিশনে গিয়ে এক দিকে শান্তিরক্ষীরা এবং মেয়েরা যে দায়িত্ব পালন করছেন, সেটার সবাই ভূয়সী প্রশংসা করছেন। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলও সব সময় প্রশংসা করেন। আমি সত্যিই খুব গর্বিত যে, আমাদের মেয়েরাও সমানতালে কাজ করে যাচ্ছেন।
‘শান্তি রক্ষা মিশনে সবাই, ছেলে-মেয়ে আমি কোনো বিভেদ করি না। সবাই স্ব স্ব দায়িত্ব অত্যন্ত ভালোভাবে পালন করছেন।’
বিশ্বশান্তি রক্ষার কার্যক্রমে অংশ নিয়ে গত ৩৪ বছরে দেশের ১৬১ জন শান্তিরক্ষী শহীদ হয়েছেন। এর মধ্যে গত এপ্রিল পর্যন্ত বিগত এক বছরে দুজন শান্তিরক্ষী নিহত হন।
এ বছর দুজন শহীদ শান্তিরক্ষী পরিবার এবং ১৪ জন আহত শান্তিরক্ষীকে সম্মাননা দেয়া হয়। তাদের পরিবারের সদস্যদের হাতে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সম্মাননা তুলে দেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
শহীদদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমি আবারও সেসব শান্তিরক্ষীকে স্মরণ করছি, যারা বিশ্বশান্তির জন্য অকাতরে জীবন উৎসর্গ করে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের পতাকাকে সমুন্নত রেখেছেন। তাদের পরিবারের প্রতি আমি সহমর্মিতা জানাচ্ছি।’ সূত্র : বাসস