দশ বছরে লিচু চাষের জমি ও উৎপাদন বেড়ে হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ লিচু উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ
মতিনুজ্জামান মিটু : নয় বছরে দেশে লিচু চাষের জমি ও উৎপাদন দুই বেড়েছে। চলতি বছরেও ক্রমউন্নতির এই ধারা বজায় রয়েছে। ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে ১০ বছরে দেশে লিচু চাষের জমি ও উৎপাদন বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। এইসঙ্গে ভালোমানের লিচু উৎপাদন বাড়ানোর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের এফলটির রপ্তানি বাজারে প্রবেশের সুযোগ হয়েছে। শীর্ষ উৎপাদক হিসেবে যে দেশটির নাম প্রথম আসে তা হলো চীন। এখানে ২ লাখ টন লিচু উৎপাদন হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসেবে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩১ হাজার ২৬১ হেক্টর জমিতে ২লাখ ১০ হাজার ৩২২ টন লিচু উৎপাদনের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ উঠে এসেছে বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থানে। সংগ্রহোত্তর ৩৫ শতাংশ লচের পরেও এদেশে বছরে লিচু উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ১লাখ ৪২ হাজার টন।
লিচু উৎপাদনে এর পরের দেশটি হচ্ছে তাইওয়ান। এখানে ১ লাখ ৩১ হাজার টন লিচু উৎপাদন হয়। থাইল্যান্ডে উৎপাদন হয় ১ লাখ ১০ হাজার টন। এর পরে রয়েছে ভিয়েতনাম, যেখানে ১ লাখ টন লিচু উৎপাদন হয়। ভিয়েতনামের পরে রয়েছে ভারত। ভারতে ৯০ হাজার টন, মাদারগাসকারে ৫০ হাজার টন লিচু উৎপাদন হয়। দক্ষিণ আফ্রিকায় লিচু উৎপাদন হয় ৮ হাজার টন, অস্ট্রেলিয়ায় ২ হাজার টন, মরিশাসে ১ হাজার টন ও যুক্তরাষ্ট্রে ৫০০ টন লিচু উৎপাদন হয়। শীর্ষ রপ্তানিকারক হিসেবে এখনও মাদাগাসকার অবস্থান করছে। এর পরে রয়েছে ভিয়েতনাম, চীন, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও অন্যান্য দেশ।
এদিকে লাগাতার গবেষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ লিচু উৎপাদনের ক্ষেত্রে অনেকে দুর এগিয়েছে। গবেষণার মাধ্যমে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বারি ইতোমধ্যে উন্নত ৩টি জাতের লিচু অবমুক্ত করেছে। এগুলো হচ্ছে বারি লিচু ১,২ ও ৩। গবেষণায় স্বল্পসময়ের লিচুছাড়াও একই পরিবারভুক্ত লংগন ও রামবুটানের আয়ুস্কাল বেড়ে ১মাসের স্থলে পাঁচ মাস হয়েছে। আগে একসময় শুধূমাত্র দিনাজপুরসহ আশপাশের এলাকায় সবচেয়ে বেশি হলেও বর্তমানে পাবনাসহ অন্যান্য অনেক এলাকায় বিস্তৃত হয়েছে লিচুর চাষ। উৎপাদনে অনেক এগিয়েছে মাগুরা ও সোনারগাঁ।
গ্রীষ্মকালীন ফল লিচু। গরম কালে লাল টকটকে, রসালো, মিষ্টি রসের লিচুতে মন মজেনি এমন খুঁজে পাওয়া যাবে না। এদেশে পাবনা, দিনাজপুর ও আশপাশের এলাকায় সবচেয়ে বেশি লিচু উৎপাদন হয়। তবে রসালো ফলটির আদি বাসস্থান চীন। দেশটির দক্ষিণ পূর্ব অঞ্চলীয় গুয়াংডং ও ফুজিয়ান প্রদেশ থেকে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে ফলটি। ইতিহাস মেনে এখনও চিনেই সবচেয়ে বেশি লিচু উৎপাদন হয়। তবে ফলটি রপ্তানিতে এগিয়ে রয়েছে ভারত মহাসাগরের দ্বীপ দেশ মাদাগাসকার।
অন্যদিকে কাঠলিচু একপ্রকার লিচু জাতীয় সুস্বাদু ফল। এটি লংগান বা আঁশফল নামেও পরিচিত। এটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উদ্ভিদ। চাঁপাইনবাবগঞ্জের কল্যাণপুর হর্টিকালচার সেন্টারের মাতৃবাগানে একটি চার বছর বয়সী গাছে থোকায় থোকায় ধরে আছে লংগান। বাদামি খোসা আর মার্বেল আকারের গোল লিচু হলো লংগান। আকারে সাধারণ লিচুর সঙ্গে পার্থক্য থাকলেও স্বাদে বেশ মিল আছে। খোসা ছাড়ালে চোখের মতো দেখতে, তাই চীনে লংগানকে বলা হয় ড্রাগনস আই।
ফলটির উৎপত্তি চীন, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার ও ভারতের কিছু অঞ্চলে। উদ্যানতত্ত্ববিদ মো. হাবিবুল্লাহ জানান, বাগানের গাছটিতে দুই বছর ধরে থাইল্যান্ডের একটি জাতের লংগান ধরছে। লংগান ফল হিসেবে লিচু পরিবারের সদস্য। তিন বছরের মধ্যেই ফল ধরতে শুরু করে। প্রতিটি ডালের মাথায় থোকায় থোকায় ধরে লংগান। ছাদবাগানের উপযোগী এলংগান। বড় টবে ১০ থেকে ১২ বছর পর্যন্ত রাখা যায়। দোআঁশ মাটিতে ভালো ফলন হয়। রোগবালাই বা পোকামাকড়ের আক্রমণ নেই বললেই চলে। তাই কীটনাশক ছাড়াই এর ফলন পাওয়া যায়। লিচু ঝরে পড়ে। কিন্তু লংগান ঝরে পড়ে না।
বর্তমানে বিদেশ থেকে আমদানি করে দেশে আনা এই ফল ঢাকার বিভিন্ন সুপারশপ ও বড় ফলের দোকানে ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। বাজারে লিচু শেষ হয়ে যাওয়ার এক মাস পর, অর্থাৎ জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে লংগান পাকতে শুরু করে। থাকে আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত। এই সময়ে লিচুর বিকল্প হিসেবে লংগান জনপ্রিয়তা পাবে বলে ধারণা উদ্যানতত্ত্ববিদদের।
বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প এর পরিচালক ড. মো. মেহেদি মাসুদ বলেন, লিচু উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে ২য়। লিচু ফুরিয়ে যাওয়ার পর লংগান পাওয়া যাবে। এর সংরক্ষণক্ষমতা লিচুর চেয়ে বেশি। ফ্রুকটোজ দিয়ে এর মিষ্টতা তৈরি হয়। ফলে ডায়াবেটিস রোগীরাও খেতে পারবেন। সংরক্ষণক্ষমতার কারণে এটি বিদেশেও রপ্তানিযোগ্য। সারা দেশের হর্টিকালচার সেন্টারগুলোতে এর মাতৃগাছ লাগানো হয়েছে। আগামী চার-পাঁচ বছরের মধ্যে এর চারা আগ্রহী ফলচাষিদের দেওয়া সম্ভব হবে। একই পরিবারভুক্ত রামবুটান ও লংগনের আয়ু এক মাস থেকে বেড়ে বর্তমানে পাঁচ মাস হয়েছে।
অপর দিকে যে সব বিদেশি ফল এ দেশে সফলভাবে লাভজনক হিসেবে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে তার মধ্যে রামবুটান অন্যতম। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক এম এনামুল হক জানান, এ ফল অনেকটা লিচুর মতো। তবে লিচুর চেয়ে আকারে বড়, ডিম্বাকৃতি, কিছুটা চ্যাপ্টা। পাকা ফল উজ্জ্বল লাল, কমলা বা হলুদ আকর্ষণীয় রঙের হয়ে থাকে। ফলের পুরু খোসার উপরি ভাগ কদম ফুলের মতো শত শত চুল দিয়ে আবৃত। মালয়েশিয়া ভাষায় রামবুটানের অর্থ চুল। একই কারণে এ ফল চুল বা দাড়ি বিশিষ্ট লিচু বলে অনেকের কাছে পরিচিত। রামবুটান লিচুর মতোই চিরহরিত, মাঝারি উচ্চতা বিশিষ্ট লম্বা গাছ। বর্ষাকালে জুলাই থেকে আগস্ট মাসে ফল পাকে। অপুষ্ট ফলের রঙ সবুজ থাকে। ফল পুষ্ট হলে উজ্জ্বল লাল বা মেরুন রঙে পরিবর্তন হতে থাকে এবং এর দু-তিন সপ্তাহের মধ্যে পাকা ফল সংগ্রহ করার উপযোগী হয়।
মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া এফলের আদি উৎস। থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ফিলিপাইনস, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার, ব্রুনাই ও শ্রীলংকায় প্রচুর রামবুটান ফল উৎপাদন হয়ে থাকে। এসব দেশ থেকে অনুরূপ আবহাওয়া বিশিষ্ট দেশে বা দেশের অংশ বিশেষে এ ফলের বিস্তার শুরু হয়। শীতের তীব্রতা কম এমন দেশে যেমন ভারত ও বাংলাদেশের এমন অংশেও এ ফলের বিস্তার ও চাষ জনপ্রিয়তা বাড়ছে।
ট্রপিক্যাল ও সাবট্রপিক্যাল আবহাওয়া বিশিষ্ট অঞ্চল রামবুটান চাষের জন্য উপযোগী। এ ফল গাছে শীতের তীব্রতা সহ্য শক্তি নেই বললেই চলে। শীত কালে তাপমাত্রা ১০০ সেলসিয়াসের নিচে নেমে ৫ থেকে ৭ দিন বিরাজ করলে গাছ মরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বাংলাদেশের দক্ষিণ ও পার্বত্য অঞ্চলীয় জেলাসহ বৃহত্তর ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা ও যশোর জেলায় এ ফল সম্প্রসারণ সম্ভাবনা বিরাজ করছে। রাঙ্গামাটি জেলায় কিছু সংখ্যক রামবুটান গাছে ৩০ থেকে ৪০ বছর ধরে ফল দিচ্ছে। নেত্রকোনা জেলার কিছু সংখ্যক চাষি প্রায় ২০ বছর ধরে রামবুটান ফল উৎপাদন বিপণন করে বেশ লাভবান হচ্ছেন। এছাড়া নরসিংদী উপজেলার শিবপুর জেলায় কয়েক জন রামবুটান চাষির সফলতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে লটকন চাষের পাশাপাশি রামবুটান চাষে অনেকেই আকৃষ্ট হচ্ছেন।
রামবুটান গাছে মার্চ মাসে ফুল ফোটা শুরু হয় এবং এপ্রিল মাসে কচি সবুজ রঙের ফল ধরতে আরম্ভ করে। ফুল ফোটার ৩ থেকে ৪ মাস পর জুলাই-আগস্ট মাসে ফল পাকে। ফল পুষ্ট হলে সবুজ রঙের ফল হঠাৎ করে লাল, মেরুন রঙে রূপান্তর হতে থাকে। এ অবস্থা শুরু হওয়ার ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে ফল সংগ্রহ করতে হয়। লিচু ফল সংগ্রহের মতো এফল হাত দিয়ে সংগ্রহ করা হয়। কোনো কোনো গাছে দ্বিতীয় বার অমৌসুমে কিছু ফুল-ফল ধরতে দেখা যায়। একটা ফলন্ত বয়স্ক গাছ থেকে বছরে ১৫০ থেকে ২৫০ কেজি ফল পাওয়া যায়। স্বাভাবিক অবস্থায় এ ফল বেশি দিন সংরক্ষণ করা যায় না। ফল পাড়ার ৭ দিনের মধ্যে বিপণন বা আহার কাজ শেষ করতে হয়। তবে ১০ থেকে ১২০ সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হলে সেলফ লাইফ আরও ৮ থেকে ১০ দিন বাড়ানো যায়।
বর্তমানে বাংলাদেশে এ ফলের বাজার মূল্য প্রতি কেজি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। নরসিংদী এবং নেত্রকোনার রামবুটান চাষি ৮ থেকে ১০ বছর বয়স্ক প্রতি গাছের ফল বিক্রি করে ৫০,০০০ থেথকে ১,০০,০০০ টাকা আয় করে আসছেন। তারা প্রতিটা ফলের বীজ ৫ থেকে ৭ টাকায় বিক্রি করেন। এ লাভজনক ফল চাষে আকৃষ্ট হয়ে অনেকেই রামবুটান ফল চাষ সম্প্রসারণে অনুপ্রেরণা পাচ্ছেন এবং এ ফল চাষ সম্প্রসারণ এদেশে বেগবান হচ্ছে।