উচ্চফলনশীল হলুদের জাত বিনাহলুদ-১
ড. মো. রফিকুল ইসলাম
মসলা হিসেবে হলুদ বাংলাদেশে খুবই জনপ্রিয়। আমাদের প্রতিদিনের রান্নায় হলুদের ব্যবহার হয় সবচেয়ে বেশী। মসলা হিসাবে ব্যবহার ছাড়াও অনেক ধরনের প্রসাধনী কাজে ও রং শিল্পের কাঁচামাল হিসাবে হলুদ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বর্তমানে দেশে মোট চাহিদার তুলনায় হলুদের ঘাটতি রয়েছে যার মূল কারণ উচ্চ ফলনশীল জাত এবং উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতির অভাব। উচ্চফলনশীল জাত এবং উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি ব্যবহার করা হলে হলুদের ফলন দ্বিগুণেরও বেশি করা সম্ভব। বাংলাদেশে টাঙ্গাইল, রাজশাহী, নওগাঁ, পাবনা, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, ময়মনসিংহ, নীলফামারী ও পার্বত্য জেলাসমূহে হলুদের ব্যাপক চাষাবাদ হয়।
উদ্ভাবনের ইতিহাস: ভারতের আসামের একটি স্থানীয় জাত হতে বিনাহলুদ-১ এর জার্মপ্লাজমটি সংগ্রহ করা হয়। সংগৃহীত জার্মপ্লাজমটি বিনা’র প্রধান কাযালয়সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থিত উপকেন্দ্রসমূহে বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ইঐখ-১ নামক কৌলিক সারিটি সনাক্ত করা হয়। পরবর্তীতে উক্ত সারিটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষকের মাঠে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ফলন সন্তোষজনক হওয়ায় জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক ২০১৯ সালে সারিটিকে বিনাহলুদ-১ নামে কৃষক পযায়ে চাষাবাদের জন্য নিবন্ধন করা হয়।
জাতটির বৈশিষ্ট্য: একটি আধুনিক উচ্চ ফলনশীল জাত, প্রচলিত জাতের তুলনায় ফলন প্রায় দ্বিগুন, গাছ লম্বা আকৃতির, পাতা গাঢ় সবুজ এবং লম্বা, পূর্ণ বয়স্ক গাছের গড় উচ্চতা ১২৫-১৩৫ সে.মি, পাতার সংখ্যা ১৬-২২ টি এবং পাতার দৈর্ঘ্য ৫৫-৬৫ সে.মি, প্রতি গাছে ছড়ার সংখ্যা ২৮-৩৫ টি। ছড়া ১২-১৫ সে.মি. লম্বা এবং ৩-৫ সে.মি. চওড়া, প্রতি গাছে হলুদের গড় ওজন ৮৫০-১০০০ গ্রাম, শাঁস আকর্ষণীয় হলুদ এবং শুষ্ক পদার্থের পরিমান শতকরা ৩৮-৪৫ ভাগ, জাতটি লিফব্লচ এবং রাইজোম রট রোগ সহনশীল। রোপনের ৩১০ দিনের মধ্যে ফলন সংগ্রহ করা যায়, সিদ্ধ করে শুকালে রং এর পার্থক্য হয় না, হেক্টর প্রতি ফলন প্রায় ৩০-৩৩ টন।
উপযুক্ত জমি ও মাটি : বেলে-দোয়াঁশ, পলি-দোয়াঁশ মাটি হলুদ চাষের জন্য উপযোগী। যে কোন ফলের বাগানের শুরুতে সাথী ফসল হিসাবে হলুদ চাষ লাভজনক। আবার সম্পূর্ণ ছায়াযুক্ত ফলের বাগানে চাষ করলে ফলন খুবই অল্প হবে, তবে অর্ধেক ছায়া অর্ধেক আলো এমন বড় ফলের বাগানে চাষ করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। মাটি গভীরভাবে ৪-৫ টি চাষ ও মই দিয়ে সমান করে জমি তৈরী করতে হবে। মাটি যাতে ঝুরঝুরে হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। শেষ চাষের আগে ফুরাডান ৫ জি হেক্টর প্রতি ২৫-৩০ কেজি করে প্রয়োগ করতে হবে। অবশ্যই সেচ ও পানি নিষ্কাষনের ভাল ব্যবস্থা থাকতে হবে।
রোপণের সময় : চৈত্র (মধ্য মার্চ থেকে মধ্য এপ্রিল) মাস কন্দ লাগানোর উপযুক্ত সময়। তবে মধ্য এপ্রিল থেকে মধ্য মে পযন্ত (বাংলা বৈশাখের শুরু থেকে শেষ পযন্ত) হলুদের কন্দ রোপণ করা যায়। রোপণের জন্য পরিপুস্ট, চকচকে ও রোগবালাই মুক্ত কন্দ নির্বাচন করতে হবে।
বীজের হার এবং বীজ শোধন: হেক্টরপ্রতি ২.০-২.৫ টন কন্দের (রাইজোম) প্রয়োজন হয়। প্রায় ৩০-৪০ গ্রাম ওজন বিশিষ্ট বীজ কন্দ থেকে ভাল ফলন পাওয়া যায়। মাতৃকন্দের স্বল্পতায় সেকেন্ডারী ফিংগার ও বীজ হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। বীজবাহিত বিভিন্ন রোগের আক্রমন থেকে রক্ষা পেতে কন্দ শোধন করে নেয়া উচিত। রোপনের ৪-৬ ঘন্টা আগে ব্যবিস্টিন/স্কোর ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে কন্দ ৩০ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে, তারপর পানি থেকে কন্দ তুলে নিয়ে ছায়ায় শুকিয়ে মূল জমিতে রোপণ করতে হবে।
রোপণ পদ্ধতি ও দূরত্ব : জমিতে ৬০ সে.মি. পরপর সারি টেনে সারিতে ২৫ সে.মি. পরপর ৫-৭ সে.মি. গভীরে বীজ কন্দ রোপণ করে মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। পানি সেচ ও নিষ্কাশনের জন্য দুই বেডের মাঝখানে ৬০ সে.মি. প্রশস্ত নালা রাখতে হবে। পরবর্তীতে দুই বেডের মাঝের নালা থেকে মাটি উঠিয়ে গাছের গোড়ায় দিতে হবে।
সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি : জমির উর্বরতার উপর সারের পরিমাণ নির্ভর করে। বিনাহলুদ-১ চাষের জন্য নিম্নোক্ত জৈব ও অজৈব সার প্রয়োগ করা হয়।
সারের নাম সারের পরিমান (কেজি) হেক্টর প্রতি মজাগোবর ৪০০০-৬০০০, ইউরিয়া ২২০-২৪০, টিএসপি ১৫০-১৭০, এমওপি ২৪০-২৬০ ও জিপসাম ১১০-১২০, জিংক সালফেট ২, বোরন ২, একর প্রতি মজাগোবর ১৫০০-২৫০০, ইউরিয়া ৯০-১০০, টিএসপি ৬০-৭০, এমওপি ১০০-১১০, জিপসাম ৪০-৫০, জিংক সালফেট ০৮, বোরন ০.৮, শতাংশ প্রতি মজাগোবর ১৫-২৫, ইউরিয়া ০.৯-১.০, টিএসপি ০.৬-০.৭, এমওপি ১.০-১.১, জিপসাম ০.৪-.০৫, জিংক সালফেট ৮-১০ গ্রাম, বোরন ৮-১০ গ্রাম
জমি পরিষ্কার করে শেষ চাষের সময় বীজ রোপণের ৭-১০ দিন আগে সম্পূর্ণ গোবর, টিএসপি, জিপসাম, বোরন এবং অর্ধেক এমওপি সার মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। ইউরিয়া সারের অর্ধেক বীজ রোপণের ৪০-৫০ দিন পর উপরি প্রয়োগ করতে হবে। অবশিষ্ট ইউরিয়া ও এমওপি সার সমান দুই কিস্তিতে রোপণের ৮০-৯০ দিন পর প্রথমবার এবং ১২০-১৩০ দিন পর দ্বিতীয়বার সারির মাঝে প্রয়োগ করে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে এবং সামান্য মাটি সারিতে তুলে দিতে হবে।
অন্তবর্তীকালীন পরিচর্যা: হলুদের জমি আগাছামুক্ত রাখতে হবে, সেক্ষেত্রে জমির অবস্থা বুঝে ৪-৫ বার আগাছা পরিস্কার করে দিতে হবে। সার উপরি প্রয়োগের সময় আগাছা পরিষ্কার করে প্রয়োগ করা ভাল। পানি নিষ্কাশন এবং রাইজোমের সঠিক বৃদ্ধির জন্য ৩-৪ বার হলুদের দুই সারির মাঝে থেকে মাটি তুলে গাছের গোড়ায় দিতে হবে এতে কন্দের বৃদ্ধি ভাল হবে। মাটি শুষ্ক হলে বীজ রোপণের পরপরই হালকা সেচ দিতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যাতে পানি কোনভাবেই জমিতে না জমে থাকে। নালা করে জমে থাকা পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। জমিতে রস সংরক্ষণ এবং তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য মালচিং (শুকনো পাতা বা খড়) দিতে হবে। এতে করে আগাছার পরিমানও কম হবে ।
রোগবালাই এবং পোকামাকড় : বিনা হলুদ-১ এ রোগবালাই এবং পোকামাকড় এর আক্রমন প্রচলিত জাতের তুলনায় অনেক কম। এ জাতটি লিফব্লচ এবং রাইজোম রট রোগ সহনশীল।
হলুদের পাতা লিফব্লচ রোগে আক্রান্ত হলে সাধারনত পাতা শুকিয়ে যায় ফলে গাছ খাদ্য উৎপাদন করতে পারেনা এবং ফলন কমে যায়। পাতার উভয় পৃষ্ঠায় প্রথমে ছোট, ডিম্বাকৃতির, চৌকোনাকৃতির বা অনিয়মিত বাদামী রঙের দাগ পড়ে। দাগগুলো দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে ও একত্রিত হয়ে সমস্ত পাতা হলুদ করে ফেলে তখন সমস্ত গাছ ঝলসানোর মত মনে হয়। এ অবস্থা হলে রোগ দেখা দেয়া মাত্রই ছত্রাকনাশক যেমন অটোস্টিন ২ গ্রাম অথবা ফলিকুর ১ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০-১২ দিন পরপর ২-৩ বার সম্পূর্ণ পাতায় ভালভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।
হলুদে রাইজোম রট বা কন্দ পচাঁ রোগের আক্রমন হলে গাছের নিচের দিকের পাতা হলুদ হতে থাকে এবং পুরো গাছ শুকিয়ে মারা যায়। গাছের গোড়ার দিকে পানি ভেজা দাগ দেখা যায়, আক্রান্ত গাছ হাত দিয়ে টান দিলে সহজেই উপরে উঠে আসে। এই রোগ ধীরে ধীরে মাটির ভিতরের রাইজোমে ছড়িয়ে পড়ে এবং রাইজোমকে নস্ট করে ফেলে। সুস্থ কন্দ বীজ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। বীজ শোধন অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
রোগ দেখা দেয়া মাত্রই ছত্রাকনাশক যেমন অটোস্টিন ২ গ্রাম অথবা ফলিকুর ১ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০-১২ দিন পরপর ৩-৪ বার গাছের গোড়ায় ভালভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে যাতে মাটিও ভিজে যায়। শস্য পর্যায় অবলম্বন করলে এবং একই জমিতে দুই বছর অন্তর অন্তর হলুদ চাষ করলে রোগ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম থাকে। থ্রিপস পোকা পাতার রস চুষে খায় বিধায় গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ফলন কমে যাবে। পোকা আকৃতিতে খুব ছোট। এদের পিঠের উপর লম্বা দাগ থাকে। এরা রস চুষে খায় বলে আক্রান্ত পাতা রূপালী রং ধারণ করে। আক্রান্ত পাতায় বাদামী দাগ বা ফোঁটা দেখা যায়। অধিক আক্রমণে পাতা শুকিয়ে যায় ও ঢলে পড়ে। সাদা রঙের আঠালো ফাঁদ ব্যবহার করে এ পোকা দমন করা যায়। অনুমোদিত কীটনাশক যেমন-সুমিথিয়ন ৫০ ইসি ২ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১৫ দিন পর পর স্প্রে করে এ পোকা দমনে রাখা যায়।
ফসল সংগ্রহ : গাছের উপরের অংশ সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেলে সাধারনত বপনের ৩১০-৩২০ দিনের মধ্যে ফলন সংগ্রহ করা যায়। ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি থেকে মার্চ মাসের শেষ পযন্ত উপযুক্ত সময়। কোদাল দিয়ে কুপিয়ে মাটি আলগা করে হলুদের কন্দ সংগ্রহ করতে হবে তবে খেয়াল রাখতে হবে যাতে কন্দ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। কন্দ ভালভাবে পরিস্কার করে ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে। একে কিউরিং বলে। সাধারনত ২-৩ দিনে উত্তোলিত হলুদের কিউরিং করে বীজ হিসাবে সংরক্ষণ বা খাওয়ার জন্য সিদ্ধ করে প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হয়।
ফলন : উপযুক্ত পরিচযা পেলে এ জাতটি হেক্টরপ্রতি ৩০-৩৩ টন ফলন দিতে পারে।
হলুদ সংরক্ষণ: মাঠ থেকে সংগ্রহের পর সতেজ ও রোগমুক্ত রাইজোম পরিষ্কার করে সংরক্ষণের জন্য নির্বাচন করতে হবে। গর্ত খনন করে হলুদ রাখলে রাইজোমের আর্দ্রতা ও সতেজতা বজায় থাকে, ফলে বাজার মূল্য সঠিক থাকে। খড়ের চালাযুক্ত মেঝেতে ট্রেন্স বা গর্ত তৈরী করে শুকনো বালি (১.৫-২ ইঞ্চি) দিয়ে তার উপর হলুদের কন্দ বা রাইজোম (৮-১০ ইঞ্চি পুরু স্তর) বিছিয়ে দিতে হবে। এরপর বিছিয়ে দেওয়া কন্দের উপরে প্রথমে সবুজ পাতা ও পরে বালির আস্তরণ (২ ইঞ্চি) দিয়ে পুরো গর্ত ভালভাবে ঢেকে দিতে হবে। অবশ্যই ঘরের ভেতর পযাপ্ত বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা থাকতে হবে। বীজের পরিমাণ বেশি হলে এ পদ্ধতি অনুসরণ করে স্তরে স্তরে রাখা যেতে পারে ।
লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং বিভাগীয় প্রধান, উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ, বিনা।