নতুন কারিকুলামে মূল্যায়নের মূল ভিত্তি হবে যোগ্যতা
শরীফ শাওন : প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাক্রমের সামঞ্জস্যতা রেখে তৈরি করা হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম। ২০২৩ সাল থেকে বিভিন্ন স্তরে তা বাস্তবায়ন করা হবে। কারিকুলাম মতে, শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের মূল ভিত্তি হবে যোগ্যতা। নতুন কারিকুলামে শুধু শিখন মূল্যায়নে সিমাবদ্ধ না থেকে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার কার্যকরিতা মূল্যায়ন ও শিখন পরিবেশের মূল্যায়নকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে । বহুমাত্রিক মূল্যায়নে যা থাকবে, যোগ্যতার মূল্যায়ন, শিখনের জন্য শিখনকালীন মূল্যায়নে গুরুত্ব, স্ব-মূল্যায়ন, সতীর্থ মূল্যায়ন, মূল্যায়নে অভিবাবক ও সমাজের সম্পৃক্ততার ওপর গুরুত্ব আরোপ, মুখস্ত নির্ভও সামষ্টিক মূল্যায়ন হ্রাস। শিখন অগ্রগতি মূল্যায়নের ধারাবাহিক রেকর্ড সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা।
কারিকুলামে বলা হয়, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কারণে দ্রুত জীবন জীবিকার পরিবর্তন ঘটছে। প্রচলিত পেশার ৩ ভাগের ২ ভাগ ২০৩০ সালের মধ্যে বিলুপ্ত হবে। ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী যারা এখনো প্রাথমিক শিক্ষায় আছে তাদের কর্মক্ষেত্র নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে। এসকল দিক বিবেচনা করে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পদার্পণের লক্ষ্য নিয়ে কারিকুলাম পরিবর্তন করা হয়েছে।
খসড়া অনুযায়ী, দশম শ্রেণি পর্যন্ত কোন বিভাগ থাকবে না। নবম ও দশম শ্রেণিতে জীবন ও জীবিকা বিষয়ে বাধ্যতামূলক কৃষি, সেবা শিল্প খাতের একটির কর্মক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করবে। দশম শ্রেণি শেষে যেকোন একটি অকুপেশনে কাজ করার মতো পেশাদারি দক্ষতা অর্জন করবে। এছাড়াও প্রাথমিকে ৮টি বিষয় এবং মাধ্যমিকের অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ১০টি বিষয় থাকবে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ৩টি আবশ্যিক বিষয় থাকবে। শিক্ষার্থীদের আগ্রহ অনুযায়ী যে কোন ৩টি নৈর্বাচনিক বিষয় নেওয়া যাবে। পেশাদারি দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্ঝনে নির্বাচিত বিষয় থেকে যে কোন একটি বিষয় নেওয়ার সুযোগ থাকবে।
বিষয়ভিত্তিক যোগ্যতায় শিক্ষার্থীরা, প্রমিত বাংলা ভাষায় ভাব আদান প্রদানে মৌলিক দক্ষতা অর্জন করবে ওসাহিত্যপাঠে আনন্দ লাভে সমর্থ হবে। বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে সৃজনশীল ও শৈল্পিকভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে পারা, ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং বৈশি^ক প্রেক্ষাপটে কার্যকর ও কল্যাণমুখী যোগাযোগে সমর্থ হওয়াকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। রূপরেখায় মূল পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে পরীক্ষা মুখস্তনির্ভর পড়াশোনার পরিবর্তে পারদর্শিতাকে গুরুত্বারোপ, পরীক্ষার চাপ কমাতে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির আলাদা পাবলিক পরীক্ষা। মুখস্ত নির্ভরতা কমাতে ও পারদর্শিতা অর্জনে ধারাবাকি মূল্যায়ন। সপ্তাহে দুদিন ছুটি, বিদ্যালয়ের বাইরেও পারিবারিক ও সামাজিক পরিসরে অনুশীলন। অভিন্ন মূল্যায়ন ও দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনের জন্য বিশেষায়িত বিষয় সংযুক্তকরণ।
শিক্ষার্থীদের শিখন সময়ে জানানো হয়, ওইসিডি ও সহযোগী দেশগুলোতে গড় কর্মদিবস ১৮৫ ঘন্টা এবং ইউরোপিয়ান ২৩টি দেশে বাৎসরিক গড় কর্মদিবস ১৮১ দিন। এরই প্রেক্ষিতে প্রস্তাবিত কর্মদিবস আন্তর্জাতিক মানদ-ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে মোট কর্মদিবস ১৮৫ দিন করা হয়েছে। প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে শিখন সময় হবে ৫০০ ঘন্টা, প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ৬৩০, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে ৮৪০, ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে ১০৩০, নবম ও দশম শ্রেণিতে ১১০০ এবং একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ১১৫০ ঘন্টা। শুধু জাতীয় দিবসগুলোতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা থাকবে এবং শিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীরা দিবসটি পালন করবে।
কারিকুলাম পরিবর্তনের পেক্ষাপটে জানানো হয়, দক্ষিণ এশিয়াতে শ্রীলংকা, ভুটান এবং সম্প্রতি ভারত তাদের শিক্ষানীতিতেও এই পরিবর্তন এনেছে, অন্যরাও প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। ওইসিডি তার ৩৭টি সদস্য দেশ ও সহযোগী দেশে শিক্ষা রূপরেখা ২০৩০ প্রণয়ন করেছে যেখানে এই পরিবর্তনকে গ্রহণে সুপারিশ করেছে। ১০২টি দেশের শিক্ষাক্রম বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৫১টি দেশ ইতোমধ্যে শিক্ষাক্রমকে দক্ষতা ও যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমে রূপান্তর করেছে।
নতুন কারিকুলামের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা অর্জনের লক্ষ্য ধরা হয়েছে, অন্যের অবস্থানকে সম্মান করে নিজের মতামত সৃজনশীলভাবে প্রকাশ করতে পারা। যেকোন ইস্যুতে যৌক্তিক ও সর্বোচ্চ কল্যাণকর সিদ্ধান্ত নিতে পারা। নিজের সংস্কৃতি রক্ষা করে বিশ^ নাগরিকের যোগ্যতা অর্জন। সমস্যার প্রক্ষেপণ, দ্রুত অনুধাবন, বিশ্লেষণ, সংশ্লেণ এবং ভবিষ্যৎ তাৎপর্য বিবেচনা করে যৌক্তিক ও সর্বোচ্চ কল্যাণকর সিদ্ধান্ত নিতে ও সমাধান করতে পারা। পারস্পরিক সহযোগিতা, সম্মান ও সম্প্রীতি বজায় রেখে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মাধ্যমে নিরাপদ বাসযোগ্য পৃথিবী তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারা। গাণিতিক, বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা ব্যবহার করে সমাধান করতে পারা।
মুখস্তের পরিবর্তে অভিজ্ঞতা ও কার্যক্রমভিত্তিক শিখন ব্যবস্থাকে বিবেচনায় নিয়ে কারিকুলাম তৈরি করা হয়েছে। শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক ও আনন্দময় শিখন পরিবেশ তৈরি, বিষয় ও পাঠ্যপুস্তকের বোঝা কমানো, গভীর শিখনে গুরুত্ব, খোলাধুলা ও সৃজনশীল কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষা, বাড়ির কাজ কমিয়ে শ্রেণিকক্ষে পাঠ ও শিখন-শেখানো শেষ করা এবং জীবন জীবিকার সঙ্গে সম্পর্কিত শিক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
শিখন শেখানো কৌশল অভিজ্ঞতামূলক হবে। পাঠ্য হবে, প্রয়োজনয়ীতা অনুযায়ী হাতে কলমে শিখন, প্রকল্প এবং সমস্যাভিত্তিক শিখন, সহযোগিতামূলক শিখন, অনুসন্ধানমূলক শিখন, স্ব-প্রণোদিত শিখনের সংমিশ্রণ. অনলাইন ভিত্তিক শিখনের সংমিশ্রণ, শিখন পরিবেশ একীভূত ও অন্তর্ভূক্তিমূলক, শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক , গণতান্ত্রিক ও সহযোগিতামূলক। যেখানে শিক্ষক সহায়তাকারী এবং শিক্ষার্থী সক্রিয় অংশগ্রহনকারীর ভূমিকা পালন করবে।