স্বজনদের আহাজারিতে ভারী চট্টগ্রাম হাসপাতাল সীতাকুন্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণ ৯ ফায়ারকর্মীসহ নিহত ৪৯, আহত ৪ শতাধিক
শোভন দত্ত: চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা রোববার বিকেল পর্যন্ত ছিল ৪৯ জন। এ ঘটনায় ৪ শতাধিক দগ্ধ ও আহত হয়েছেন। তবে আহতদের মধ্যে ৪০-৫০ জনের অবস্থা গুরুতর। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের সহকারী পরিচালক রাজীব পালিত বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
স্থানীয়রা জানায়, শনিবার রাত ১০টার দিকে সীতাকু-ের সোনাইছড়ি ইউনিয়নের শীতলপুর এলাকায় অবস্থিত বিএম কন্টেইনার ডিপোতে (সাবেক কাশেম জুট মিল) লোডিং পয়ন্টের ভেতরে আগুন লাগে। প্রথমে কুমিরা ও সীতাকু- ফায়ার সার্ভিসের ৪টি ইউনিট আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। পরে রাত পৌনে ১১টার দিকে এক কনটেইনার থেকে অন্য কনটেইনারে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। হঠাৎ একটি কনটেইনারে রাসায়নিক থাকায় বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে পুলিশের সদস্য, ফায়ার সার্ভিসের সদস্য ও শ্রমিকসহ ৪ শতাধিক মানুষ দগ্ধ ও আহত হন।
আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে রোববার বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের নয় কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন। তিনি শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন।
ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (মিডিয়া সেল) মো. শাহজাহান শিকদার জানান, ভয়াবহ অগ্নি দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলে পৌঁছেছেন মহাপরিচালক। তিনি নিজে থেকে সার্বিক খোঁজ-খবর ও তদারকি করছেন। শোককে শক্তিতে পরিণত করতে ঢাকা থেকে সুদক্ষ ২০ জনের টিমকে তিনি দুর্ঘটনাস্থলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। ফায়ার সার্ভিসের ২০ জনের বিশেষ হ্যাজম্যাট টিম চট্টগ্রামে যাচ্ছে। হ্যাজম্যাট (হ্যাজারডাস মেটারিয়াল) টিমে এসব সদস্য দেশে-বিদেশে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত।
সংশ্লিষ্টরা জানান, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসের সদস্য ও শ্রমিকসহ ৪০-৫০ জনের বেশি মানুষকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চট্টগ্রাম, ফেনী ও কুমিল্লা থেকে ফায়ার সার্ভিসের মোট ২৫টি টিম এসে আগুন নেভানোর চেষ্টা চালায়। কিন্তু রোববার সকাল পৌনে ১১টা পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। বিস্ফোরণে আশপাশের ঘরবাড়ি ও মসজিদের কাচের দরজা-জানালা ভেঙে যায়। এমনকি শিশুরাও বিস্ফোরণের বিকট শব্দে কেঁদে ওঠে।
সীতাকু- থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সুমন বণিক বলেন, বিস্ফোরণে থানার কনস্টেবল তুহিনের এক পা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এছাড়া থানার আরো অন্তত পাঁচ কনস্টেবল, ফৌজদারহাট পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) মোতাহার হোসেন ও শিল্প পুলিশের একাধিক সদস্য আহত হয়েছেন।
চমেক মেডিক্যাল পুলিশ ফাঁড়ির উপ-পরিদর্শক (এসআই) নুরুল আলম বলেন, হতাহতদের মধ্যে ডিপোর শ্রমিকদের পাশাপাশি পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরাও রয়েছেন।
তথ্যমতে, ওই ডিপোতে ৫০ হাজারের বেশি কনটেইনার রয়েছে। কেমিক্যাল কনটেইনার থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে ধারণা করা হচ্ছে। এদিকে অগ্নিদগ্ধদের জরুরি চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রামের সব চিকিৎসকের ছুটি বাতিল
করা হয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে সীতাকুন্ডে অগ্নিকা-ের ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য। বেসরকারি হাসপাতালসহ সব হাসপাতাল প্রস্তুত রয়েছে আহতদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য।
চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ শামীম আহসান বলেন, ছুটিতে থাকা সব চিকিৎসক-নার্সকে জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে আনা হয়েছে। তবে এতোসংখ্যক রোগীকে চিকিৎসা দেয়ার মতো পর্যাপ্ত ওষুধেরও সংকট রয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে ওষুধ, স্যালাইন, পেইন কিলার প্রয়োজন।
বিস্ফোরণের ঘটনা তদন্তে ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রধান করা হয়েছে পরিচালক (প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) লে. কর্নেল মো. রেজাউল করিম, পিএসসিকে এবং সদস্য সচিব করা হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগের উপপরিচালক মো. আনিসুর রহমানকে।
অন্যান্যরা হলেন- শামস আরমান (প্রশিক্ষক, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, টিসি, মিরপুর), জহিরুল ইসলাম (সিনিয়র স্টেশন অফিসার, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশন, ইপিজেড, সাভার), মো. ওমর ফারুক ভূঁইয়া, ওয়ারহাউজ ইন্সপেক্টর, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স চট্টগ্রাম)।
ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রামের উপপরিচালক আনিসুর রহমান বলেন, কনটেইনার ডিপোটিতে হাইড্রোজেন পারক্সাইড নামে বিপুল পরিমাণ কেমিক্যাল রয়েছে। তবে ঠিক কী কারণে বিস্ফোরণ ঘটলো, তা এখনো জানা যায়নি। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চলছে। কিন্তু কাছাকাছি যাওয়া যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পরপর ভেতর থেকে বিস্ফোরণের শব্দ আসছে। রাসায়নিক এখন আশপাশের ড্রেনে ছড়িয়ে পড়েছে। রাসায়নিক যেনো আশপাশে জলাধার ও সমুদ্রে আরো ছড়িয়ে না পড়ে সে ব্যাপারে কাজ চলছে। বালুর বস্তা দিয়ে ড্রেন আটকে দেয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হাতে একটি ছবি হাতে বড় ভাই আবুল হাশেমকে (৪৫) খুঁজছিলেন মো. রাসেল। তিনি গতকাল রাত ২টা থেকে চট্টগ্রামের সরকারি-বেসরকারি বহু হাসপাতালে ছুটোছুটি করেছেন। তবু ভাইয়ের সন্ধান মেলেনি।
রাসেল জানান, তার ভাই সীতাকু-ের বিএম কনটেইনার ডিপোতে ১৫ বছর কাজ করেছেন। ডিপোতে কাভার্ডভ্যান চালক হিসেবে কাজ করেন তিনি। গতকাল রাত ৯টার দিকে সর্বশেষ স্ত্রীর সঙ্গে তার কথা হয়। এর পর থেকে তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
ডিপোতে আগুন লাগার খবর পাওয়ার পরই ভাইয়ের সন্ধানে বের হন মো. রাসেল। ডিপো থেকে দগ্ধদের উদ্ধার করে চট্টগ্রামের যেসব হাসপাতালে আনা হয়েছে তার সবগুলোতে ভাইকে খুঁজেছেন তিনি।
রোববার বেলা ৩টার দিকে চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে ভাইয়ের ছবি হাতে রাসেলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তিনি বলেন, রাত থেকে হাসপাতালে হাসপাতালে খুঁজছি। কোথাও ভাইকে পাচ্ছি না। জীবিত হোক, মৃত হোক আমার ভাইকে ফিরিয়ে দিন।
তিনি আরও জানান, আবুল হাশেম সীতাকু-ের কুমিরায় তার পরিবার নিয়ে বসবাস করত। বাড়িতে তার দুই মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে।