সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক চ্যালেঞ্জিং : সিপিডি
সোহেল রহমান: বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির প্রেক্ষাপটে বাণিজ্য ও বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবে ঘাটতি, মুদ্রা বিনিময় হারে অস্থিরতা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ ইত্যাদি কারণে দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠেছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারকে বিচক্ষণ রাজস্ব ও আর্থিক নীতি অনুসরণ এবং অবিলম্বে ও মধ্যমেয়াদী পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ‘সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ’ (সিপিডি)।
যার মাধ্যমে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে উচ্চতর ভর্তুকি এবং প্রণোদনার চাহিদা পূরণ হবে, অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ পরিস্থিতির উন্নতি হবে, অভ্যন্তরীণ চাহিদা হ্রাস না করে সরকারি অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে আনা, বেসরকারি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা এবং দরিদ্রদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা। রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি ২০২১-২২’-এর তৃতীয় পর্যায়ের মূল্যায়নে এসব অভিমত ব্যক্ত করেছে সিপিডি। সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন মূল্যায়ন উপস্থাপন করেন।
সিপিডি বলেছে, ২০২০ সালের গোড়ার দিকে কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবের সাথে শুরু হওয়া দরিদ্র এবং নি¤œ-আয়ের গোষ্ঠীর লড়াই এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দামের লাগামহীন বৃদ্ধির কারণে আরও খারাপ হয়েছে। মূল্যবৃদ্ধির চাপ ক্রমাগত বাড়তে থাকায় এই লোকেরা এখনও তাদের সীমিত বাজেটের সাথে লড়াই করছে। এটি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করছে কারণ মানুষের একটি বড় অংশ এখনও ভাসতে থাকার জন্য সংগ্রাম করছে।
সংস্থাটি বলেছে, পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট হিসেবে গত এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি ৬.২৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যা ১৮ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। মার্চে এটি ছিল ৬.২২ শতাংশ। উচ্চ মূল্যস্ফীতি ন্যূনতম মজুরি অর্জনকারী শ্রমিকদের খাদ্য নিরাপত্তাকে সরাসরি হুমকির মুখে ফেলছে। এমতাবস্থায় অবিলম্বে সমস্ত শিল্পে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি পুনর্বিবেচনা ও সংশোধন করা জরুরি।
সিপিডি বলেছে, যদিও বর্তমান মূল্যবৃদ্ধি মূলত উচ্চ আমদানি ব্যয়ের কারণে, তবে কিছু প্রভাবশালী খেলোয়াড় দ্বারা বাজারের বিকৃতির মতো দেশীয় কারণগুলিও দায়ী। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অবিলম্বে সমস্ত আমদানি করা প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রীর অগ্রিম আয়কর, অগ্রিম কর এবং নিয়ন্ত্রক শুল্ক অপসারণের বিষয়ে বিবেচনা করা উচিত। সয়াবিন তেলের দাম যাতে আরও বাড়তে না পারে সেজন্য সরকার সম্প্রতি
সয়াবিন তেলের ওপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছে। সম্ভবত বর্তমান হারে মূল্যস্ফীতি অব্যাহত থাকলে সরকার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের উপরও অন্যান্য পরোক্ষ কর প্রত্যাহার করতে বাধ্য হতে পারে। অন্তত ২৯টি আমদানি করা প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী বর্তমানে ট্যাক্সের উচ্চ প্রকোপের সম্মুখীন। সংস্থাটি বলেছে, পাশাপাশি নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের বাজারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের ভূমিকা জোরদার করা দরকার। কমিশনের উচিত একটি ডাটাবেস তৈরি করা, নিয়মিত বাজারের প্রভাবশালী খেলোয়াড়দের ক্রিয়াকলাপ পর্যবেক্ষণ করা, বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং ম্যানিপুলেশন (যদি থাকে) পরীক্ষা করা এবং যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া।
সিপিডি আরও বলেছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি সরকারের অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহের পদ্ধতির অন্তর্নিহিত দুর্বলতা প্রকাশ করেছে, যা মূলত পরোক্ষ কর থেকে রাজস্ব সংগ্রহের উপর নির্ভরশীল। রাজস্ব নীতি যা পরোক্ষ করের উপর অত্যন্ত নির্ভরশীল তা সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রচার করে এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির মুখে সরকারকে রাজস্ব উৎপাদন বন্ধ করতে বাধ্য করে। রাজস্ব সংগ্রহের চলমান প্রবণতা বজায় থাকলে চলতি অর্থবছরে রাজস্ব সংগ্রহের বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না। সেক্ষেত্রে রাজস্ব ঘাটতি প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা দাঁড়াতে পারে। অন্যদিকে ভর্তুকি এবং সুদ প্রদানের কারণে পরিচালন ব্যয় বাড়তে পারে এবং আগামী বছরেও তা ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।