দক্ষিণের জলাঞ্চলে নৌকার হাট
অর্থনীতি ডেস্ক : ধান-নদী আর খাল এ নিয়ে বরিশাল। বর্ষার মৌসুমকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলের মরা খালটিও এখন কানায় কানায় পরিপূর্ণ। এ বছর বর্ষা মৌসুম শুরুর আগেই চলছে অঝোর বৃষ্টি। এ কারণে দক্ষিণাঞ্চলের সর্বত্র এখন পানিবেষ্টিত। বরিশালের এমনও অঞ্চল আছে, যেখানে এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি যেতে নৌকা লাগে। তার ওপর আসন্ন পেয়ারা, সবজি ও অন্যান্য ফসল গ্রামীণ হাটবাজারে বেচার জন্য নৌকাই একমাত্র বাহন। মালবোঝাই ছোট ছোট ডিঙা এখন এ অঞ্চলের খালগুলোতে হাট ধরতে ছুটছে প্রতিদিন।
এ দৃশ্য মনে করিয়ে দেয় রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাসের কবিতার সেই পঙক্তি রূপসার ঘোলা জলে কিশোর এক সাদা ছেঁড়া পালে ডিঙা বায়। নৌকা আর বর্ষার থইথই জল প্রকৃতির নৈসর্গিক পরিবেশের তৈরি করে। এ মৌসুমকে কেন্দ্র করে নৌকা এনেছে শত শত মানুষের জীবন-জীবিকার পথ। দক্ষিণাঞ্চলে সবচে বড় নৌকার হাট আটঘরে এখন কেনাবেচার ধুম পড়ে গেছে।
বর্ষার জলে দক্ষিণাঞ্চলের নদী, খাল, বিল, ডোবা-নালা পানিতে কানায় কানায় ভরপুর থাকে নদীমাতৃক আমাদের এ দেশ। আবহমান কাল থেকে নৌকাই বর্ষার গণমানুষের প্রধান বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সেই ধারাবাহিকতায় এবারে বর্ষার শুরু থেকেই গ্রামাঞ্চলে নতুন নৌকা তৈরি ও পুরনো নৌকা মেরামতের হিড়িক পড়েছে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে।
নদী-নালা, খাল-বিল পরিবেষ্টিত দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের কাছে নৌকার কদর বেড়ে যায়। আর সাধারণ মানুষের ব্যাপক চাহিদার প্রেক্ষিতেই পিরোজপুর জেলার সন্ধ্যা নদীর শাখা খালগুলোকে কেন্দ্র করে এ হাটগুলো জমে ওঠেছে। উল্লেখযোগ্য ভাসমান হাটগুলো হল ঝালকাঠি জেলার সীমান্ত সংলগ্ন পিরোজপুরের আটঘর, কুড়িয়ানা এবং ইন্দ্রপাশার নৌকার হাট। সপ্তাহের দুদিন সোম ও শুক্রবার এ হাট বসে। এ হাটে বিক্রির জন্য পার্শ্ববর্তী স্বরূপকাঠি, বানাড়ীপাড়া, নাজিরপুরসহ বিভিন্ন উপজেলার ছুতাররা তাদের তৈরি ডিঙ্গা (ছোট নৌকা) নিয়ে এখানে আসতে শুরু করেন। ক্রেতারা আসেন সকাল থেকেই। সারাদিন চলে বিকিকিনি। চাম্বল, রেইনট্রি, কড়াই প্রভৃতি দেশি কাঠ দিয়ে তৈরি এসব নৌকার প্রতিটির দাম পড়ে দুই হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত।
সাইজ এবং গড়ন ভেদে এসব নৌকার দামও ভিন্ন ভিন্ন। এক কিংবা দুজন যাত্রী ধারণক্ষমতা সম্পন্ন নৌকার দাম এক থেকে দেড় হাজার টাকা। এ ধরনের একটি নৌকা তৈরিতে একজন ছুতারের দেড় থেকে দুদিন সময় লাগে। এ ধরনের একটি নৌকা বিক্রি করে ৩০০ টাকার বেশি লাভ হয় না। কাঠ, পেরেকসহ নৌকা তৈরির কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় নৌকা তৈরি করে আগের মতো লাভ হয় না বলে জানালেন নৌকা বিক্রি করতে আসা বিপ্লব গাইন। তবে ৮-১০ জন যাত্রী ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এক একটি নৌকা তৈরি করে দেড় থেকে দু’হাজার টাকা লাভ করা যায়। অবশ্য এ ধরনের নৌকা তৈরিতে সময় এবং শ্রম দুটোই বেশি লাগে। মূলত ক্ষেতে যাওয়া আসা, মাছ ধরা, পেয়ারা তোলা, এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যাতায়াত, হাটে সবজি বিক্রি করাসহ অন্যান্য সবজি সংগ্রহের কাজেই এসব নৌকা ব্যবহৃত হয়। স্বল্পমূল্যের এসব নৌকার স্থায়িত্ব এক মৌসুম থেকে দু’মৌসুমের বেশি নয়।
বর্ষা মৌসুমে বৃহত্তর বরিশালে নৌকার কদর বেশি থাকে। নৌকার দেশ হিসেবে পরিচিত জেলাগুলো হলো ঝালকাঠি, বরিশাল এবং পিরোজপুরে বিলাঞ্চল। বছরের অন্যান্য সময় নৌকার চাহিদা তুলনামূলকভাবে কম থাকলেও বর্ষা মৌসুম আসার সঙ্গে সঙ্গে এ এলাকার ছুতারদের ব্যস্ততা বেড়ে যায় অনেক গুণ। কারণ বরিশালের গ্রামাঞ্চলের মানুষ বর্ষা মৌসুমে পুরোপুরি নৌকানির্ভর হয়ে পরে। এই অঞ্চলের অর্থাৎ এমন অনেক গ্রামও এ অঞ্চলে রয়েছে যেখানে বর্ষা মৌসুমে নৌকা ছাড়া ঘর থেকে বেরোনোও প্রায় অসম্ভব।
বরিশালের বিভিন্ন জেলা থেকে নৌকা সংগ্রহের জন্য খুচরা ক্রেতারা তো বটেই, পাইকারি ক্রেতারাও আটঘর হাটে আসেন। এখান থেকে নৌকা সংগ্রহ করে সরবরাহ করেন বিভিন্ন এলাকায়। নৌকা তৈরির কারিকর বা মিস্ত্রিরা এ অঞ্চলে ছুতার নামে পরিচিত। এরা বিভিন্ন হাট থেকে রেইনট্রি, সুন্দরী, চাম্বল, মেহগনিসহ বিভিন্ন জাতের কাঠ সংগ্রহ করে মিলে চেড়াই করে বাড়ি নিয়ে দিন রাত খেটে তৈরি করেন ছোট বড় নানা ধরনের নৌকা। ডোঙ্গা, পেনিস, বজরা, পানসি, ডিঙ্গি, ডিঙ্গা, ছিপ, কোষা ইত্যাদি কত বাহারি নাম এসব নৌকার।
ঝালকাঠির সীমান্তবর্তী আটঘরের নৌকার হাটে গিয়ে দেখা গেছে নৌকা ব্যবসায়ীরা রাস্তার ওপরে এবং খালে নৌকার এক বিশাল আড়ত গড়ে তুলেছে। এর পাশেই কারিগররা ব্যস্ত বিকিকিনিতে। বাড়িতে নৌকা তৈরির পর একটির ওপর আর একটি নৌকা সাজিয়ে ট্রলারে করে বিক্রির জন্য আনা হচ্ছে। ছুতারদের ভাষ্যমতে কাঠ, পেরেক এবং ক্লামের মূল্য মিলিয়ে প্রতিটি নৌকার নির্মাণ ব্যয় বর্তমান বাজরে অনেক বেশি।
আটঘর-কুড়িয়ানা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মিঠুন হালদার বলেন, নৌকা শিল্পের সঙ্গে ঝালকাঠি ও পিরোজপুরের ৫ হাজারেও বেশি পরিবারের জীবিকা চলে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া গেলে এ শিল্পকে আরও অনেক দূর নিয়ে যাওয়া সম্ভব। সূত্র : সময়টিভি অনলাইন