যুক্তরাজ্য ইইউর সঙ্গে সংঘাতে গেলে ফল হবে ভয়াবহ
অর্থনীতি ডেস্ক : ২০১৯ সালে যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে জেতার আগে ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কনজারভেটিভরা। এর কিছুদিনের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বেরিয়ে যায় দেশটি। কিন্তু সেই চুক্তি এখন হুমকির মুখে রয়েছে, আর তা হচ্ছে কনজারভেটিভদের কারণেই।
গত ১৩ জুন ব্রিটিশ সরকার একটি বিল উত্থাপন করেছে, যা তাদের নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড প্রোটোকলের একটি বড় অংশ পরিবর্তনের ক্ষমতা দেবে। চুক্তির এই অংশটি নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডকে (গ্রেট ব্রিটেন নয়) এখনো ইইউ’র একক পণ্য বাজারে ধরে রেখেছে। প্রোটোকল অনুসারে, আয়ারল্যান্ড দ্বীপের মধ্যে কোনো সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ থাকবে না, এর বদলে আইরিশ সাগরে শুল্ক ও নিয়ন্ত্রণ সীমা প্রতিষ্ঠা হবে।
যুক্তরাজ্য-ইইউর মধ্যে শান্তিরক্ষা ও সুষ্ঠু বাণিজ্যিক কার্যক্রমের জন্য নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড প্রোটোকল মেনে চলা যে আবশ্যক, তাতে সন্দেহ নেই। তবে এর মাধ্যমে যুক্তরাজ্যের মূল ভূখ- থেকে নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডে পণ্য পরিবহনে প্রচুর আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তৈরি হয়েছে। যেমন- আইরিশ সাগরের ওপারে গরুর মাংসের স্বাদযুক্ত চটপটি পাঠাতে হলেও এখন একজন পশুচিকিৎসকের ছাড়পত্রের প্রয়োজন হয়। এ ধরনের জটিলতা শুধু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বা ভোক্তাদেরই সমস্যায় ফেলছে না, প্রোটোকলটি নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের বৃহত্তম ইউনিয়নপন্থি দল ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নিস্ট পার্টি (ডিইউপি) থেকেও তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়েছে। এই সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত সর্বদলীয় সরকারে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে ডিইউপি। যদিও প্রদেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যরা (এমপি) প্রটোকল রাখার পক্ষে, তবে নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জাতীয়তাবাদী ও ইউনিয়নবাদী উভয়ের ঐক্য প্রয়োজন।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন যদিও বলেছেন, নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড প্রোটোকলের বিতর্কিত অংশগুলো পরিবর্তনের জন্য তারা ‘প্রস্তুত’। তবে এতে দেশটির সুনাম ক্ষুণ্ন হওয়াসহ ব্যাপক ক্ষতির ঝুঁকি রয়েছে। প্রথমেই বলা যায়, আইনের প্রতি অনুগত রাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাজ্যের খ্যাতি বিনষ্ট হবে এই পদক্ষেপের মাধ্যমে।
ব্রিটিশ সরকার প্রোটোকলের অংশগুলো পরিবর্তনকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য ‘প্রয়োজনীয়তার মতবাদ’ তুলে ধরছে। এই মতবাদ রাষ্ট্রগুলোকে আপন স্বার্থরক্ষায় ‘গুরুতর ও আসন্ন বিপদ’ মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘনের অনুমতি দেয়। এভাবে প্রোটোকল সংশোধনকে আইনি বৈধতা দেওয়ার জন্য সবধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাজ্য সরকার, তবে তাদের সামনে অন্য সমস্যাও রয়েছে।
নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের রাজনীতি অনেকটাই ভঙ্গুর, গত পাঁচ বছরের মধ্যে প্রায় তিন বছর কোনো হস্তান্তরিত সরকার ছাড়াই চলছে প্রদেশটি। এ অবস্থায় ব্রিটিশ সরকার প্রটোকলের কার্যক্রম স্থগিত করার জন্য ১৬ ধারা প্রয়োগ করতে পারতো। কিন্তু তার পরিবর্তে দেশটি তুচ্ছ আইনি ভিত্তির ওপর একটি চুক্তির প্রতিশ্রুতি একতরফাভাবে বাতিলের পরিকল্পনা করেছে।
যুক্তরাজ্যের জন্য এটি শুধু লজ্জাজনকই নয়, আত্মপরাজয়ও বটে। বরিস জনসনের সরকার বলছে, তারা প্রোটোকল পুনর্বিবেচনা করতে চায়। কিন্তু দ্বিপাক্ষিক আলোচনা হয় মূলত পারস্পরিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে। এখন যুক্তরাজ্যের কাছে নতি স্বীকার করার পরিবর্তে ইইউ’র অবস্থান আরও কঠোর হবে। তারা এরই মধ্যে যুক্তরাজ্যের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে।
তাছাড়া বিলটি যুক্তরাজ্যের অভ্যন্তরেই বিরোধিতার মুখোমুখি হবে, বিশেষ করে মধ্যপন্থি কনজারভেটিভ এমপি এবং হাউস অব লর্ডস থেকে। তাতে সেটি আদতে পাস হবে কি না তা নিয়েই সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
এই ইস্যুতে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্পর্ক কতটা খারাপ হবে তা বলা অসম্ভব, তবে ক্ষতির ঝুঁকি ব্যাপক। ইইউ’র হরাইজন ইউরোপ গবেষণা কার্যক্রমে ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের অংশগ্রহণ হুমকির মুখে পড়েছে, একটি বাণিজ্যযুদ্ধও অসম্ভব কিছু নয়। ক্ষমতার ভারসাম্য কখনোই ক্ষুদ্র অর্থনীতির পক্ষে যায় না।
গত এপ্রিলে যুক্তরাজ্যের জিডিপি সংকুচিত হয়েছে এবং তাদের এই সমস্যা চলছে অনেকদিন থেকেই। ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়া ব্রিটিশ অর্থনীতিতে তেমন কোনো সাহায্য করেনি। সেন্টার ফর ইউরোপিয়ান রিফর্ম নামে একটি থিংক-ট্যাংকের অনুমান, ২০২১ সালের শেষ প্রান্তিকে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি যে অবস্থায় ছিল, ব্রেক্সিট না হলে তার চেয়ে অন্তত ৫ দশমিক ২ শতাংশ বড় থাকতো। এখন নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড প্রোটোকল পরিবর্তনের বিল উত্থাপন করার মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার দেশটিতে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
অবশ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নও পুরোপুরি নিষ্পাপ নয়। আগে ওষুধ নীতি শিথিল করার মতো নানা বিষয়ে নমনীয়তা দেখিয়েছে তারা। সেটি আবার করতে পারতো। কিন্তু এখন সংকটের বাস্তবসম্মত সমাধানের সম্ভাবনা অনেকটাই কমে গেছে এবং এর দায় লন্ডন সরকারের।