২০২২ সালে বিশ্বজুড়ে রেমিট্যান্সপ্রবাহ গত বছরের চেয়ে ৪ দশমিক ২ শতাংশ বাড়বে
অর্থনীতি ডেস্ক : চলতি বছর বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনার মধ্যেও ২০২১ সালে বিশ্বে রেমিট্যান্স আরও বেড়ে হয়েছে ৬০৫ বিলিয়ন ডলার। এদের বেশির ভাগ গেছে নি¤œ ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। ২০২১ সালে রেমিট্যান্স আয়ের হিসাবে শীর্ষ ৫টি দেশ হচ্ছে ভারত, মেক্সিকো, চীন, ফিলিপাইন্স ও মিসর। এবারই প্রথম চীনকে ছাড়িয়ে যায় মেক্সিকো। সপ্তম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
করোনাভাইরাসের ধাক্কা সামলে বিশ্বে বৈদেশিক আয়ের প্রবাহ ধারাবাহিকভাবে বাড়তে শুরু করেছে। বিশ্বব্যাংকের দেয়া তথ্য মতে, ২০২২ সালে বিশ্বজুড়ে রেমিট্যান্সপ্রবাহ গত বছরের চেয়ে ৪ দশমিক ২ শতাংশ বাড়বে। গত ২০ বছরে প্রবাসী আয় প্রবাহ বেড়েছে ৫ গুণের বেশি। উন্নয়নের পাশাপাশি নিজ দেশে অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায় টনিকের মতো কাজ করে বৈদেশিক আয়। বিশ্বে উচ্চ রেমিট্যান্স অর্জনকারী দেশগুলোর তালিকার শীর্ষে ভারত। সপ্তম স্থানে বাংলাদেশ। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এই আয় চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। প্রবাসী আয় পাঠানোর খরচ ২ শতাংশ কমানো গেলে বিশ্বে অভিবাসীদের ১২ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হতো। বিশ্বে ১৬ জুন আন্তর্জাতিক পারিবারিক রেমিট্যান্স দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়। বিশ্বব্যাংকের দেয়া তথ্য মতে, ২০২২ সালে বিশ্বজুড়ে রেমিট্যান্সপ্রবাহ আরও বেড়ে ৬৩০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাবে। গত বছরের চেয়ে এই প্রবাহ ৪ দশমিক ২ শতাংশ বাড়বে। নি¤œ ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের পাঠানো আয়ের প্রবাহ আরও বাড়বে।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ১৬ জুন আন্তর্জাতিক পারিবারিক রেমিট্যান্স দিবস উদযাপনের অনুমোদন পায়। বিশ্বে আর্থিক খাতের মোড়ল সংস্থাটির বৈদেশিক আয়বিষয়ক অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০ কোটির বেশি অভিবাসী নারী ও পুরুষ তাদের উৎস দেশে পরিবারের ৮০ কোটির বেশি সদস্যের কাছে রেমিট্যান্স পাঠান। রেমিট্যান্সকে বলা হয়ে থাকে অভিবাসীদের সঙ্গে তাদের উৎস দেশে থাকা পরিবারের সদস্যদের এক ধরনের অর্থনৈতিক বন্ধন। এই দিবসে অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা, প্রাকৃতিক ও জলবায়ুসংক্রান্ত বিপর্যয় এবং বিশ্বব্যাপী মহামারি মোকাবিলায় অভিবাসীদের সংহতি ও সহিষ্ণুতাকে আরও গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা হয়। এই দিনে লাখো প্রবাসী পরিবারের সদস্যরা বিশ্বব্যাপী অভিবাসীদের অবদান তুলে ধরেন।
করোনা মহামারি অভিবাসী আয়ের ওপর নির্ভর এসব পরিবারের আর্থিক অবস্থায় বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে। গত ১৯ মার্চ জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস মহামারির সংকট মোকাবিলায় বিশ্ব সংহতির আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘উন্নয়নশীল বিশ্বে রেমিট্যান্স-যোদ্ধাদের পাঠানো আয়ই চালিকাশক্তি, বিশেষ করে মহামারির সময়ে তা প্রমাণিত হয়েছে।’
ব্যক্তিপর্যায়ে পাঠানো বৈদেশিক আয় কম হলেও বিশ্বব্যাপী এর মোট প্রবাহ আকারে অনেক বড়। সারা বিশ্বে মোট উন্নয়ন সহায়তার তিন গুণের বেশি এই রেমিট্যান্স আয়ের প্রবাহ। এই আয়ের অর্থ গ্রহণকারী দেশে অভিবাসীর পরিবারের সদস্যদের প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি তাদের শিক্ষা ও চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই আয়কে পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করে পরিবারের সদস্যদের অনেকে উদোক্তা হয়ে ওঠেন। জাতিসংঘের ঘোষিত এসডিজির লক্ষ্য অর্জনে এসব পরিবারের সদস্যদের সহায়তা করে এই আয়।
গত ২০ বছরে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বেড়েছে ৫ গুণের বেশি। গ্রাহক দেশে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিলে এই আয়ের প্রবাহ তা মোকাবিলায় টনিকের মতো কাজ করে। করোনা মহামারির শুরুতে অর্থনীতিবিদরা শঙ্কা করেছিলেন এই আয়ের প্রবাহে বড় ধরনের ধস নামবে। তবে তাদের পর্যালোচনাকে ভুল প্রমাণিত করেছেন রেমিট্যান্স-যোদ্ধারা। ২০২১ সালের মে মাসে বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে রেমিট্যান্স কমেছে মাত্র ১ দশমিক ৬ শতাংশ। মোট আয় ৫৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে হয়েছে ৫৪০ বিলিয়ন ডলার।
চলতি বছর বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনার মধ্যেও ২০২১ সালে বিশ্বে রেমিট্যান্স আরও বেড়ে হয়েছে ৬০৫ বিলিয়ন ডলার। এদের অধিকাংশ গেছে নি¤œ ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে।
এমন আয় প্রবাহের ধারাবাহিকতা অবাক হওয়ার মতো কিছু নয়। তাদের পরিবারের কাছে পাঠানো আয়ের পরিমাণ প্রতি মাসে ২০০ থেকে ৩০০ ডলার হলেও সামষ্টিকভাবে তা বিলিয়ন ডলার হয়ে দাঁড়ায়।
করোনাকালীন লকডাউন ও বিভিন্ন সামাজিক বিধিনিষেধ আরোপ করায় মোবাইল চ্যানেলের মাধ্যমে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ বেড়ে হয় ৬৫ শতাংশ।
২০২১ সালে রেমিট্যান্সের প্রবাহ লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় দেশগুলোতে ২৫ শতাংশ বেড়েছে। সাব-সাহারা অঞ্চলে ১৪ শতাংশ, ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ায় ৮ শতাংশ, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় সাড়ে ৭ শতাংশ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় বেড়েছে প্রায় ৭ শতাংশ। চীন ছাড়া পূর্ব এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলে বৈদেশিক আয়ের প্রবাহ কমেছে প্রায় সাড়ে ৩ শতাংশ।
২০২১ সালে রেমিট্যান্স আয়ের হিসাবে শীর্ষ ৫টি দেশ হচ্ছে ভারত, মেক্সিকো, চীন, ফিলিপাইন্স ও মিসর। এবারই প্রথম চীনকে ছাড়িয়ে যায় মেক্সিকো। ভারতে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ প্রায় ৯০ বিলিয়ন ডলার।
যেসব দেশে বৈদেশিক আয় মোট দেশজ উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে তাদের মধ্যে রয়েছে লেবানন, টঙ্গো, তাজিকিস্তান, কিরগিজস্তান ও সামাউ। লেবাননের জিডিপির ৫৪ শতাংশই আসে রেমিট্যান্স থেকে। টঙ্গোর ৪৪ শতাংশ আর সামাউর ৩২ শতাংশ জিডিপিতে রেমিট্যান্স-যোদ্ধাদের অবদান রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও সুইজারল্যান্ড থেকে অভিবাসীরা সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স তাদের নিজ দেশে পাঠিয়েছেন।
২০২১ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে প্রতি ১০০ ডলার রেমিট্যান্স নিজ দেশে থাকা পরিবারের সদস্যদের কাছে পাঠাতে খরচ হয় গড়ে ৬ ডলার। এটি জাতিসংঘের এসডিজি লক্ষ্যমাত্রার উল্লেখিত ৩ শতাংশের দ্বিগুণ।
গত বছরের হিসাবে সবচেয়ে কম খরচে রেমিট্যান্স পাঠানো গেছে দক্ষিণ এশিয়ায় (৪.৩ শতাংশ) আর বেশি খরচ পড়েছে সাব-সাহারা অঞ্চলের দেশগুলোতে (৭.৮ শতাংশ) পাঠাতে।
বিশ্বব্যাংকের অভিবাসী ও রেমিট্যান্সবিষয়ক প্রধান দিলিপ রাথা বলেন, বৈদেশিক আয় পাঠানোর খরচ গড়ে ২ শতাংশ কমানো গেলে বিশ্বে অভিবাসীদের ১২ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হতো। এতে নি¤œ মধ্যম আয়ের দেশগুলো আরও বেশি লাভবান হতে পারত।
২০২০ সালে করোনা মহামারির শুরুতে দক্ষিণ এশিয়ায় অনেক অভিবাসী দেশে ফিরে আসে, তবে ২০২১ সালে করোনা প্রতিরোধী টিকাদান কর্মসূচি চালু হয়ে যাওয়ায় উপসাগরীয় দেশগুলোতে অভিবাসীরা ফিরতে শুরু করেন। এতে রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমপক্ষে ৭ শতাংশ বেড়ে হয় ১৫৭ বিলিয়ন। ভারত ও পাকিস্তানে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়ে যথাক্রমে ৮ শতাংশ ও ২০ শতাংশ।
করোনা মহামারির মধ্যেও অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত অর্থবছরে (২০২০-২১) ২৪ বিলিয়ন ৮০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই অঙ্ক আগের বছরের চেয়ে ৬ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার বা ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ বেশি। এর ফলে বিশ্বে উচ্চ রেমিট্যান্স অর্জনকারী দেশগুলোর তালিকায় সপ্তম স্থানে উঠে আসে বাংলাদেশ।
এই রেমিট্যান্সের পরিমাণ ২০২১-২২ অর্থবছর ঘোষিত ৭১ বিলিয়ন ডলারের জাতীয় বাজেটের এক-তৃতীয়াংশের বেশি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক বছর এত বেশি রেমিট্যান্স কখনোই আসেনি। সূত্র : নিউজবাংলা, জাগোনিউজ