হার, জিত, সন্দেহ আর উচ্ছ্বাস কুমিল্লার বাতাসে
অর্থনীতি ডেস্ক : ভোটের লড়াই শেষে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে শুরু করেছে কুমিল্লা নগরী, তবে ফল ঘোষণায় শেষ মুহূর্তের উত্তেজনার রেশ রয়ে গেছে চায়ের আড্ডা আর অলি-গলির আলোচনায়।
বুধবার ভোটের জন্য বন্ধ ছিল স্কুল। বৃহস্পতিবার সকালে বাচ্চাদের ফের ড্রেস পরে স্কুলে যাওয়ার তাড়া। অলিগলিতে রিকশার টুংটাং ঘণ্টা, খাবার হোটেলে পরোটা ভাজার গন্ধ, সব মিলিয়ে নতুন এক সকাল।
কুমিল্লা মেডিকেল সেন্টারের সামনের সড়কে কয়েকজন জটলা করে কথা বলছিলেন; পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কান পাততেই একজনকে বলতে শোনা গেল, “এরকম হড্ডাহাড্ডি লড়াই!” পাশে দাঁড়ানো মধ্যবয়সী আরেকজন বললেন, “অনেক গ্যাঞ্জাম হইছে শুনছি।”
তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু কুমিল্লা সিটি নির্বাচনের ভোটের ফল। ওই ফলাফলেই বড় পরিবর্তন ঘটে গেছে নগরীর ক্ষমতার ভারসাম্যে। মেয়র পদে মনিরুল হক সাক্কু যুগের অবসান হয়েছে, আরফানুল হক রিফাতের হাত ধরে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন প্রথমবারের মত পেয়েছে আওয়ামী লীগের মেয়র।
বুধবার সারাদিন ভোটে বৃষ্টি ছাড়া আরও কেউ গণতন্ত্র চর্চায় বাগড়া দিতে আসেনি। কোনো মারামারি হয়নি, বড় কোনো অনিয়মের অভিযোগও প্রার্থীরা কেউ করেননি।
কিন্তু ভোটের উত্তেজনা নতুন মাত্রা পায় রাতে ফল ঘোষণার সময়। এ সিটির ১০৫টি কেন্দ্র থেকে ইভিএমের ভোটের ফল আসছিল জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে স্থাপিত ফলাফল সংগ্রহ ও পরিবেশন কেন্দ্রে। সেখান থেকে সমন্বিত ফলাফল ঘোষণা করা হচ্ছিল। বিএনপি ছেড়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া সাক্কু এবার ভোট করেছেন টেবিল ঘড়ি প্রতীক নিয়ে। ফল ঘোষণার শুরু থেকেই নৌকার রিফাতের সঙ্গে তার পার্থক্য ছিল কাছাকাছি। কখনও এগিয়ে ছিলেন রিফাত, কখনও আবার সাক্কু তাকে ডিঙিয়ে যাচ্ছিলেন। তাতে উত্তেজনা বাড়ছিল দুই শিবিরে।
১০১টি কেন্দ্রের ফল ঘোষণার পর সাক্কু সামান্য ব্যবধানে এগিয়ে ছিলেন রিফাতের চেয়ে। তার কিছুক্ষণ আগেই ফল ঘোষণা কেন্দ্রে উপস্থিত হন গত দুইবারের মেয়র সাক্কু। এর মধ্যে রিফাতের সমর্থকরা সেখানে তুমুল হট্টগোল শুরু করলে পুলিশ তাদের ধাওয়া দিয়ে বের করে দেয়।
এই উত্তেজনার মধ্যে বেশ কিছু সময় ফল ঘোষণা বন্ধ থাকে। রাত সাড়ে ৯টার দিকে ১০৫টি কেন্দ্রের মধ্যে সবকটির ফলাফলে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আরফানুল হক রিফাতকে বিজয়ী ঘোষণা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা শাহেদুন্নবী চৌধুরী।
সেখানে বলা হয়, নৌকা মার্কার প্রার্থী পেয়েছেন ৫০ হাজার ৩১০ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সাক্কু পেয়েছেন ৪৯ হাজার ৯৬৭ ভোট। রিফাত ৩৪৩ ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করেছেন।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের’ অভিযোগ এনে বেরিয়ে যান সাক্কু।
এবারের ভোটে বড় চমক দেখিয়েছেন প্রথমবার ভোটে দাঁড়ানো নিজাম উদ্দিন কায়সার। সাক্কুর মত তিনিও বিএনপি ছেড়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন, ঘোড়া প্রতীকে তিনি পেয়েছেন প্রায় ত্রিশ হাজার ভোট। তার ঘোড়াই বিএনপির ভোট ব্যাংকে হানা দিয়ে সাক্কুর টেবিল ঘড়ি গিলে ফেলেছে বলে অনেকের ধারণা।
অবশ্য সাক্কু যে অভিযোগ করেছেন, তেমন সন্দেহের কথা বিএনপি সমর্থক অনেকেই বলাবলি করছেন।
আবার অনেকে বলছেন, ফল ঘোষণার সময় শেষ মুহূর্তের গ-গোল আর তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উত্তেজনার পারদ যেখানে পৌঁছেছিল, তাতে জয় যে পক্ষেই যাক, অন্যপক্ষের অভিযোগ তোলা অবধারিতই ছিল।
কান্দিরপাড় রামঘাট নামিরা মসজিদের সামনে তিন অটোরিকশা চালক বিশ্বরোড বিশ্বরোড বলে যাত্রী ডাকছিলেন। তাদের একজন নাম বললেন নজরুল।
ভোট নিয়ে প্রশ্ন করতেই বললেন, “হ হ আমরা জিতছি।” তার পাশে দাঁড়ানো ইমদুল নামে আরেকজন বলে উঠলেন, “চুরি কইরা জিতছস, তোগো সব লোক ফল ঘুরাইয়া দিছে।”
দুজনের ঠা-া ঝগড়ার ফাঁকে ইমদুল প্রশ্ন তোলেন, “১০১ কেন্দ্র ঘোষণার পর রেজাল্ট ঘোষণা বন্ধ হইল কেন?”
উত্তরে নজরুল বললেন, “তোগো লোক ভেতরে ঢুইকা গ্যাঞ্জাম কইরা বন্ধ করছে। পরে পুলিশ ঠা-া করছে।”
এরকম কথা লড়াই কুমিল্লা শহরের অনেক জায়গাতেই চলছে। ছন্দু হোটেলের কর্মচারীরা কাস্টমার সামলানোর ফাঁকেই ভোটের হার-জিত নিয়ে কথা চালাচ্ছিলেন। একজন বললেন, “ওরে বাবা, ভোট কারে কয়, হেরাই (রিফাত ও সাক্কু) টের পাইছে! এত হাড্ডাহাড্ডি লড়াই!!”
নামিরা মসজিদের কাছেই এক চায়ের দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে পত্রিকা পড়ছিলেন একজন। পরিচয় দিয়ে ভোটের প্রসঙ্গ তুলতে তিনি বললেন, “এখানে আসলে সাক্কুর জয় হয়েছে। এত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে এত ভোট পেল! কায়সার না দাঁড়ালে তো অনায়াসে জয় হত সাক্কুর।”
তবে ফল ঘোষণায় কোনো কারচুপি হয়েছে বলে মনে করেন না মধ্যবয়সী এই ব্যক্তি। তার ভাষায়, “এখানে ব্যবধান খুব কম, সেটাই মূল কারণ। এত অল্প ব্যবধান হেরে গেলে কেউ মানতে চায় না। এটাই সমস্যা।”
তিনি বলেন, প্রত্যেক প্রার্থীর এজেন্ট কেন্দ্রে কেন্দ্রে থাকে। সব কেন্দ্র যোগ করে ফলাফল তারা রিটার্নিং অফিসার ঘোষণার আগেই জেনে যায়।
“ব্যবধান কম হওয়ায় দুই পক্ষই জয়ের আশা নিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার অফিসে গিয়ে নিজেদের পক্ষে মিছিল করেছে। আসল ফলাফল সাক্কু ও রিফাত আগেই জেনেছে। তবে অনেকে মনে করছে, ১০১ কেন্দ্রের ফল ঘোষণার পর অনেকক্ষণ বন্ধ থাকায় ‘কিন্তু’ রয়েছে এখানে।”
মনোহরপুর ফাইন্ড টাওয়ারের সামনে কথা হয় এক বৃদ্ধের সঙ্গে। তিনি বললেন, কুমিল্লার রাজনীতিতে সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের কথা।
“রিফাত তো বাহারের সমর্থন পাইছে। তারপরও তার এত অল্প ভোটে জয়।ৃ ফলাফল যাই হোক, কুমিল্লাবাসী শান্তিপ্রিয়, সব প্রার্থী সবাইকে আপন করেই এগিয়ে যাবে।” সূত্র : বিডিনিউজ