
ভয়াবহ বন্যায় দিশেহারা সিলেটবাসী দুর্ভোগে লাখ লাখ মানুষ

জহিরুল ইসলাম : এক মাসের মাথায় ফের বন্যার কবলে পড়েছে সিলেট জেলা, মহানগরীর অধিকাংশ জনপদ ও সুনামগঞ্জ জেলা। এরমধ্যে চরম দূর্ভোগ ও সবচেয়ে অসহায় অবস্থায় পড়েছেন সিলেটের প্রায় সকল উপজেলার বাসিন্দারা। এসব এলাকার রাস্তাঘাট তলিয়ে বাসাবাড়িতে ঢুকে পড়েছে পানি।
টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে সুনামগঞ্জের নদ-নদীর পানি দ্রুত বেড়েই চলেছে। বন্যায় সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কের গোবিন্দগঞ্জ-দিঘলী এলাকা প্লাবিত হয়ে সারাদেশের সাথে সুনামগঞ্জের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে আন্তঃজেলা যোগাযোগ ব্যবস্থাও।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক জনাব মো. জাহাঙ্গীর হোসেন।
বন্যার পানি বেড়ে যাওয়ায় সুনামগঞ্জ পৌর শহরের বিভিন্ন এলাকার ঘরবাড়িতে পানি প্রবেশ করা শুরু করেছে। ইতোমধ্যে শহরের নবীনগর, পশ্চিম তেঘরিয়া, উত্তর আরপিন নগর, মরাটিলা এলাকার ঘরবাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে।
জেলার সর্বত্র বন্যার ভয়ালগ্রাসে মানুষের চরম দুর্ভোগ বেড়েছে। এতে মানবিক বিপর্যয় নেমে আসতে পারে বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী। বন্যা মোকাবেলা সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন তারা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেট সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ অশুক্রবার সকাল পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী, সুরমা নদীর দুটি ও কুশিয়ারা নদীর একটি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া সারি নদের একটি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার অন্যান্য নদ-নদীর পানিও ক্রমশ বাড়ছে বলে পাউবোর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, সুনামগঞ্জের বৃষ্টি থাকলেও উজানের বৃষ্টিপাত হচ্ছে খুবই বেশি। ফলে নদ-নদীর পানি দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। উজানে বৃষ্টিপাত যদি কমে, তবে এ পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হতে পারে।
বানভাসি মানুষেরা বন্যার পানি বেড়ে যাওয়ায় অনেকে বাড়িঘরে আটকা পড়েছেন। এ ছাড়া অনেক বন্যার্তরা খাবার ও পানির সংকটে সবচেয়ে বেশি পড়েছেন। ঘরে হাঁটু থেকে গলাসমান পানি ওঠায় অনেকে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন। অনেকে ত্রাণও পাচ্ছেন না।
সিলেট নগরের তালতলা, জামতলা, মির্জাজাঙ্গাল, কালীঘাট, মাছিমপুর, মেন্দিবাগ, উপশহর, তেরোরতন, যতরপুর, সোবহানীঘাট, চালিবন্দর ও ঘাসিটুলা এলাকা বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়ে পড়েছে। এসব এলাকার অনেক রাস্তায় পানি থই থই করছে। বাসা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে পড়েছে। বানের পানির সঙ্গে ভেসে আসছে ময়লা-আবর্জনা। এসব পানি থেকে দুর্গন্ধও ছড়াচ্ছে।
অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে সৃষ্ট বন্যায় সিলেটের পানিবন্দি মানুষদের উদ্ধারে কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলায় সেনাবাহিনী নামানো হয়েছে। সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান শুক্রবার দুপুরে এ তথ্য জানিয়েছেন।পর্যায়ক্রমে বন্যাকবলিত সব উপজেলায় সেনাবাহিনী কাজ করবে বলে জানান তিনি।
সিলেট জেলার সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা গকুল চন্দ্র দেবনাথ জানান, এ পর্যন্ত জেলায় ২৩০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পানি উঠেছে। এসব বিদ্যালয়ের পাঠদান সাময়িক বন্ধ রাখা হয়েছে।
সিলেটের বেশিরভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে পুরো সিলেট শহরের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে শুক্রবার দুপুর থেকে কাজ করছে সেনাবাহিনী, সিলেট সিটি করপোরেশন ও বিদ্যুৎ বিভাগ।কুমারগাও বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রের চারপাশে বালির বস্তা দিয়ে দিয়ে বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করে সেনাবাহিনী। এ ছাড়া সিলেট সিটি করপোরেশনের সাকার মেশিন দিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ঢুকে পড়া পানি শুকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
বন্যাকবলিত হয়েছেন সিলেট মহানগরীর প্রায় ৫০ এলাকার বাসিন্দা। বন্যাকবলিত এলাকার লোকজনদের জন্য নগরীতে ৩১টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হলেও উঠার অপেক্ষায় রয়েছেন আরও অনেকে।সুরমা নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় তীরবর্তী এলাকার লোকজনদের দূর্ভোগ বেড়েছে। নতুন করে আরও কয়েকটি এলাকার রাস্তা-ঘাট তলিয়ে বাসা-বাড়িতে ঢুকে পড়েছে পানি।
ভারতের সবচেয়ে বৃষ্টিপ্রবণ দুই শহর চেরাপুঞ্জি আর মৌসিনরামে গত ক’দিন ধরেই মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণেই দেশের উজানের দুই জেলায় আচমকা এই দুর্ভোগ তৈরি হয়েছে। আর ভারতের গণমাধ্যমগুলোর খবর বলছে, এর মধ্যে চেরাপুঞ্জিতে গত ২৭ বছর আর মনিরামে গত ২৬ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ডও হয়েছে।
বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদফতর ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য বলছে, মূলত ভারতের চেরাপুঞ্জি ও মৌসিনরামের এমন রেকর্ড ছাড়ানো বৃষ্টির ঢলই বাংলাদেশে চলে এসেছে। আর সে কারণেই রাতারাতি ডুবে গেছে সুনামগঞ্জ ও সিলেটের বেশিরভাগ এলাকা।
ভারতীয় আবহাওয়া অফিসের তথ্যের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, মঙ্গলবার ভারতীয় সময় সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বুধবার সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত ৮১১ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জি শহরে। ১৯৯৫ সালের পর থেকে ২৪ ঘণ্টায় এত বেশি বৃষ্টিপাতের রেকর্ড এই শহরে নেই।
আবহাওয়া অফিসের তথ্য, ১৯৯৫ সালের ১৬ জুন মেঘালয়ের ইস্ট খাসি হিলস জেলার এই শহরে বৃষ্টিপাত হয়েছে ১ হাজার ৫৬৩ দশমিক ৩ মিলিমিটার। আর এর আগের দিন, অর্থাৎ ১৯৯৫ সালের ১৫ জুন এই শহরে বৃষ্টিপাত হয়েছিল ৯৩০ মিলিমিটার। এরপর গত ২৭ বছরের মধ্যে গত মঙ্গল ও বুধবারের মধ্যেকার ওই ২৪ ঘণ্টাতেই সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে চেরাপুঞ্জিতে।
উজানের ঢলে সুনামগঞ্জ ও সিলেটের ডুবে যাওয়ার পেছনে কেবল চেরাপুঞ্জি নয়, এর পাশেরই আরেক শহর মৌসিনরাম শহরের রেকর্ড বৃষ্টিপাতও দায়ী। এই শহরে মঙ্গলবার সকাল থেকে বুধবার সকাল পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়েছে ৭১০ দশমিক ৬ মিলিমিটার। ১৯৯৬ সালের জুনের পর এটিই এই শহরে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড।
চেরাপুঞ্জিতে অবশ্য জুন মাসের ২৪ ঘণ্টায় ৭৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের ঘটনা রয়েছে আরও আটটি। তবে ভারতীয় আবহাওয়া অফিসের গুয়াহাটি আঞ্চলিক কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সুনিত দাস জানাচ্ছে, বর্তমানে মৌসিনরাম ভারতের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিভেজা অঞ্চল। ১৯৭৪ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সময়ে এই শহরের গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বছরে ১১ হাজার ৮০২ দশমিক ৪ মিলিমিটার। এর পরের স্থানেই অবশ্য রয়েছে চেরাপুঞ্জি। পার্থক্যও খুব বেশি নয়। ১৯৭১ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ের তথ্য বলছে, চেরাপুঞ্জিতে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১১ হাজার ৩৫৯ দশমিক ৪ মিলিমিটার।
