সৌরবিদ্যুতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নেতৃত্বে ভিয়েতনাম
অর্থনীতি ডেস্ক : জলবায়ু পরিবর্তনে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা অঞ্চলগুলোর মধ্যে দক্ষিণপূর্ব এশিয়া অন্যতম। তবু জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধে তাদের আগ্রহ খুব একটা দেখা যায় না বললেই চলে। কিন্তু এই কালিঝুলি মাখা মানচিত্রের মধ্যেই উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করছে একটি দেশ- ভিয়েতনাম।
২০২১ সাল পর্যন্ত মাত্র চার বছরে ভিয়েতনামে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের হার কার্যত শূন্য থেকে বেড়ে প্রায় ১১ শতাংশে পৌঁছেছে। এই হার শুধু বিশ্বের অন্য যেকোনো অংশের তুলনায় বেশিই নয়, এক্ষেত্রে ফ্রান্স-জাপানের মতো বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোকেও পেছনে ফেলে দিয়েছে ভিয়েতনাম। গত বছর বিশ্বের ১০ম সর্বোচ্চ সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদকের জায়গা দখল করেছে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশটি।
পরিশুদ্ধ জ্বালানির প্রতি নিজ দেশের প্রতিশ্রুতি বোঝাতে ভিয়েতনামিজ প্রধানমন্ত্রী ফাম মিন চিন গত নভেম্বর মাসে কয়লা-নির্ভর নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ বন্ধ এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ভিয়েতনামে কার্বন নিঃসরণের হার শূন্যে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অন্য দেশগুলো এক্ষেত্রে ভিয়েতনামকে দেখে শিক্ষা নিতে পারে। দেশটি ২০১৯ সালের পর থেকে বায়ু ও সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা চারগুণ বাড়িয়েছে। অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির পল বার্ক এবং থাং ডোসহ অন্যান্যদের পরিচালিত একটি গবেষণা বলছে, ভিয়েতনামের এই ‘অসাধারণ অর্জন’ মূলত রাজনৈতিক ইচ্ছা এবং প্রণোদনার ফলাফল।
২০১৭ সালে ভিয়েতনামিজ সরকার সৌরবিদ্যুৎ সরবরাহকারীদের গ্রিডে সরবরাহ করা প্রতি কিলোওয়াট/ঘণ্টা বিদ্যুতের জন্য ৯ দশমিক ৩৫ মার্কিন সেন্ট হারে ‘ফিড-ইন শুল্ক’ দেওয়া শুরু করে। এর ফলে ২০১৯ ও ২০২০ সালে দেশটিতে বাড়ির ছাদে এক লাখ সোলার প্যানেল বসানো সম্ভব হয় এবং এতে তাদের সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ১৬ গিগাওয়াট বৃদ্ধি পায়। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অন্য দেশগুলোও ফিড-ইন শুল্ক ব্যবস্থা কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছে, কিন্তু তাদের উদ্যোগ যথেষ্ট ছিল না।
এই নীতি ভিয়েতনামে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ব্যবসা করার পথ সুগম করতে সাহায্য করেছে। এটি দেশীয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ সংস্থা ভিয়েতনাম ইলেকট্রিসিটির (ইভিএন) একচেটিয়া আধিপত্যেরও অবসান ঘটিয়েছে। বিপরীতে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্য দেশগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের যেমন প্রায়ই আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্যে পড়তে হয়, তেমনি ভতুর্কি পাওয়া দেশীয় জীবাশ্ম-জ্বালানি সংস্থাগুলোর সঙ্গেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা লাগে।
তবে ভিয়েতনাম যদি ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের হার শূন্যে নামানোর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে চায়, তাদের আরও কঠোরভাবে চেষ্টা করতে হবে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ডেজান শিরার মতে, গত এক দশকে দেশটিতে বিদ্যুতের চাহিদা প্রায় ১০ শতাংশ বেড়েছে, যার বেশিরভাগই মেটানো হচ্ছে কয়লা দিয়ে।
লন্ডন-ভিত্তিক থিংক ট্যাংক এমবার জানিয়েছে, ২০২১ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে ভিয়েতনামে নোংরা জিনিসে উৎপাদিত বিদ্যুতের অংশ ৩৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫১ শতাংশ হয়েছে। এ অবস্থায় কয়লা ব্যবহার বন্ধ করলেও দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যেন বজায় থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে। মহামারির আগে ভিয়েতনামে প্রতি বছর পাঁচ থেকে সাত শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে। পল বার্ক বলেন, ভিয়েতনামের সরকারি পরিকল্পনাবিদদের অতি দ্রুত বায়ু ও সৌরশক্তির ব্যবহার বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। তারা এটি কীভাবে করবেন তা এখনো স্পষ্ট নয়।
দেশটিতে কীভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে তার রূপরেখার মাস্টারপ্ল্যান সংশোধন করা হচ্ছে এবং তা চলতি মাসেই প্রকাশিত হতে পারে। ভিয়েতনামে বর্তমানে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের বেশিরভাগ অংশ আসে জলবিদ্যুতের বাঁধ থেকে।
ভিয়েতনামিজ পরিকল্পনাবিদদের গ্রিড নিয়েও ভাবতে হবে। এটি অবশ্যই প্রসারিত ও আপগ্রেড করতে হবে যেন, গোটা দেশ এর আওতায় আসে এবং নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের অনিশ্চিত প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সক্ষম হয়। ভিয়েতনামে বর্তমানে যে পরিমাণ নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়, সেটুকু গ্রহণেরই সক্ষমতা নেই গ্রিডে।
হ্যানয়-ভিত্তিক এক বিশ্লেষক বলেন, গ্রিডের উন্নয়ন খুবই ব্যয়বহুল। এর জন্য সরকারকে বেসরকারি বিনিয়োগ চাইতে হবে, তা প্রায় নিশ্চিত। কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন নীতিনির্ধারকদের পাশাপাশি কেউ কেউ বেসরকারি খাতে বড় ট্রান্সমিশন সম্পদ হস্তান্তর করতে নারাজ। ওই বিশ্লেষকের মতে, ইভিএনের মানসিকতায় পরিবর্তন আসতে পারে, তবে তা ধীরে ধীরে ঘটবে। কিন্তু লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য ভিয়েতনামকে অবশ্যই দ্রুততর হতে হবে।