আমদানি কমছে, বাড়ছে রেমিট্যান্স, ফিরছে স্বস্তি
অর্থনীতি ডেস্ক : দেশের অর্থনীতি নিয়ে নানা উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে সুখবর দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আমদানি অর্ধেকে নেমে এসেছে; অন্যদিকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে।
আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বড় ধরনের চাপের মুখে পড়েছে অর্থনীতি; রিজার্ভ কমে ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে, বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে (ব্যালান্স অফ পেমেন্ট) বিশাল ঘাটতিতে পড়ে ওলোটপালট হয়ে গেছে সব হিসাবনিকাশ। সেই আমদানি খরচ অর্ধেকে নেমে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টের ১১ দিনে পণ্য আমদানির জন্য ১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারের ঋণপত্র (এলসি) খুলেছেন দেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। আগের মাস জুলাইয়ের এই ১১ দিনে ২ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। তার আগের মাস জুনের ১১ দিনে খোলা হয়েছিল ২ দশমিক ৩৩ বিলিরয়ন ডলারের এলসি।
অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ৫৫৫ কোটি (৫.৫৫ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খোলা হয়েছে, যা জুনে ছিল ৭৯৬ কোটি (৭.৯৬ বিলিয়ন) ডলার। অর্থাৎ জুন থেকে জুলাই মাসে এলসি খোলা কমেছে ৩০ দশমিক ২০ শতাংশ। জুনে এলসি নিষ্পত্তি হয়েছিল ৭৭৫ কোটি ডলার। জুলাইয়ে সেটি ১১৭ কোটি ডলার কমে ৬৫৮ কোটি ডলারে নেমে এসেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮৩ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা, যা ছিল আগের বছরের চেয়ে ৩৭ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই এক আর্থিক বছরে পণ্য আমদানিতে এত ব্যয় হয়নি।
অন্যদিকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহে ২০২০-২১ অর্থবছরের মতো উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে। আগস্টের প্রথম ১০ দিনেই ৮১ কোটি ৩০ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত বছরের আগস্টের একই সময়ের চেয়ে ২০ দশমিক ৪০ শতাংশ বেশি। এর আগে কোনো মাসেই ১০ দিনে এত বেশি রেমিট্যান্স কখনই আসেনি দেশে। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে (প্রতি ডলার ৯৫ টাকা) টাকার অঙ্কে ১০ দিনের রেমিট্যান্সের পরিমাণ ৭ হাজার ৭২৩ কোটি টাকা। এ হিসাবে প্রতিদিন এসেছে ৮ কোটি ১৩ লাখ ডলার বা ৭৭২ কোটি টাকা।
বাজারে ডলারের ব্যাপক চাহিদা থাকায় ব্যাংকগুলো ১১০ টাকার বেশি দরেও রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে। সে হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ আরও বেশি।
মাসের বাকি ২০ দিনেও এই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকবে, এমন আশার কথা শুনিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘জুলাই মাসের মতো আগস্ট মাসেও ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স দেশে আসবে।’
জুলাইয়ে ২০৯ কোটি ৬৯ লাখ ১০ হাজার (২.১ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল গত ১৪ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আর গত বছরের জুলাই মাসের চেয়ে এটি বেশি ১২ শতাংশ। প্রতি ডলার ৯৫ টাকা হিসাবে টাকার অঙ্কে ওই অর্থের পরিমাণ প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা।
গত বছরের আগস্ট মাসের ১০ দিনে (১ থেকে ১০ আগস্ট) ৬৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত (১ মাস ১০ দিনে) ২৯১ কোটি (২.৯১ বিলিয়ন) ডলার দেশে এসেছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৪ দশমিক ৩০ শতাংশ বেশি।
২০২১-২২ অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত ২৫৪ কোটি ৭০ লাখ (২.৫৪ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
করোনা মহামারির পর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ধাক্কায় ওলটপালট হয়ে যাওয়া অর্থনীতিতে কয়েক দিন আগে জ্বালানি তেলের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধিতে যখন দেশজুড়ে ক্ষোভ-হতাশা এবং আগামী দিনগুলোতে কী হবে, এই প্রশ্ন সবার মধ্যে, তখন স্বস্তির ইঙ্গিত দিচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের প্রবাহ। মনে করিয়ে দিচ্ছে ২০২০-২১ অর্থবছরের কথা। ভরা করোনা মহামারির মধ্যেও ওই অর্থবছরে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০১৯-২০) চেয়ে ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি।
২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবাসী আয়ে মন্দা দেখা দেয়। পুরো অর্থবছরে ২ হাজার ১০৩ কোটি (২১.০৩ বিলিয়ন) ডলার এসেছিল; গড়ে প্রতিদিন ৫ কোটি ৭৬ লাখ ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় উল্লম্ফন ঘটে ২০২০-২১ অর্থবছরে। সে সময় ২ হাজার ৪৭৮ কোটি (২৪.৭৮ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসীরা। ওই অর্থবছরে প্রতিদিন গড়ে ৬ কোটি ৭৯ ডলার প্রবাসী আয় হিসেবে দেশে এসেছিল।
সাধারণত দুই ঈদের আগে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাড়ে; ঈদের পর কমে যায়। তবে এবার কোরবানির ঈদের আগে যে গতিতে রেমিট্যান্স এসেছে, সেই ধারা ঈদের পরেও অব্যাহত আছে।
দেশে গত ১০ জুলাই কোরবানির ঈদ উদযাপিত হয়। ঈদের আগে রেমিট্যান্স প্রবাহে ঢল নামে। ঈদের ৯০ কোটি ৯৩ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। ঈদের পরে ২১ দিনে এসেছে ১১৮ কোটি ৭৬ লাখ ডলারের কিছু বেশি।
দেশের অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর হালচাল নিয়ে তৈরি করা পাক্ষিক প্রতিবেদনেও রেমিট্যান্স নিয়ে সুসংবাদের আভাস দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
গত ২১ জুলাই প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় বাড়াতে সরকার ইতোমধ্যে রেমিট্যান্সে নগদ প্রণোদনা ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২ দশমিক ৫০ শতাংশ করেছে। করোনা মহামারি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় সব প্রবাসী তাদের কর্মস্থলে ফিরেছেন। টাকার বিপরীতে ডলার বেশ খানিকটা শক্তিশালী হয়েছে। ‘এই বিষয়গুলো আগামী মাসগুলোতে রেমিট্যান্স বাড়াতে সাহায্য করবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংক গত ৩০ জুন ২০২২-২৩ অর্থবছরের নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। এতে বলা হয়, রেমিট্যান্স ঊর্ধ্বমুখী হবে এবং চলতি অর্থবছরে গত বছরের চেয়ে ১৫ শতাংশ বেশি আসবে।