অতিপলিশিংয়ে বছরে মানুষের খাবারের অযোগ্য হচ্ছে পঞ্চাশ লাখ টন চাল
মতিনুজ্জামান মিটু : পলিশিং ৫শতাংশে সীমাবদ্ধ রাখতে পারলে ২৫ লাখ টন চালের সাশ্রয় হবে। অতিমাত্রায় পলিশিংয়ে দেশের খাদ্য নিরাপত্তার ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে ও বৈদেশিক উৎস হতে মিলিয়ন টন চাল ও গম আমদনি করতে হচ্ছে। চালকলের পলিশিং ব্যবস্থার ওপরে বিধিনিষেধ আরোপ করে এঅপচয় রোধসহ খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি উভয়ই নিশ্চিত করা সম্ভব। এতে অভ্যন্তরীণভাবে দেশে খাদ্যর চাহিদা পূরণ এবং বাজারের দরের স্থিতিশীলতা আসবে।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের একটি সুত্রের বরাতে কৃষি তথ্য সার্ভিস জানায়, একদিকে সজ্ঞানে চালকে অতিরিক্ত পলিশিং করে পুষ্টিহীন করা হচ্ছে। অপরদিকে বিদেশ হতে ভিটমিন ও মিনারেলযুক্ত কেমিকেল কিনে তা দিয়ে কৃত্রিমভাবে চাল তৈরি করে বিদ্যমান চালের সঙ্গে মিশিয়ে দেশের গরিব মানুষের পুষ্টি পূরণের চেষ্টা চলছে। যাতে দেশি ও বিদেশী অর্থের অপচয় হচ্ছে।
বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম ধান উৎপাদনকারী দেশ। এ দেশের জলবায়ু মাটি ও পানি ধান চাষের জন্য উপযোগী। একসময় এদেশে অসংখ্য জাতের ধানের আবাদ ছিল। উচ্চফলনশীল জাতের আবির্ভাব হওয়ায় স্থানীয় মিষ্টি ও সুগন্ধিযুক্ত আদি জাতগুলো বিলুপ্ত হয়েছে। স্থানীয় জাতের ধানের উৎপাদন ক্ষমতা কম এবং উৎপাদনকাল বেশি ছিল। তবে পুষ্টিগুণ ছিল বেশি। বর্তমানে যেসব ধানের চাষাবাদ করা হয় এদের উৎপাদনে সময় কম লাগছে এবং ফলন বেশি হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা বিবেচনায় উচ্চফলনশীল ধানের জাতের পর হাইব্রিড জাতের ধানের আবাদের দিকেও ঝুঁকছে এদেশের কৃষক। এসময়ে প্রযুক্তি গ্রহণ করতেই হবে। না হলে দেশে খাদ্য ঘাটতির সৃষ্টি হবে, মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভুগবে এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি রক্ষাই হলো সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাত। প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় বেশি ধান উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে এবং এদেশে খাদ্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা জোরদার হচ্ছে। কিন্তু সরকারিভাবে বিজ্ঞানভিত্তিক মিলিং ব্যবস্থাপনা ও যথাযথ নির্দেশনার অনুপস্থিতির কারণে আধুনিক চালকলের অতিরিক্ত পলিশিং ব্যবস্থায় চালের পুষ্টি হারিয়ে যাচ্ছে।
পলিশবিহীন পূর্ণচাল পুষ্টিমানসমৃদ্ধ কিন্তু দেখতে আকর্ষণীয় নয়। অনেকটা ঘোলা বা বাদামি ধরনের। তাই এই চালের বাজারদর নিম্ন এবং চাহিদা কম। অতিরিক্ত পলিশিং ব্যবস্থায় চালের উপরের বাদামিস্তর চলে যাচ্ছে এবং স্বচ্ছ ও সিল্কি চাল তৈরি হচ্ছে। এ সিল্কি চাল আকর্ষনীয় ও বাজারে এর চাহিদাও বেশি। সেসঙ্গে দামও বেশি। অথচ বাদামি চালের পুষ্টির চেয়ে স্বচ্ছ চালের পুষ্টিমান অনেক কম। স্বচ্ছ ও সিল্কি চালে কার্বোহাড্রেট বেশি থাকে তাই ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি হয়।
অতিরিক্ত পলিশিংয়ে চালের স্থায়িত্বও কমে যায়। বাজারে কিছু একসিদ্ধ বা অর্ধসিদ্ধ চাল দেখা যায় যেগুলোর পেট সাদা। এসব চাল একসিদ্ধ বলা হলেও পুরোপুরি একসিদ্ধও নয়। এসব চাল দ্রুত ভেঙে যায় এবং স্থায়িত্ব কমে যায়।
যার কারণে চালের অপচয় হয়। তাই চাল হতে হবে পুরোপুরি সিদ্ধ বা সিদ্ধহীন আতপ। ধান হতে চাল তৈরিতে কখনো দুই সিদ্ধ আবার কখনো একসিদ্ধ করা হয়। ধানকে যখন সিদ্ধ করা হয় তখন চালের ওপরের পুষ্টিযুক্ত স্তর হতে কিছু পুষ্টি চালের ভিতরের স্তরে পৌঁছে যায়। এ কারণে আতপের তুলনা সিদ্ধ চালের পুষ্টিমান তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে। একই কারণে একসিদ্ধ চালের তুলনায় দুইসিদ্ধ চাল বেশি পুষ্টিমানসমৃদ্ধ।
আধুনিক মিলিং ব্যবস্থা মূলত বিভিন্ন ধরনের উন্নত প্রযুক্তির সমন্বয়। যার কারণে সয়ংক্রিয়ভাবে এসব মিলে চাল শুকানো, সিদ্ধকরণ, মিলিং করা, মরা ও ভাঙা দানা পৃথকীকরণসহ চাল বহির্ভূত অন্যান্য বিজাতীয় পদার্থ আলাদাকরণ করা সম্ভব হচ্ছে। ধান হতে চাল তৈরির জন্য প্রাকৃতিকভাবে অনুকূল পরিবেশের জন্য আগের মতো অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিতে ধান ভিজে নষ্ট হওয়া হতে রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে। বর্তমানে অটোমেটিক মিলিং ব্যবস্থার ধান হতে চাল তৈরিতে দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার প্রভাব থাকছে না বিধায় দেশে খাদ্য নিরাপত্তা বাড়ছে, চালের গুণগতমানও অক্ষুণ্ন থাকছে। সেসঙ্গে কাংক্ষিত মানের চাল তৈরি ও ভোক্তার সন্তুষ্টি অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে।
আগের ভোক্তা পর্যায়ে মরা দানা, ভাঙা দানা ও অন্যান্য বিজাতীয় পদার্থ চাল হতে পৃথক করতে হতো। আগে হলারের মধ্যমে যে মিলিং হতো তাতে নির্দিষ্ট জাতের বা ধরনের চাল পৃথক করে রাখা সম্ভব হতো। বর্তমানে বড় মিলে সেটি আর সম্ভব হয়না। মেজর বা অটোমেটিক চালকলে বেশ কয়েক টন ধান একইসঙ্গে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এ ধান অসংখ্য কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেই ফড়িয়ার মাধ্যমে চালকলে আনা হয়। তাই এতে বিভিন্ন জাতের ধান থাকাই স্বাভাবিক। সেকারণে বাজারে চালের বস্তায় যে ধরনের চাল বলে উল্লেখ করা হয়, সেটি অনেক ক্ষেত্রেই যথার্থ নয়। তবে নির্দিষ্ট কিছু উচ্চমূল্যের সরু বা পোলাউর চালে স্বকীয়তা বজায় থাকে। মূলত বিভিন্ন জাতের ধান একই চাল কলে মিলিংয়ের জন্য সংগ্রহ করা হয় এবং মিলার ধান হতে চাল তৈরি করে ক্রেতাদের চাহিদানুযায়ী নামকরণ করেন। এ সমস্যা সমাধানে জোনভিত্তিক নির্দিষ্ট জাতের ধানের উৎপাদন ব্যবস্থাপনা নেওয়া যেতে পারে। জোনভিত্তিক ধান উৎপাদন ব্যবস্থা নেওয়া হলে উৎপাদন বাড়বে। কারণ ওই এলাকার উপযোগী অধিক উৎপাদনশীল ধান উৎপাদনের জন্য বিবেচিত হবে। সেইসঙ্গে মিলার নির্ধারিত জাতের ধান সংগ্রহ, মিলিং ও এর যথাযথ লেভেলিং বা বস্তায় স্টেনসিলের মাধ্যমে তা বাজারজাত করতে সক্ষম হবেন।
অভিজ্ঞ কৃষকদের বরাতে বাংলাদেশ অর্গানিক প্রোডাক্টস ম্যানুফ্যাকসারাস এসোসিয়েশনের সভাপতি মু. আব্দুস সালাম জানান, ধানের মধ্যে বেশ কয়েকটি স্তর রয়েছে। যার মধ্যে হাস্ক বা তুস সবচেয়ে উপরের স্তর, এটি প্রায় ধানের ২০ শতাংশ। এ ছাড়া তুসের নিচের লাল স্তর বা কুড়া যা ৮ থেকে ১২ শতাংশ। আর মিল রাইছ বা সাদা চাল হলো প্রায় ৬৮ থেকে ৭২ শতাংশ। মূল চালের উপরের স্তরের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ফেলে দিয়ে আধুনিক চাল কলের পলিশিং ব্যবস্থায় পৃথক করে সরু ও সাদা চাল তৈরি করা হচ্ছে। আধুনিক মিলিং প্রযুক্তি চালুর আগে মানুষ ঢেঁকিছাঁটা চাল খেতো। ঢেঁকিছাঁটা চাল ছিল লাল কারণ চালের উপরের লাল স্তর এতে অক্ষুণ্ন্ন থাকত। চালের উপরের লাল স্তরে তেল ও পুষ্টি থাকে। ঢেঁকিছাঁটা ব্যবস্থার পরবর্তী সংস্করণ হলো হলারের মাধ্যমে ধান ছাটাই। এমেশিনে উৎপাদিত চালের লাল স্তরের অস্তিত্ব পুরোপুরি না থাকলেও আংশিক বজায় থাকে। সেসঙ্গে চালের উপরের স্তর ক্ষতিগ্রস্থ না হওয়ায় চালে পুষ্টি ও ফাইবার দুটোই অক্ষুণ্ন থাকে। বর্তমানে মেজর বা অটোমেটিক রাইছ মিল চালু হয়েছে, তাতে চালের উপরের লাল স্তরতো থাকেই না বরং মূল চালের উপরের পুষ্টিযুক্ত স্তরটিও পলিশিং করে পৃথক করা হয়। দেশের মানুষের সরু চালের প্রতি আগ্রহ ও চাহিদা বাড়ছে। এছাড়া বর্তমান প্রজন্ম সাদা চালের সাদা ভাত খেতে পছন্দ করে। ফলে তারা চালের স্বাভাবিক পুষ্টি হতে বঞ্চিত হচ্ছে। এ কারণেই বর্তমানে শিশুদের মাঝে ডায়াবেটিস, দৃষ্টিহীনতা ও অপুষ্টি, কোষ্ঠকাঠিণ্যতাসহ বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধি বাসা বাধঁছে।
এদেশের মানুষ ভাতের মাড় ফেলে দেয় ভাতকে ঝরঝরা রাখার জন্য। অথচ ভাতের মাড় ফেলে দেওয়ায় অনেক পুষ্টি হারিয়ে যায়। এছাড়া চাল অতিরিক্ত ধৌত করায়ও চালের পুষ্টিমান ক্ষুণ্ন হয়। মিলে বা চালকলে স্বচ্ছ ও পরিষ্কার চাল তৈরি ও ভোক্তা সাধারণের সাদা ঝরঝরে ভাত খাওয়ায় একদিকে চালের ঘাটতি ও আমদানি নির্ভরতা বাড়ছে, অপরদিকে পুষ্টিহীন চাল খেয়ে এদেশের মানুষ অপুষ্টিজনিত বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছেন।
খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে এবং চালের অপচয় রোধকল্পে দক্ষিণ কোরিয়াতে একসময় চালের পলিশিং নিষিদ্ধ ছিল। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও মাত্র ৫শতাংশ পলিশিং করা হয়। তাই প্রাকৃতিক দূর্যোগপূর্ণ এদেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে দরকার আশু মিলিং ব্যবস্থাপনা ও জনসচেতনতা। একদিকে সজ্ঞানে চালকে অতিরিক্ত পলিশিং করে পুষ্টিহীন করা হচ্ছে অপরদিকে বিদেশ হতে ভিটমিন ও মিনারেলযুক্ত কেমিকেল কিনে তা দিয়ে কৃত্রিমভাবে চাল তৈরি করে বিদ্যমান চালের সঙ্গে মিশিয়ে দেশের গরিব মানুষের পুষ্টি পূরণের চেষ্টা চলছে। যা দেশি ও বিদেশী অর্থের অপচয় হচ্ছে।
এঅবস্থা হতে উত্তোরনে দরকার যুগপযোগী মিলিং ব্যবস্থাপনা ও জনসচেতনতা। মিলাররা যাতে নির্দিষ্ট মাত্রার বেশি চাল পলিশিং করতে না পারেন এবং ক্রেতারাও যেন বেশি দামে পুষ্টিহীন চাল কিনে প্রতারিত না হন সেলক্ষ্যে আশু মিলিং ব্যবস্থাপনা ও জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।