হার্টের কোটি টাকার চিকিৎসা দেশে হচ্ছে ১০ লাখে
শাহীন খন্দকার : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) বুক না কেটে বা অজ্ঞান না করে প্রথমবারের মতো অ্যাওয়োট্্িরক ভালভ টাভি সফলভাবে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। প্রতিস্থাপনকারী চিকিৎসক হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এস এম মোস্তফা জামান বলেন, টাভি-এর পুরোকথা ট্রান্সক্যাথেটার অ্যাওর্টিক ভালভ ইমপ্ল্যান্টেশন।
ডা. এস এম মোস্তফা জামান বলেন, টাভি পদ্ধতিতে বয়স্ক রোগীর অকেজো হার্ট সচল রাখার জন্যই ‘অ্যাওর্টিক ভালভ’ প্রতিস্থাপন করা হয়। অ্যাওর্টিক ভালভের কাজ সম্পর্কে তিনি বলেন, শরীরের দূষিত রক্ত মহাশিরার মাধ্যমে হৃদযন্ত্রের ডান অলিন্দে প্রবেশ করে। তারপর ট্রাইকাসপিড ভালভের (ত্রিপত্র কপাটিকা) মধ্য দিয়ে ডান নিলয়ে ঢোকে। ডান নিলয় থেকে দূষিত রক্ত সেমিলুনার কপাটিকার মধ্য দিয়ে ফুসফুসীয় ধমনীর মাধ্যমে ফুসফুসে পৌঁছায়। ফুসফুস থেকে বিশুদ্ধ রক্ত ফুসফুসীয় শিরার মাধ্যমে বাম অলিন্দে প্রবেশ করে। বাম অলিন্দ থেকে সেই বিশুদ্ধ রক্ত বাইকাসপিড ভালভ (দ্বিপত্র কপাটিকা) অথবা মাইট্রাল ভালভের মাধ্যমে বাম নিলয়ে প্রবেশ করে। এরপর বাম নিলয় থেকে সেই বিশুদ্ধ রক্ত অ্যাওর্টিক ভালভের মাধ্যমে মহাধমনীতে ঢোকে ও মহাধমনীর মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে।
ডা. জামান আরো বলেন, বাম নিলয় থেকে মহাধমনীতে ঢোকার জন্য যে ভালভ থাকে, সেটাই অ্যাওর্টিক ভালভ। অ্যাওর্টিক ভালভে কোন একস্থানে রক্ত চলাচলে বিঘœ ঘটলে তখনই রক্ত সঞ্চালনের জন্য অ্যাওর্টিক ভালভ কাজ করে।
বয়স বাড়ার সঙ্গে ভালভে ক্যালশিয়াম জমতে থাকে। কারও কারও ক্ষেত্রে ভালভের খোলা মুখের পরিধি কমতে কমতে এক বর্গ সেন্টিমিটার বা তারও কম হয়ে যেতে পারে। ফলে মহাধমনীতে রক্ত ঠেলে পাঠানোর জন্য আরও বেশি বল প্রয়োগ করতে হয় হার্টকে। দেখা দেয় নানাবিধ শারীরিক সমস্যা। সাধারণত ৬০-৬৫ বছর বয়সের পরে অ্যাওর্টিক ভালভের এই ধরনের সমস্যা শুরু হতে পারে।
লক্ষণ সর্ম্পকে ডা. জামান বলেন, হাঁটাচলা করলে রোগীর বুকে চাপ বোধ হয়, ঘুমোতে সমস্যা হয়, এমনকি রোগীর অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। রোগের জটিল অবস্থায় হার্ট ফেলিওর হওয়ার ভয় থাকে।
টাভি কি?
আগে অ্যাওর্টিক ভালভে সমস্যা হলে কিংবা এই ভালভ প্রতিস্থাপন করতে হলে ওপেন হার্ট সার্জারির সাহায্য নিতে হতো। সেক্ষেত্রে রোগীর বুকে প্রায় ৭ থেকে ৮ ইঞ্চি ক্ষত তৈরি হতো। এমনকী অপারেশনের সময় রোগীকে হার্ট-লাং মেশিনের তত্ত¡াবধানে রাখতে হতো। টাভি পদ্ধতিতে কাটাছেঁড়া করার দরকার পড়ে না। এতে রোগীর হাসপাতাল থাকার সময় কমে আসে। রোগী দ্রæত সুস্থ হয়ে ওঠেন। টাভি পদ্ধতি অনেকটা অ্যাঞ্জিওপ্ল্যাস্টি প্রক্রিয়ার মতোই। এক্ষেত্রেও কুঁচকি দিয়ে ফিমোরাল আর্টারিতে ক্যাথিটার প্রবেশ করানো হয়।
এই ক্যাথিটারকে মহাধমনী পথে সরু হয়ে যাওয়া অ্যাওর্টিক ভালভ পেরিয়ে বাম নিলয় পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর ক্যাথিটারের মধ্যে দিয়ে পাঠানো হয় তার। এই তারের উপর দিয়ে পাঠানো হয় বেলুন ক্যাথিটার। বেলুনকে ঘিরে থাকে স্টেন্ট। আর ওই স্টেন্টের ভিতরে সেলাই করা থাকে নতুন ভালভ। পুরনো ভালভের কাছে বেলুনকে নিয়ে যাওয়া হয় ও ফোলানো হয়। বেলুন ফুলে যাওয়ার ফলে ভালভের সরু হয়ে যাওয়া মুখও বড় হয়ে খুলে যায়। এই পদ্ধতিতে বেলুনকে ঘিরে থাকা স্টেন্টও খুলে যায়। আর পুরনো ভালভের জায়গায় প্রতিস্থাপিত হয়ে যায় স্টেন্ট-এর সঙ্গে সেলাই করা নতুন ভালভ।
টাভির উপকারিতা সর্ম্পকে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রোগীর বুকে বড়সড় ক্ষত তৈরি হয় না। দুই থেকে তিনদিনের বেশি হাসপাতালে থাকতে হয় না। ভেন্টিলেশনেও রাখতে হয় না। ফলে বয়স্কদের ক্ষেত্রে অ্যাওর্টিক ভালভ রিপ্লেসমেন্ট-এর ক্ষেত্রে টাভি পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকরী। বিশেষ করে বিভিন্ন বয়স্ক রোগীর একাধিক শারীরিক অসুখ থাকে। এমন রোগীর ক্ষেত্রে ওপেন হার্ট সার্জারি হয়ে পড়ে ঝুঁকিপূর্ণ। এই সকল ক্ষেত্রে টাভি অনেক কম ঝুঁকিপূর্ণ।
বিএসএমএমইউ’র হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এস এম মোস্তফা জামানের নেতৃত্বে ইতিমধ্যে ৮০ বছরের এক বৃদ্ধের বুক না কেটে এবং অজ্ঞান না করেই সফলভাবে অ্যাওরটিক ভালভ (টাভি) প্রতিস্থাপন সম্পন্ন করেন। ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজির ধারাবাহিক সফলতা এই চিকিৎসা নতুন এক মাইলফলক হিসেবে দেখছেন এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।
অ্যাওরটিক ভালভ প্রতিস্থাপন সম্পর্কে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এস এম মোস্তফা জামান বলেন, অপারেশন মানেই ছুরি-কাচি ব্যবহার। ছুরি কাচি ছাড়া বা বুক না কেটে ৮০ বছরের বৃদ্ধের হার্টের অ্যাওরটিক ভাল্ভ সফলভাবে ভাল্ভ প্রতিস্থাপন করে রোগীর জীবন বাঁচাতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের দেশে অনেক রোগী রয়েছেন, এ চিকিৎসা নেওয়ার সক্ষমতা নেই। তবে অর্থ সম্পদশালী, অনেকেই দেশের বাইরে গিয়ে এ চিকিৎসা নিচ্ছেন।
তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও এই প্রক্রিয়াটি ব্যয়বহুল। এই পদ্ধতিটি ‘সহজলভ্য’ করতে সরকারের সহযোগিতা চান বিএসএমএমইউ’র অধ্যাপক ডা. জামান।
তিনি বলেন, ৪০-৫০ লাখ টাকা, সিঙ্গাপুরে, ব্যাংকক, ভারত চীনে প্রায় কোটি টাকা ব্যয় হয়।
বাংলাদেশে বিএসএমএমইউতে এটি করা হয়েছে মাত্র ১০ লাখ টাকায়। তবে আগামীতে ৫ লাখ টাকায় যাতে এ কাজটি করা যায় সেই কাজ চলছে। সম্পাদনা: মাজহারুল ইসলাম