খাবার টেবিলে ফিরে আসছে হারিয়ে যাওয়া সোনালি মহাশোল
মতিনুজ্জামান মিটু : বিপন্ন প্রজাতির সোনালি মহাশোলের কৃত্রিম প্রজনন, পোনা উৎপাদন ও চাষ কৌশলের গবেষণায় বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের হাতে এ সফলতা ধরা দেয়। এদিকে ইনস্টিটিউটের অপর প্রজাতির মহাশোল নিয়ে গবেষণা চলমান রয়েছে।
বাংলাদেশে বিপন্ন প্রজাতির মহাশোল মাছের প্রজনন ও চাষ ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ জানান, আবহমান কাল থেকে মাছ বাংলাদেশের খাদ্য তালিকায় অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। মিঠাপানির মাছের মধ্যে সুস্বাদু মহাশোল মাছ ‘স্পোর্ট ফিশ’ হিসেবে খ্যাত। যা বিলুপ্ত হতে চলেছে।
মহাশোল মাছটি অঞ্চলভেদে মহাশের, মাশোল, টর, চন্দনাসহ নানা নামে পরিচিত। বাংলাদেশে পাওয়া যায় মহাশোলের দুইটি প্রজাতি। একটি লাল পাখনার হিমালয়ের মহাশোল, অন্যটি সোনালী মহাশোল। এক সময় বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় হিমালয়ের নদীগুলোতে প্রচুর পরিমাণে মাছটি দেখা যেত।
বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, সিলেট, দিনাজপুর এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের মিঠাপানির জলাশয়ের খাল, বিল, লেকে একসময় পাওয়া গেলেও নেত্রকোনার পাহাড়ি ঝর্ণার স্বচ্ছ পানি আর সোমেশ্বরী ও কংস নদী মহাশোল মাছের প্রধান আবাসস্থল। দ্রুত আবহাওয়া পরিবর্তন, নদীগুলোর স্বাভাবিক অবস্থা ধ্বংস, নদীতে বাঁধ নির্মাণ, শুকনো মৌসুমে নদী শুকিয়ে মাছ ধরাসহ বহুবিধ কারণে বাসস্থান ও প্রজনন ক্ষেত্র বিনষ্ট হওয়ায় এ মাছের প্রাচুর্যতা ব্যাপকহারে কমে। মাছটির ডিম ধারণক্ষমতা অন্যান্য কার্পজাতীয় মাছের চেয়ে কম। যা মাছটির বিলুপ্তির অন্যতম কারণ। প্রজাতিটিকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে এবং চাষের জন্য পোনার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট মহাশোল মাছের কৃত্রিম প্রজনন, নার্সারি ব্যবস্থাপনা ও চাষের কলাকৌশল উদ্ভাবনে সফলতা অর্জন করে।
স্বাদ, পুষ্টিমান এবং অর্থনৈতিক বিবেচনায় মহাশোল মাছের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। মহাশোল সাধারণত ৫২ সেন্টিমিটার লম্বা এবং ওজন ৯ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। এর দেহ লম্বা, মুখ অধোমুখী অপেক্ষাকৃত ছোট। দেহের বর্ণ উপরের দিকটা বাদামি সবুজ, পেটের দিকটা রূপালী এবং পিঠের পাখনা লালচে বর্ণের হয়ে থাকে। মহাশোল দেখতে খুব সুন্দর, অনেকটা মৃগেল মাছের মতো।
মহাশোলে মানবদেহের জন্য দরকারি আমিষ ও অত্যাবশ্যকীয় খনিজ পদার্থ রয়েছে। পাহাড়ি খর¯্রােতা নদী, ঝর্ণা, লেক এদের মূল আবাসস্থল। শীতকালে এ মাছটি প্রজনন করে থাকে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অন্যান্য মাছের তুলনায় অত্যন্ত বেশি হওয়ায় এ মাছটি সহজে রোগাক্রান্ত হয় না।
পাথরসমৃদ্ধ খর¯্রােতা নদীর তলদেশ এদের প্রধান প্রজনন স্থান। হিমালয় থেকে প্রবাহিত বরফ গলা ঠান্ডা পাহাড়ি নদী, পরিষ্কার অগভীর পানি এবং মৌসুমি বৃষ্টিপাত এদের প্রজননকে উদ্দীপিত করে। উজান ¯্রােতে এরা যুগলবন্দী হয়ে প্রজননে অংশ নেয়। প্রজননকালে স্ত্রী মাছ প্রথমে ডিম ছাড়ে, পরে পুরুষ মাছ তার উপর বীর্যপাত ঘটিয়ে ডিম নিষিক্ত করে। এরা লিঙ্গভেদী। মুখে শক্ত ও প্রলম্বিত গোফ, বিস্তৃত-লম্বা-খসখসে বক্ষ পাখনা আইস পর্যন্ত বিস্তৃত। বক্ষ পাখনাই পুরুষদের আলিজ্ঞনাবদ্ধ করার প্রধান হাতিয়ার। পুরুষ মাছ জন্মের ২য় বছর এবং স্ত্রী মাছ ৩য় বছরে যৌন পরিপক্বতা অর্জন করে। প্রজননকালে অন্যান্য মাছের মতো এরা রঙ বদলায় না, তবে স্ত্রী মাছের পায়ু অঞ্চলটি বেশ নরম এবং হালকা গোলাপি হয়। পুরুষ মাছের আকার স্ত্রী মাছের তুলনায় ছোট হয়।
সাধারণত নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পযন্ত তিন মাস মহাশোল মাছের সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুম। প্রজনন মৌসুমের ১ থেকে ২ মাস আগে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে সুস্থ, সবল ও রোগমু ব্রুড মহাশোল মাছ সংরক্ষণ করতে হবে। সারা বছর পানি থাকে এমন পুকুর (৪ থেকে ৫ ফুট) প্রজননক্ষম মাছের জন্য সবচেয়ে উপযোগী।
উদ্ভাবিত কৌশল অনুসরণ করে ব্যক্তি মালিকানাধীন ও সরকারি মৎস্য হ্যাচারিগুলোতে মহাশোল মাছের পোনা উৎপাদন নিশ্চিত করা সম্ভব। মহাশোল মাছের চাষাবাদ প্রযুক্তি সম্প্রসারণ করা গেলে চাষের মাধ্যমে এতদাঞ্চল তথা দেশে এপ্রজাতির উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে এবং বিপদাপন্ন অবস্থা থেকে এপ্রজাতিকে সুরক্ষা করা যাবে। একই সঙ্গে অনেক দামে বাজারে বিক্রি হওয়া মহাশোলের দাম কমবে।