ঢাকা সিটির বাড়ির ছাদে ১০ হাজার হেক্টর জমির সমান ছাদে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষের অপার সম্ভাবনা
মতিনুজ্জামান মিটু : রুফটপ গার্ডেনিং বা ছাদ কৃষি এদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এক জরিপে দেখা গেছে ঢাকা সিটির সকল বাড়ির ছাদের আয়তন প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমির সমান। সেখানে সফলভাবে ছাদ বাগানে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। ছাদ বাগানে ১ মিটার ও ০.৬ মিটার আকারের ৪টি ট্রেতে ৭০ থেকে ৮০ দিন পর ২.৫ থেকে ৩.০ কেজি গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উৎপাদন করা সম্ভব। যা দিয়ে ৪ থেকে ৫ সদস্য বিশিষ্ট পরিবারের মাসিক পারিবারিক চাহিদা মেটানো সম্ভব। বগুড়া জেলার শিবগঞ্জের মসলা গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. নুর আলম চৌধুরী বিভিন্ন সুত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষের সম্ভাবনা ও সফলতা প্রসঙ্গে জানান, এদেশের পাহাড়ি এলাকায় সমতল ভূমিতে, ছাদ বাগানে, বসতবাড়িতে এবং আন্তঃফসল হিসেবে অন্য ফসলের সঙ্গে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষের যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। দেশের মোট আয়তনের ১ দশমাংশ জমি পাহাড়ি এলাকায়। পাহাড়ি এলাকায় মোট জমির ৬ শতাংশ সমতল। এসমতল জমিতে সহজেই গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ করা সম্ভব। তাছাড়া লেট খরিপে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ করে হেক্টরপ্রতি ৩০ থেকে ৩৫ টন ফলন পাওয়া সম্ভব। ইক্ষু একটি দীর্ঘ মেয়াদি ফসল। বাংলাদেশে প্রায় (১.৫১ লাখ) হেক্টর জমিতে আখ চাষ হয়ে থাকে (বিবিএস, ২০১৯)। ইক্ষু লাগানো থেকে কাটা পর্যন্ত প্রায় ১৪ মাস সময় লাগে। এসময়ে সহজেই ইক্ষুর সঙ্গে আন্তঃফসল হিসাবে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ করা যায়। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ একটি স্বল্প মেয়াদি ফসল। চারা লাগানোর ৬৫ থেকে ৭০ দিনের মধ্যে ফসল সংগ্রহ করা যায়। কাজেই ইক্ষু রোপণের পর থেকে মার্চ-এপ্রিল মাস পর্যন্ত গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ করে ঘাটতি মেটানোসহ ইক্ষু চাষির অতিরিক্ত আয় করা সম্ভব। এ ছাড়া আদা, হলুদ ও মরচিসহ ভুট্টা ও মুখিকচুর সঙ্গে আন্ত:ফসল হিসাবে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ করে অতিরিক্ত পেঁয়াজ উৎপাদন এবং অতিরিক্ত আয় করা সম্ভব।
বসতবাড়িতেও গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। বসতবাড়ির আশেপাশে মাত্র ৫ মিটার ও ২মিটার (১০ হাত ও ৪ হাত) পরিমাণ জায়গা থাকলে একই জমিতে ফেব্রুয়ারি (মাঘ) মাসে চারা লাগিয়ে ১৫ থেকে ২০ কেজি, জুন (জ্যৈষ্ঠ) মাসে চারা রোপণ করে ১৫ থেকে ২০ কেজি এবং সেপ্টেম্বর মাসে চারা লাগিয়ে ২০ থেকে ২৫ কেজি ফলন পাওয়া যায়। এ হিসাবে সারা বছর বারি পেঁয়াজ ৫ জাতের চাষ করে সর্বমোট ৬০ থেকে ৬৫ কেজি ফলন পাওয়া যায়। একটি পরিবারের ৪ থেকে ৫ জন সদস্যর জন্য মাসে গড়ে ৪ কেজি পেঁয়াজ কন্দের প্রয়োজন হয়। সে হিসাবে একটি পরিবারের বার্ষিক পেঁয়াজের চাহিদা ৪৮ কেজি। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উৎপাদনের এপ্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশের প্রতিটি পরিবার নিজেদের বার্ষিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি অতিরিক্ত উৎপাদিত পেঁয়াজ বিক্রি করেও আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারে। বাংলাদেশে প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ (কৃষি ডাইরি ডিএই, ২০২১) বসতবাড়ি আছে। প্রয়োজনীয় বীজ সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে এবং গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উৎপাদনের এপ্রযুক্তিটি যদি বাংলাদেশের ৫০ লাখ বসতবাড়িতে নিবিড় ভাবে সম্প্রসারণ করা যায়। তাহলে ৫০০০ হেক্টর জমি পেঁয়াজ চাষের আওতায় আনা সম্ভব হবে। এতে প্রায় ৩ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হবে। ফলে প্রতিটি পরিবার তাদের চাহিদা মিটানোর পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচন, মহিলাদের কর্মসংস্থান ও পরিবারের আয়ও বাড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি হবে।
ড. মো. নুর আলম চৌধুরী আরও জানান, বাংলাদেশে পেঁয়াজ একটি উচ্চমানের গুরুত্বর্পূণ অর্থকরী মসলা ফসল। এর উৎপত্তিস্থল ইরান, পশ্চিম ভারত উপমহাদেশে এবং মধ্য এশিয়া বলে ধরা হয়। বর্তমানে অধিকাংশ দেশেই কম বেশি পেঁয়াজ এর আবাদ হলেও চীন (২৫শতাংশ) এবং ভারতে (২৩শতাংশ) বিশ্বের মোট উৎপাদনের প্রায় অর্ধেক পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়। পুষ্টিমানের দিক থেকে এ পেঁয়াজ যথেষ্ট পুষ্টিসমৃদ্ধ। পেঁয়াজে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ফাইটোকেমিকেলস, পলিফেনল, হলুদ পেঁয়াজের ফ্লাভেনয়েড, লাল পেঁয়াজের এন্থোসায়ানিন এবং আরও ২৫ ধরনের বিভিন্ন জটিল যৌগ যা মানুষের নানা ধরনের রোগ প্রতিরোধ ও উপশমে সহায়তা করে। পেঁয়াজ এমন একটি ফসল যা কৃষক তার ঘরে রেখে প্রয়োজনে বাজারে বিক্রি করে পরিবারের অন্যান্য প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করে। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষাবাদ বাড়ানোর মাধ্যমে কৃষকদের পারিবারিক আয় বাড়ানোসহ পেঁয়াজের ঘাটতি (১১ থেকে ১২ লাখ টন) অনেকটাই পূরণ করা সম্ভব।
এদেশে প্রায় ২.১৬ লাখ হেক্টর জমিতে প্রায় ২৩.৭৬ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপন্ন হয়। ফলন প্রতি হেক্টরে ১১ টন। উৎপাদিত পেঁয়াজের প্রায় শতভাগ শীতকালে উৎপাদিত হয়। উৎপাদন ও আমদানি বিবেচনায় এদেশের বাৎসরিক পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ৩৫ লাখ টন। এ ৩৫ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে মোট দেশজ উৎপাদন ২৩ থেকে ২৪ লাখ টন হলেও সংগ্রহোত্তর ২৫ থেকে ৩০শতাংশ অপচয়ের ফলে ব্যবহার উপযোগী উৎপাদন দাঁড়ায় ১৭ থেকে ১৮ লাখ টন। বিগত বছরে প্রায় ১১ থেকে ১২ লাখ টন পেঁয়াজের ঘাটতি ছিল, যা বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানির মাধ্যমে মেটানো হয়েছিল। ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে পেঁয়াজ আমদানি করা হয় যথাক্রমে প্রায় ১১ ও ১২ লাখ টন, যার মূল্য প্রায় ৫ থেকে ৬ হাজার কোটি টাকা। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের চাষাবাদ এবং এর আওতায় জমির পরিমাণ বাড়িয়ে ওই ঘাটতি সহজেই মেটানো সম্ভব। কারণ শীতকালীন পেঁয়াজ শুধু শীতকালেই চাষাবাদ করা সম্ভব।