গ্রামীণ সড়ক নির্মাণে সাড়ে ৪ কোটি টাকার পরামর্শক আবদার
অর্থনীতি ডেস্ক : বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে সড়ক ও ঘাট নির্মাণের ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক। অথচ এসব ছোটখাটো কাজের জন্য চাওয়া হচ্ছে কোটি টাকার পরামর্শক। ‘বাগেরহাট জেলার পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন’ প্রকল্প সেগুলোরই একটি। এ প্রকল্পের আওতায় গ্রামীণ সড়ক ও ঘাট নির্মাণকাজে সাড়ে চার কোটি টাকার পরামর্শক ব্যয় দাবি করেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)।
এরই মধ্যে প্রকল্পের ব্যয় প্রস্তাব পৌঁছেছে পরিকল্পনা কমিশনে। মাটি পরীক্ষা, টপো সার্ভে, ডিজাইন, ড্রয়িং কাজে পরামর্শক খাতে ১৫০ জনমাস বাবদ ৪ দশমিক ৫০ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। যদিও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান, পরামর্শকের সংখ্যা, প্রয়োজনীয়তা, ক্যাটাগরি, জনমাস ক্যাটাগরিভিত্তিক ব্যয়সহ অন্যান্য তথ্য বিস্তারিতভাবে প্রকল্প প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়নি। এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন। বলা হচ্ছে, গ্রামীণ সড়ক ও ঘাট নির্মাণ তুলনামূলকভাবে সহজ কাজ। সারাদেশে এ ধরনের কাজ অহরহ হচ্ছে। এসব পুরোনো প্রচলিত খাতে পরামর্শক নিয়োগে বিপুল অর্থের ব্যয় প্রস্তাবকে অযৌক্তিক বলছেন অর্থনীতিবিদেরাও।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে আমরা কঠিন সময় পার করছি। এ মুহূর্তে গ্রামীণ সড়ক ও ঘাট নির্মাণে পরামর্শক সেবার দরকার নেই। এ কাজগুলো দেশীয় এক্সপার্টরাই করতে পারেন।
এ খাতে পরামর্শক ব্যয় অনাকাঙ্খিত ও অপ্রয়োজনীয়। এগুলোর চিন্তা বাদ দেওয়া উচিত। দেশে কিছু সড়ক আছে যেগুলোর সঙ্গে সেতুর সংযোগ নেই। আবার কিছু সেতু আছে যেগুলোর সঙ্গে সড়কের সম্পর্ক নেই। এগুলো দেশীয় পরামর্শক দিয়ে যত্ন সহকারে বাস্তবায়ন করা দরকার। এতে প্রকল্পে পরামর্শক ব্যয়ের সাড়ে চার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।
‘বাগেরহাট জেলার পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পটি সম্পূর্ণ জিওবি অর্থায়নে মোট এক হাজার ১০০ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে জানুয়ারি ২০২২ থেকে জুন ২০২৫ মেয়াদে বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে জেলার ৯টি উপজেলার ৫৫৩ দশমিক ১১৪ কিলোমিটার রাস্তা উন্নয়ন, দুই হাজার ১৯১ মিটার ব্রিজ/কালভার্ট নির্মাণ, ৩৩টি ঘাট নির্মাণ এবং ৪০টি গ্রোথ সেন্টার উন্নয়ন করা হবে। এলজিইডি মনে করে, প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে এ অঞ্চলের পল্লী অবকাঠামোর যেমন উন্নয়ন হবে, একই সঙ্গে যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থাও হবে সহজ, যা কৃষি-অকৃষি পণ্য পরিবহন ও বাজারজাতকরণে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
প্রকল্পে উপজেলা সড়ক উন্নয়নে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় ১ কোটি ৯৮ লাখ টাকা, ইউনিয়ন সড়কে কিলোমিটারপ্রতি ১ কোটি ৪৫ লাখ, গ্রাম সড়ক বিসি দ্বারা উন্নয়ন কিলোমিটারে ১ কোটি ১২ লাখ ও গ্রামীণ সড়ক ইউনি ব্লক দ্বারা উন্নয়ন কিলোমিটারে ব্যয় ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া গ্রাম সড়ক পুনর্বাসন প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় ৬০ লাখ টাকা, উপজেলা সড়কে ব্রিজ নির্মাণ মিটারপ্রতি ১৪ লাখ ও ইউনিয়ন সড়কে ব্রিজ নির্মাণ মিটারপ্রতি ১৩ লাখ, গ্রাম সড়কে ব্রিজ নির্মাণ মিটারপ্রতি ১১ লাখ টাকা ব্যয় বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব একক ব্যয়ের ভিত্তি, বিস্তারিত ডিজাইন ও প্রাক্কলন এবং যৌক্তিকতা প্রকল্পে সংযুক্ত থাকা জরুরি বলে দাবি করেছে পরিকল্পনা কমিশন। একই সঙ্গে প্রকল্পের ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার কথাও বলা হয়েছে।
গ্রামীণ সড়ক ও ঘাট নির্মাণে সাড়ে চার কোটি টাকার পরামর্শক ব্যয় প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (পরিকল্পনা, ডিজাইন ও গবেষণা ইউনিট) মো. আহসান হাবিব বলেন, গ্রামীণ সড়কে অনেক সময় ব্রিজ থাকে, ব্রিজের নকশা ও সুপারভিশনের জন্য এই পরামর্শক ব্যয় ধরা হয়। ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) তৈরির সময় এসব খাতে বরাদ্দের প্রস্তাব রাখা হয়। পরবর্তীসময়ে প্রকল্প নিয়ে সরকারের বিভিন্ন বডি যখন আলোচনা করে, পরিকল্পনা কমিশনের পিইসি সভায় যখন আলোচনা হয়, তখন দেখা
যায় কাটছাঁট করে ৫০ শতাংশও থাকে না। তখন পরামর্শক ব্যয় আলোচনা করে যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনা হয়।
এরই মধ্যে প্রস্তাবিত প্রকল্প নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) একেএম ফজলুল হকের সভাপতিত্বে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। সভায় প্রকল্পের পরামর্শক ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ প্রসঙ্গে একেএম ফজলুল হক জাগো নিউজকে বলেন, এ ব্যয় অবশ্যই কমানো হবে। আমরা দেশের জন্য কাজ করি। দেশের জন্য যা ভালো তা-ই করবো। আমরা এ ব্যয় সম্পর্কে সংশ্লিষ্টদের কাছে জানতে চাইবো।
কমিশন জানায়, রাস্তা উন্নয়ন ও পুনর্বাসনে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনা না হলে এর আগে সমজাতীয় প্রকল্পে কেনা যন্ত্রপাতি এ প্রকল্পে ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রকল্পের প্রস্তাবিত ব্যয় প্রাক্কলন পর্যালোচনায় দেখা যায়, রাজস্ব ব্যয়ের ক্ষেত্রে অর্থ বিভাগের জনবল নির্ধারণ সংক্রান্ত কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসরণ করা হয়নি। অর্থ বিভাগের জনবল নির্ধারণ সংক্রান্ত কমিটির সুপারিশের আলোকে কর্মকর্তা, কর্মচারী, আউটসোর্সিং জনবল এবং যানবাহনের সংখ্যা নির্ধারণ করে সে অনুযায়ী ব্যয় নির্ধারণ ও ডিপিপি পুনর্গঠন করতে হবে মর্মে সভায় মত দেওয়া হয়।
প্রকল্প প্রসঙ্গে কার্যক্রম বিভাগের প্রতিনিধি রুমি তনচংগ্যা বলেন, সরকারি খাতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধন নির্দেশিকা, ২০২২-তে মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামো প্রকল্পে নেই। এমনকি প্রকল্পের অর্থায়ন পরিকল্পনা সংক্রান্ত তথ্যও ডিপিপিতে উপস্থাপনের জন্য একটি ছক সংযোজন করা হয়েছে। প্রস্তাবিত ডিপিপিতে সে অনুযায়ী তথ্য নেই বিধায় এটি সংশোধন করা আবশ্যক। এছাড়া খুলনা বিভাগের জন্য বরাদ্দের মধ্যেই প্রকল্পের ব্যয় বরাদ্দ নির্ধারণ করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে কিছু স্কিম কমানো যেতে পারে।
বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) পরিচালক (উপ-সচিব) সালেহীন তানভীর গাজী জাগো নিউজকে বলেন, সড়ক ও ব্রিজ-কালভার্টের পরিমাণ যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করতে হবে। সে অনুযায়ী ন্যূনতম পরিমাণ ভূমি অধিগ্রহণকল্পে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে মূল্য নির্ধারণ সংক্রান্ত তথ্যসহ প্রত্যয়নপত্র ডিপিপিতে সংযোজন করতে হবে। পরে মালিকানা সংক্রান্ত জটিলতা এড়াতে অধিগ্রহণকৃত ভূমি এলজিইডির নামে নামজারি করা আবশ্যক। ডিপিপির লজিক্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অংশে জরিপ পদ্ধতি এবং যাচাই নির্দেশকসমূহ মূল্যায়ন পদ্ধতি স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে।
৫০ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে প্রাক্কলিত ব্যয়ের যে কোনো প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে করার বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে। এ নির্দেশনা বাস্তবায়নকল্পে ডিপিপি পুনর্গঠনকালে তৃতীয় পক্ষকে প্রতিবেদন দিয়ে ফিজিবিলিটি স্টাডি প্রস্তুত করে ডিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ বিষয়ে সরকারি খাতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধন নির্দেশিকা, ২০২২ অনুসরণ করতে হবে। ফিজিবিলিটি স্টাডিতে যে স্কিমের উল্লেখ থাকবে এর বাইরে অন্য ক্রিমের প্রস্তাব করা যাবে না। সূত্র : জাগোনিউজ