বাংলাদেশের সুপার শপগুলো ২৯ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা করে
অর্থনীতি ডেস্ক : বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মুদি দোকানের চেয়ে সুপার শপ বা চেইন শপে কম দামে পণ্য মিললেও দেশে ভালো মানের নামে উল্টো বাড়তি টাকা গুণতে হচ্ছে ক্রেতাদের।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বলছে, সুপার শপগুলোর অতিমুনাফার কারণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে খোলা বাজারেও। বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে হস্তক্ষেপ করা হবে বলেও জানিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটি। সম্প্রতি বিভিন্ন সুপার শপের বিপণন কেন্দ্র পরিদর্শন করে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা নিত্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যে ১৮ থেকে ২৯ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফার নজির পান।
অন্যদিকে সাধারণ দোকানে মোড়কে লেখা দামের চেয়ে কিছু কম রাখতে পারেন দোকানি। কিন্তু সুপার শপে একই কোম্পানির পণ্য সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যেই বিক্রি হয়। তার উপর যোগ হয় মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট। দেশের সুপার শপগুলোতে নানা কৌশলে পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেওয়া নিয়ে সম্প্রতি শুরু হয়েছে আলোচনা। এ ধরনের বিপণিগুলোয় অতিরিক্ত মূল্যের পেছনে মধ্যস্বত্বভোগী বা ভেন্ডরদের ভূমিকার কথা বলছেন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ- ক্যাবের অনলাইন সাময়িকী ভোক্তা কণ্ঠের সম্পাদক কাজী আব্দুল হান্নান।
তিনি বলেন, পাইকারি বাজার থেকে সরাসরি না কিনে সুপার শপগুলো ভেন্ডরদের হাতে পণ্য সরবরাহের দায়িত্ব দেওয়ায় তারাও একটি মুনাফা করছে, যার বোঝা চাপছে ক্রেতার ঘাড়ে।
প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিভিন্ন শহরে সুপার শপগুলোতে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের (এমআরপি) চেয়েও পণ্যভেদে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্যছাড়ে পণ্য কিনতে পারেন ভোক্তারা।
ভারতের বেঙ্গালুরু শহরে গত ১৪ বছর ধরে বসবাস করছেন রাজা সিংহ। তিনি জানান, শহরে মোর, স্পার, রিলায়েন্স, লুলু মার্টসহ বেশ কিছু সুপার শপ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
প্রতিযোগিতার বাজারে এখানে ক্রেতা আকর্ষণ করার জন্য মূল্যহ্রাসের প্রতিযোগিতা চলে। একটি সুপার স্টোরের লিফলেট হাতে নিয়ে এর মূল্য তালিকা তুলে ধরে তিনি জানান, দাওয়াত বিরিয়ানি ব্র্যান্ডের বাসমতি চালের প্যাকেটের গায়ে দাম লেখা ২২০ রুপি; কিন্তু বিক্রি হবে ১৭৫ রুপিতে।
ট্রপিকানা জুসে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের (এমআরপি) চেয়ে ২০ শতাংশ ছাড় রয়েছে। একইভাবে বুলেট রাইস ৫ কেজির এমআরপি ৯৫০ রুপি হলেও বিক্রি করছে ৭০০ রুপিতে। আশির্বাদ আটা ১০ কেজির প্যাকেট ৫৫২ রুপি; কিন্তু বিক্রি হবে ৪৩৯ রুপিতে।
কম দামে পণ্য বিক্রির আরও কিছু উদাহরণ দিয়ে রাজ সিংহ জানান, হেড অ্যান্ড শোল্ডার্স শ্যাম্পুর এমআরপি ৪৫০ রুপি থাকলেও সুপার শপগুলো তা দিয়ে দিচ্ছে ২৫০ রুপিতে।
এ ধরনের প্রসাধনী পণ্যে রয়েছে বাই ওয়ান গেটওয়ান ফ্রির প্রচুর অফার। তারা কিন্তু লোকসানে বিক্রি করছে না। নিশ্চয় সামান্য হলেও লাভ করছে,- বলেন তিনি। একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন গবেষণার কাজে তিন বছর ধরে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দিদার ইসলাম।
গত অগাস্টে বাজার তদারকি চালিয়ে গুলশানের একটি সুপরিচিত সুপার শপের বিপণন হওয়া পণ্যগুলোর একটি মূল্যতালিকা প্রকাশ করেছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। সেখানে দেখা যায়, কাজী ফার্মের এক ডজন ডিম ১৩৬ টাকায় কিনে ১৫৫ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে, যাতে লাভ হয়েছে ১৮ শতাংশ। প্যারাগন কোম্পানির ব্রাউন ডিম ১৬২ টাকায় কিনে ১৮৫ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে, মুনাফা থাকছে ২২ শতাংশ।
খোলা ডিম প্রতিটি ৯ টাকা ১৮ পয়সায় কিনে ৯ শতাংশ লাভে ১০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। ঢাকার বাজারে ডিমের নিয়মিত দাম প্রতিটি ১০ টাকা থেকে ৯ টাকার মধ্যে।
এমন মুনাফার বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সফিকুজ্জামান বলেন, আপনারা বিজনেস করবেন, প্রফিট করবেন সেটা ঠিক আছে। কিন্তু ২০ শতাংশ মুনাফা মেনে নেওয়া যায় না। ২০ শতাংশ বা ৩০ শতাংশ মুনাফা করাটা আমার দৃষ্টিতে অত্যধিক। এটার নেতিবাচক প্রভাব হচ্ছে- এর প্রভাবে সাধারণ বাজারে এর প্রভাব পড়ে। এসব বিবেচনায় আমরা সুপার শপের মুনাফা প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করব। খোলা ডিমে ৯ শতাংশ আবার প্যাকেট ডিমে আপনারা ২০ শতাংশ মুনাফা করছেন। সুপার শপ স্বপ্নের করপোরেট অ্যাফেয়ার্স বিভাগের কর্মকর্তা তামিম খান বলেন, উৎপাদনকারী ও প্যাকেটজাতকারী কোম্পানি মূল্য নির্ধারণ করে। সেক্ষেত্রে আমাদের কোম্পানির খরচগুলো বিবেচনায় নিয়ে তারা মার্জিন ঠিক করে।
সাধারণ বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে জানিয়ে তিনি বলেন, সুপার শপের এভাবে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব সরাসরি বাজারে পড়ে যাচ্ছে। খোলা বাজারের পণ্যগুলোও সুপার শপের রেফারেন্সে দাম বেড়ে যাচ্ছে। সুপার শপে উচ্চমূল্যের চাল সম্পর্কে তিনি বলেন, আমরা খোঁজ পেয়েছি চালগুলো একই উৎস থেকে আসলেও প্রিমিয়াম কোয়ালিটি, সুপার প্রিমিয়াম কোয়ালিটি নাম দিয়ে আপনারা দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। কিছু কিছু ব্র্যান্ড কেবল সুপার শপেই পাওয়া যায় উল্লেখ করে সফিকুজ্জামান বলেন, এর মানে কী? সুপার শপে বেশি দামে বিক্রি করার জন্যই এগুলো প্যাকেজিং করা হয়েছে। এটাও এক ধরনের মনোপলি আচরণ।