পোশাক রপ্তানিতে দ্যুতি ছড়াচ্ছে অপ্রচলিত বাজার
অর্থনীতি ডেস্ক : যুদ্ধ পরিস্থিতি আর মূল্যস্ফীতির কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের প্রধান বাজার ইউরোপ-আমেরিকা নিয়ে যখন শঙ্কা তৈরি হয়েছে, তখন বিকল্প বাজারে গিয়ে আশার আলো দেখছেন রপ্তানিকারকরা।
চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে অপ্রচলিত বাজারে বাংলাদেশ থেকে ১২০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে বলে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে। এ সময়ে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৩৮ শতাংশ। এ আয় বাড়াতে আরও নতুন পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ। নতুন বাজার ধরার বিষয়টিকে কৌশল হিসেবে নিয়েছেন তারা।
সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই ও অগাস্টে ৭১১ কোটি ২৬ লাখ ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৬ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে অপ্রচলিত বাজারের অংশ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে হয়েছে ১২০ কোটি ডলার। এসময়ে ভারতে রপ্তানি বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। জাপানের বাজারেও ভালো করেছে এদেশের পোশাক।
অপ্রচলিত বাজারে পোশাক রপ্তানি নিয়ে উচ্ছ¡াস প্রকাশ করে বিজিএমইএর সহ সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, ইউরোপে যুদ্ধ, বৈশ্বিক মন্দা ও সর্বোপরি জিওপলিটিক্যাল ক্রাইসিসের কারণে প্রচলিত বাজারে আমাদের পোশাক রপ্তানি কিছুটা স্তিমিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে যখন ওয়ালমার্ট ও এইচঅ্যান্ডএমের মত প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ক্রয়াদেশ ৩০ শতাংশ কমিয়ে দেওয়ার ফলে আমরা স্পষ্টত একটা ইঙ্গিত পাচ্ছিলাম। সেই পরিস্থিতিতে অপ্রচলিত বাজারে পোশাকের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কিছুটা হলেও স্বস্তি দিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোই বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির মূল বাজার। এর বাইরে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো, মধ্যপ্রাচ্য, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, জাপান, কোরিয়া, চীন ও ভারতসহ অন্যান্য দেশকে অপ্রচলিত বাজার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এসব দেশে এতদিন খুব বেশি পোশাক রপ্তানি না হওয়ায় চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসের রপ্তানি আয়ের তথ্যে এ ব্যবসায়ী নেতার মত অন্য রপ্তানিকারকরাও কার্যাদেশ কমার শঙ্কার মধ্যেও আশাবাদী হচ্ছেন। বিজিএমইএর বিশ্লেষণে দেখা যায়, অপ্রচলিত বাজারের মধ্যে অন্যতম জাপানে চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে ২১ কোটি ৭৫ লাখ ডলারের পোশাকপণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা আগের বছর একই সময়ের চেয়ে ২৫ দশমিক ৮১ শতাংশ বেশি। আগের অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানি হয়েছিল ১৭ কোটি ২৯ লাখ ডলারের পণ্য। অপরদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে ভারতে পোশাক রপ্তানি আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৯৮ দশমিক ৯২ শতাংশ বেড়ে ১৮ কোটি ৮২ লাখ ডলার হয়েছে। তবে যুদ্ধের প্রভাবে হোঁচট খেয়েছে রাশিয়ার বাজারে। সেখানে ৫৮ দশমিক ২৯ শতাংশ কমে ২ কোটি ৯০ লাখ ডলারে নেমেছে পোশাক রপ্তানি। আর অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে চীনে ১৩ দশমিক ২১ শতাংশ কমে রপ্তানি ৩ কোটি ৩৮ লাখ ডলারে ঠেকেছে। এসময়ের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলোতে ৩৪৫ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যাতে প্রবৃদ্ধি এসেছে ২৩ দশমিক ২১ শতাংশ। ইইউভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে একক দেশ হিসেবে জার্মানিতে ১৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ, স্পেনে ২৪ দশমিক ৫২ শতাংশ এবং ফ্রান্সে ৩৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ১৪১ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা ২০২১-২০২২ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২০ দশমিক ৫২ শতাংশ বেশি। একইভাবে যুক্তরাজ্যে ৩৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ এবং কানাডায় ১৮ দশমিক ১৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে পোশাক রপ্তানির বিশ্ববাজারে নিজেদের অবস্থান আরও সুসংহত করা ও রপ্তানি ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যে নতুন রূপরেখা তৈরি করেছে বিজিএমইএ। এর মধ্যে অপ্রচলিত বাজারে রপ্তানি বাড়ানো তাদের অন্যতম কৌশল।
ক্লাসিক ফ্যাশন কনসেপ্ট গ্রæপের কর্ণধার ও বিজিএমই সহ সভাপতি শহীদুল্লাহ মনে করেন অপ্রচলিত বাজারে এই সুফল এসেছে সরকার ও সংগঠনের নেওয়া বিভিন্ন কৌশলগত পরিকল্পনার ফল হিসেবে। তাছাড়া চীন থেকে অনেক দেশের সরে আসার প্রবণতাও বাংলাদেশকে পোশাক রপ্তানিতে এগিয়ে যেতে সহযোগিতা করছে বলে তার পর্যবেক্ষণ।
এজন্য এখন অপ্রচলিত বাজারগুলোতে জায়গা করে নিতে বিভিন্ন প্রচার প্রচারণা ও ব্র্যান্ডিং করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। এর অংশ হিসেবে আগামী মাসে জেদ্দায় পোশাক মেলায় অংশ নেবেন উদ্যোক্তারা। এর পরেই রয়েছে কোরিয়ায় আরেকটি মেলা। এসব মেলায় অংশ নিয়ে একদিকে যেমন বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং হচ্ছে, অন্যদিকে রপ্তানির নতুন ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে, যোগ করেন তিনি।
এসব কর্মপরিকল্পনার সুফল পাওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ২০১০ সালে আমরা লাতিন আমেরিকা নিয়ে এই ধরনের একটি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলাম। এর ফলে সেখানে বার্ষিক ৬০০ মিলিয়ন রপ্তানির স্থলে এখন ৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। নতুন নতুন বাজারে ঢোকার চেষ্টা করলেই সফলতা পাওয়া যাচ্ছে। তাদেরও প্রয়োজন আছে, আমাদেরও সক্ষমতা আছে। আমরা একটা রোডম্যাপ তৈরি করেছি, সেই অনুযায়ী কাজ করছি, সেই পথেই হাঁটছি।
দেশের অন্যতম রপ্তানি বাজার ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি ও মন্দার কারণে আগামী মৌসুমের জন্য কার্যাদেশ প্রায় ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কমে এসেছে বলে গত ১০ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে জানান বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান। এ পরিস্থিতিতে পোশাক শিল্পের চলমান উচ্চ প্রবৃদ্ধি আগামী দুই-এক মাসের মধ্যে নেতিবাচক দিকে রূপ নিতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
শুক্রবার বিজিএমইএর পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, যদিও গত বছরের অগাস্টের তুলনায় গত অগাস্টে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে তবুও সূচক ও অনুমানগুলো ইঙ্গিত দেয় যে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং রেকর্ড মুদ্রাস্ফীতি খুচরা ব্যবসাকে প্রভাবিত করার কারণে এই মাস থেকে প্রবৃদ্ধি কমে আসবে।
বেশ কয়েকটি গেøাবাল ব্র্যান্ডের বিক্রি কমে গেছে, তাই তারা আমাদের শেষ পর্যন্ত বর্তমান অর্ডার ও উৎপাদন বন্ধ করে দিচ্ছে। বাজারের এই পরিস্থিতি আমাদেরকে বেশ খানিকটা ভাবাচ্ছে। তবে এর মধ্যেও অপ্রচলিত বাজারে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কিছুটা স্বস্তির ইঙ্গিত। সূত্র : বিডিনিউজ