রাশিয়ার গম কেনায় অনিয়মের অভিযোগ ষড়যন্ত্রমূলক : খাদ্য মন্ত্রণালয়
অর্থনীতি ডেস্ক : রাশিয়া থেকে গম কেনায় অনিয়মের অভিযোগ তুলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল- টিআইবির দেওয়া বিবৃতিকে বিভ্রান্তিমূলক ও ষড়যন্ত্রমূলক দাবি করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। সোমবার খাদ্যমন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবাদ লিপিতে গম কেনা নিয়ে মন্ত্রণালয়ের অবস্থান ব্যাখ্যা করার পাশাপাশি দুর্নীতি বিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থাটির অভিযোগগুলোর জবাব দেওয়া হয়। সেখানে বলা হয়, খাদ্য মন্ত্রণালয় মনে করে, সঠিক তথ্য গোপন করে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠিয়েছে টিআইবি। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে এ ষড়যন্ত্র করছে তারা।
গম আমদানির বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবি ভুল ও অসঙ্গতিপূর্ণ তথ্য সন্নিবেশিত করেছে। জনমনে এধরনের প্রেস বিজ্ঞপ্তি বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। ইউক্রেইন যুদ্ধের মধ্যেই গত ৩১ অগাস্ট রাশিয়া থেকে সরকারিভাবে পাঁচ লাখ টন গম আমদানির অনুমোদন দেয় সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। এক্ষেত্রে প্রতি টনের দাম পড়বে ৪৩০ ডলার। মোট খরচ হবে ২১ কোটি ৫০ লাখ ডলার। সরকার এই গমের দাম রাশিয়াকে ডলারেই পরিশোধ করবে।
টিআইবির বিবৃতিতে বলা হয়, গণখাতের ক্রয় আইন লঙ্ঘন করে রাশিয়া থেকে সরকারি পর্যায়ে (জিটুজি) পাঁচ লাখ টন গম কেনায় তৃতীয় একটি পক্ষকে যুক্ত করা হয়েছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়য়ের প্রতিবাদ লিপিতে বলা হয়, গম ও চাল কেনার ক্ষেত্রে গণখাতের ক্রয় আইনের কোনো লঙ্ঘন হয়নি এবং কোনো তৃতীয় পক্ষকে ক্রয় প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা হয়নি। কয়েকটি গণমাধ্যমের সংবাদে যে তৃতীয় পক্ষের নাম বলা হচ্ছে, তাদেরকে রাশিয়া সরকারের পক্ষ থেকে লোকাল এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তৃতীয় কোনো পক্ষগম কেনার আলোচনা, মূল্যনির্ধারণ ও নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় ছিল না বলে প্রতিবাদ লিপিতে বলা হয়।
জি টু জি কার্যক্রমে সরকার নির্ধারিত কমিটির সদস্যরা (বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের) বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে নেগোসিয়েশন প্রক্রিয়ায় অংশ নেন এবং ৪ ঘণ্টাব্যাপী সভায় সর্বসম্মতভাবে ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেন। নেগোসিয়েশনরে পর খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাবটি ক্রয় কমিটিতে যায়। ক্রয় কমিটি বিস্তারিত আলোচনার পর অনুমোদন দান করে। তারপর খাদ্য মন্ত্রণালয় কার্যাদেশ দেয়। এখানে তৃতীয় কোনো পক্ষের অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। টিআইবির বিবৃতিতে বলা হয়, বিশ্ব বাজারে পড়তির দিকে থাকলেও ওই পক্ষের মাধ্যমে এই গম কেনা হচ্ছে বেশি দামে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত গমের মূল্য ওঠা-নামা করে উল্লেখ করে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবাদ লিপিতে বলা হয়, বেশি দামে গম কেনা হচ্ছে, এমন বক্তব্য সঠিক নয়।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর আন্তর্জাতিক বাজার থেকে গম সংগ্রহ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে বাংলাদেশ। গম আমদানির অন্যতম উৎস ভারত গম রপ্তানিতে নিষেদ্ধাজ্ঞা আরোপ করায় তা আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। অথচ সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম চালানো, নিয়মিত অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনা ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য গম সংগ্রহ খুব জরুরি হয়ে পড়ে বলে জানায় খাদ্য মন্ত্রণালয়। গমের নিরাপত্তা মজুত যেখানে কমপক্ষে দুই লাখ টন থাকার কথা তখন সেটা একপর্যায়ে এক লাখ ২৫ হাজার টনে নেমে আসে। বর্তমান মজুত এক লাখ ২২ হাজার টন।
পার্শ্ববর্তী কোনো দেশ গম রপ্তানি করে না উল্লেখ করে বলা হয়, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা থেকে জিটুজি প্রক্রিয়ায় গম সংগ্রহের চেষ্টা করা হয়েছে। প্রতি ক্ষেত্রে গমের দাম পাঁচশ ডলারের ওপরে হওয়ায় সরকার সেখান থেকে গম কেনায় আগ্রহী হয়নি। এছাড়া অতিদ্রুত গম ক্রয়ের কোনো সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়নি। রাশিয়ার সাথে গম আমদানির প্রথম দরকষাকষি শুরু হয় ২৩ জুন। সে সময়ে রাশিয়া গম সরবরাহে সম্মত হয়নি। তারপর সরকারি পর্যায়ে কূটনৈতিক যোগাযোগ শুরু হয়। তিন মাসের সফল কূটনৈতিক যোগাযোগের পর বাংলাদেশে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত খাদ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করেন।
সাক্ষাতের সময় খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, অতিরিক্ত সচিব, খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত মহাপরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়। গত ২৪ আগস্ট রাশিয়ার সঙ্গে গম আমদানির দ্বিতীয় আলোচনা হয়। তখন রাশিয়ার গমের এফওবি (ফ্রি অন বোর্ড বা পণ্য পৌঁছে দেওয়ার দায়সহ দাম) মূল্য ৩৩০ ডলার ছিল বলে জানানো হয়। প্রতিবাদ লিপিতে বলা হয়, জাহাজ ভাড়া, লোডিং আনলোডিং, বার্থঅপারেটর হ্যান্ডলিং, ইনস্যুরেন্স ও লাইটেনিংসহ সর্বমোট মূল্য নির্ধারণ হয় ৪৩০ মার্কিন ডলার, যা যুক্তিসংগত ও সঠিক। সরকারি ক্রয় কার্যক্রমের সব প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ক্রয় কার্যক্রম অনুমোদন দেওয়া হয়।
এসব গম ধাপে ধাপে আসবে জানিয়ে বলা হয়, একসাথে ৫ লাখ টন গম দেশে এনে সংরক্ষণ করার সক্ষমতা খাদ্য মন্ত্রণালয়ের নেই। অপর দিকে ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে রাশিয়া থেকে গম আনার জাহাজও এমুহূর্তে পর্যাপ্ত নয়। জাহাজ মালিকেরা এ অঞ্চলে জাহাজ দিতে চায় না। রাশিয়া থেকে গম সরবরাহ কার্যক্রম ৪ মাস ধরে চলবে। তৃতীয় ও চতুর্থ মাসে গমের এফওবি মূল্য বৃদ্ধি পেলেও রাশিয়া চুক্তি মূল্যে গম সরবরাহ করবে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এক পূর্বাভাসে বলেছে আগামী বছর বিশ্বে খাদ্য ঘাটতি হতে পারে। সে কারণে জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে আগাম সতর্র্কতা হিসাবে এক সাথে ৫ লাখ টন গম কেনার সিদ্ধান্ত হয় বলে জানায় মন্ত্রণালয়। গত ১৭ সেপ্টেম্বর রাশিয়ার গমের এফওবি মূল্য ছিল ৩৩৪ দশমিক ২৫ ডলার। প্রতিনিয়ত এফওবি মূল্য বেড়ে যাচ্ছে।
প্রতিবাদ লিপিতে বলা হয়, জিটুজি’র পূর্ববর্তী দুইটি আন্তর্জাতিক দরপত্রে গমের ক্রয়মূল্য ছিল যথাক্রমে ৪৭৬ দশমিক ৩৮ ডলার এবং ৪৪৮ দশমিক ৩৩ ডলার। রাশিয়ার রাষ্ট্রায়াত্ত কোম্পানি প্রডিনটর্গ বিতর্কিত উল্লেখ করে ওই কোম্পানিকে কার্যাদেশ দেওয়ার সমালোচনা করেছে টিআইবি। খাদ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে গম রপ্তানির জন্য রাশিয়া সরকার মনোনীত প্রতিষ্ঠান প্রডিনটর্গ।
বাংলাদেশ সরকার প্রডিনটর্গকে মনোনীত করে নাই। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছর থেকে প্রতিষ্ঠানটি জিটুজি ভিত্তিতে বাংলাদেশে গম সরবরাহ করে আসছে। কোম্পানিটি ইতোপূর্বে এক লাখ টন গম চুক্তি অনুয়ায়ী সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়েছে দাবি করে ওই প্রতিষ্ঠানকে কিভাবে পাঁচ লাখ টন গম সরবরাহের কাজ দেওয়া হলো- তানিয়ে প্রশ্ন তুলেছে টিআইবি। রাশিয়া বাংলাদেশকে দীর্ঘদিন ধরে জিটুজি কার্যক্রমে অন্যান্য দেশের মতো গম সরবরাহ করে আসছে জানিয়ে বলা হয়, বিগত ২০২১-২০২২ অর্থবছরে প্রডিনটর্গ ৩ লাখ টন গম যথাসময়ে নিয়মে বাংলাদেশকে সরবরাহ করেছে। ২০২০-২০২১ সালে করোনাকালে ২ লাখ টন চুক্তিবদ্ধ ছিল। প্রতিকূলতার মধ্যে ও তারা এক লাখ টন গম সরবরাহ করে। পূর্ববর্তী ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে প্রডিনটর্গ দুই লাখ টন গম বাংলাদেশকে সরবরাহ করেছিল। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে এবং ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে প্রডিনটর্গ মোট ৪ লাখ টন গম সঠিকভাবে সরবরাহ করেছে।
গমের বাড়তি দামের কারণেই সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ার অন্য একটি দেশ রাশিয়ার খাদ্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ‘প্রডিনটর্গ’ এর সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেছে বলে টিআইবির বিবৃতিতে দাবি করা হয়। খাদ্য মন্ত্রণালয় ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছে, বিশ্বের কোনো দেশ প্রডিনটর্গ’র সঙ্গে চুক্তি করে তা বাতিল করেছে কি না কিংবা কেন করেছে এর বিস্তারিত তথ্য খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে নেই। সূত্র : বিডিনিউজ