
দেশে জনপ্রিয় হচ্ছে কলা গ্র্যান্ড নাইন

মতিনুজ্জামান মিটু : গ্র্যান্ড নাইন (জি৯) এক ধরনের সাগর কলার মতোই উন্নত জাতের কলা। যা স¤প্রতি বাণিজ্যিকভাবে বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সরকারিভাবে মাদারীপুর হর্টিকালচার সেন্টারে জি-৯ কলার টিসুকালচার চারার উৎপাদন ও বিক্রি করা হচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার উইং এর পরিচালক কৃষিবিদ ড. মো. সাইফুল ইসলাম ও এঅধিদপ্তরের সদ্য বিদায়ী অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ মৃত্যুঞ্জয় রায়ের উদ্ধৃতি দিয়ে কৃষি তথ্য সার্ভিসের উপরিচালক (গণযোগাযোগ) ড. শামীম আহমেদ জানান, উচ্চফলন ও অধিক সংরক্ষণকালের কারণে অনেকেই এখন জি- ৯ জাতের কলা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। এজাতের কলার চারা উৎপাদিত হয় টিসু কালচারের মাধ্যমে। সনাতন প্রথায় প্রচলিত জাতের কলা চাষ করতে গেলে রোগমুক্ত চারা সহজে মেলে না। কিন্তু টিসু কালচারের চারা সম্পূর্ণভাবে রোগমুক্ত।
জি৯ একটি ক্যাভেন্ডি জাতীয় কলা। যার প্রজাতি মুছা একুমিনাটা চিকিতা ব্র্যান্ড ইন্টারন্যাশনালের একটি অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক জাতের কলার কারণে একে অনেকে চিকিতা ব্যানানা নামেও ডাকেন। ফরাসী ভাষায় গ্রান্ডনেইনো বা গ্রান্ডনেইনি। কলার আভিধানিক অর্থ লার্জ ডোয়ার্ফ বা বৃহৎ বামন। এর গাছ জায়ান্ট ক্যাভেন্ডিশ জাতের চেয়ে খাটো, কিন্তু ডোয়ার্ফ ক্যাভেন্ডিশ জাতের গাছের চেয়ে লম্বা।
ভারতে ইসরায়েল থেকে ১৯৯৫ সালে জি-৯ কলা আনা হয়, সে দেশে বছরে গড়ে প্রায় ৫০ লাখ জি-৯ টিসু কালচার চারা উৎপাদিত ও রোপন করা হয়, যা মোট কলা চাষের প্রায় ১৭ শতাংশ। বাংলাদেশে এ জাতের কলার চাষ শুরু হয়েছে।
খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় কোনও কোনও ঘেরের পাড়ে স্থানীয় আইট্যা কলা, ঠুটে বা বাংলা কলা, কাচা কলা ইত্যাদি জাতের কলা চাষ করা হয়। এসব স্থানীয় জাতের কলাগাছ লম্বা, বছরে একবার কলা ধরে ও ফলন কম হয়। অনেক সময় গাছ লম্বা হওয়ায় ঝড়-বাতাসে ভেঙে পড়ে। অথচ জি- ৯ জাতের কলায় এসব অসুবিধা নেই। তাই ঘেরের পাড়ে এ জাতের কলা চাষ করে বেশি লাভবান হওয়া যেতে পারে। সারা দেশে মাঠেও এককভাবে বাগান আকারে বাণিজ্যিকভাবে জি-৯ কলার চাষ করা যায়। এক একর এজাতের কলা চাষে প্রায় ৩ লাখ টাকা লাভ হয়।
জি- ৯ কলার বৈশিষ্ট্য- এ জাতের কলার ফলন বেশি, সুস্বাদু ও রোগ প্রতিরোধী। একটি গাছ থেকে সর্বোচ্চ ৩০ কেজি বা ২২০ থেকে ২৪০টি কলা পাওয়া যায়, সেখানে প্রচলিত জাতের কলা পাওয়া যায় সর্বোচ্চ ৬০ থেকে ১২০টি। জি- ৯ দুই বছরে তিনবার ফল পাওয়া যায়। গাছ মাঝারি আকারের (২ মিটার লম্বা) ও শক্ত হওয়ায় ঝড়-বাতাসে সহজে ভেঙে পড়েনা।
এমনকি এ জাতের কলা জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত সহনশীল। গাছ থেকে কলা পাড়ার পর তুলনামূলকভাবে একলা বেশি দিন টিকে থাকে বা নষ্ট হয় না। কাঁদির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সবগুলো কলার আকার এক রকম হয়। পাকা কলার রং আকর্ষণীয় হলুদ, লম্বা ও কম বাঁকানো, কলার গায়ে কোনো দাগ পড়ে না। এসব কারণে বিশ্বব্যাপী ‘জি- ৯’ জাতের কলার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
ল্যাবরেটরিতে টিসু কালচার চারা উৎপাদন : সারাবিশ্বে জি-৯ জাতের কলা সবচেয়ে বেশি চাষ করা হয়। চাষকরা এজাতের কলার বিপুল পরিমাণ চারা টিসু কালচার পদ্ধতিতে উৎপাদন করা হয়। টিসু কালচার বা কোষকলা আবাদ উদ্ভিদ বংশ বিস্তারের একটি পদ্ধতি, যেখানে বীজের পরিবর্তে কোনও উদ্ভিদের এক বা একাধিক কোষগুচ্ছ থেকে জীবাণুমুক্ত পরিবেশে আবাদ মাধ্যমে চারা উৎপাদন করা হয়। কলাগাছের কন্দ বা করম, সাকার বা তেউড়, অসি তেউড় বা সোর্ড সাকার সাধারণত রোপণ দ্রব্য হিসেবে লাগানো হয়। এর বদলে গাছের কোষ বা টিসু ব্যবহার করা হয় চারা উৎপাদনের জন্য। সুস্থ, নীরোগ ও উন্নতমানের পরীক্ষিত মাতৃকলাগাছের কোষ বা মেরিস্টেম নিয়ে অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরিতে কৃত্রিম উপায়ে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে টেস্ট টিউবের মধ্যে কলার টিসু কালচার চারা উৎপাদন করা হয়। এভাবে হাজার হাজার চারা ল্যাবরেটরিতে ঘরের মধ্যে উৎপাদন করা যায়। টেস্ট টিউবে উৎপাদিত ছোট চারাকে পরে পলিব্যাগে লালনপালন করে বড় করা হয়।
ল্যাবরেটরিতে টিসু কালচার চারা উৎপাদন করা ব্যয়সাধ্য ও অনেক কারিগরি বিষয় সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকতে হয়। কিন্তু যে কেউ চাইলে নিজের বাড়িতেও টিসু কালচার চারা উৎপাদন করতে পারেন। অবশ্যই সেসব চারা কখনোই ল্যাবরেটরিতে উৎপাদিত চারার মতো শতভাগ রোগমুক্ত হবে না, কিন্তু প্রচলিত পদ্ধতিতে চারা উৎপাদনের চেয়ে অনেক ভালো এবং একটি গাছ থেকে অনেকগুলো চারা উৎপাদন করা যায়।
টিসু কালচার পদ্ধতিতে অল্প সময়ের মধ্যে একসঙ্গে প্রচুর চারা তৈরি করা যায়। সম্পূর্ণ রোগমুক্ত চারা পাওয়া যায়। এমনকি চারা লাগানোর পরও শুধু সিগাটোকা রোগ ছাড়া আর তেমন কোনও রোগ হয়না। মাত্র ৮ থেকে ৯ মাসের মধ্যে কলা পাওয়া যায়, যেখানে অন্য জাতের কলা পেতে ১১ থেকে ১৫ মাস অপেক্ষা করতে হয়।
অন্য জাতের চেয়ে ফলন দেড় থেকে দ্বিগুণ বেশি। একটি কাঁদির ওজন ৩০ কেজি পর্যন্ত হয়। একসঙ্গে ফল আসে ও একসঙ্গে সব কাঁদি কাটা যায়। বছরের যে কোনও সময় একলার চারা লাগানো যায়। তবে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রæয়ারি মাস পযন্ত চারা রোপণের জন্য সবচেয়ে ভালো সময়। এক একর ঘেরের চারদিকের পাড়ে রোপণের জন্য প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০টি চারা লাগবে। একক বাগান আকারে মাঠে এ কলার চাষ করলে ১ একর জমিতে ১৪০০ থেকে ১৫০০টি চারা লাগানো যায়। স্বাভাবিকভাবে গাছ কাঁদির ভার সইতে পারে, তবে কাঁদি খুব বড় হয়ে গেলে বাঁশ দিয়ে ঠেকনা দেওয়া ভাল।
