৪ বছরে বৈদেশিক ঋণে পরিবর্তনশীল সুদহারের ঋণের অংশ বেড়ে দ্বিগুণ
অর্থনীতি ডেস্ক : মাথাপিছু আয়সহ দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারণে বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে উন্নয়ন সহযোগীরা এখন বাজারভিত্তিক ঋণ দিতে বেশি আগ্রহী। এ কারণে গত চার বছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণে পরিবর্তনশীল সুদহারের ঋণের পরিমাণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডির) হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণের ২৩ শতাংশের খানিকটা বেশি ছিল বাজারভিত্তিক ঋণ, ২০১৮ সালে যা ছিল ১১.৬ শতাংশ। বাজারভিত্তিক ঋণের সুদহার নির্ধারণ করা হয় লাইবর (লন্ডন ইন্টারব্যাংক অফার্ড রেট), সোফর (দ্য সেকিউরড ওভারনাইট ফিন্যান্সিং রেট) ইউরিবর-এর (ইউরো ইন্টারব্যাংক অফার্ড রেট) ভিত্তিতে। ইআরডির কর্মকর্তারা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএসকে) জানিয়েছেন, পাইপলাইনে থাকা উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণ প্রস্তাব পর্যালোচনায় দেখা গেছে যে আগামী বছরগুলোতে এ ধরনের পরিবর্তনশীল সুদহারের ঋণ ক্রমেই বাড়বে।
তারা বলেন, বাজারভিত্তিক ঋণ বাড়া মানেই আগামী বছরগুলোতে সুদের অর্থ পরিশোধ করার পরিমাণও বেড়ে যাওয়া। বর্তমানে বাজারভিত্তিক ঋণের সুদহার এক বছর আগের তুলনায় অনেক বেশি, এবং শীঘ্রই এ হার কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই পরিস্থিতিতে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে কৌশলী হতে হবে। তারা বলছেন, এখন বাংলাদেশের উচিত বাজারভিত্তিক সুদ এড়িয়ে চলা এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বাজার স্থিতিশীল হওয়ার আগপর্যন্ত যত বেশি সম্ভব স্থির (ফিক্সড) সুদহারের ঋণ নেওয়ার চেষ্টা করা। লন্ডনের এক ব্যাংক আরেক ব্যাংককে যে সুদহারে ঋণ দেয়, তা-ই লাইবর। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বড় আকারের ঋণ দেওয়া-নেওয়ার ক্ষেত্রে সারা বিশ্বেই লাইবর প্রথা অন্যতম মানদÐ হিসেবে স্বীকৃত। বর্তমানে লাইবর রেট ৩.৬ শতাংশের বেশি। অথচ এক বছর আগেও লাইবর রেট ১ শতাংশের কম ছিল। অর্থাৎ সা¤প্রতিক সময়ে লাইবর রেট বেড়েই চলছে। অন্যদিকে বর্তমানে সোফর রেট ২.৫ শতাংশের এর বেশি। আগামী কয়েক বছরে সোফর রেট কমার কোনো সম্ভাবনা নেই।
গত অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের আউটস্ট্যান্ডিং বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫৬.৬৬ বিলিয়ন ডলার। পরিবর্তনশীল সুদহারের ঋণের কারণে বৈদেশিক ঋণ কীভাবে ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে, তা বোঝানোর জন্য বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের যমুনা রিভার ইকোনমিক করিডোর ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম-এর উদারহণ দেওয়া যাক। এই প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক থেকে বাজারভিত্তিক সুদে ১৪০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক ঋণদাতা সংস্থাটি এ প্রকল্পে বাংলাদেশকে সোফর প্লাস ১.০৯ শতাংশ সুদহারে ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব করছে। এর সঙ্গে কমিটেমেন্ট ও অন্যান্য ফি যোগ হবে।
এতে দেখা যাচ্ছে, এই ঋণে সব মিলিয়ে ৪ শতাংশের বেশি সুদ দিতে হবে। অন্যদিকে এই প্রকল্পে যদি বিশ্বব্যাংকের নমনীয় সুদহারে বা স্থির সুদহারে ঋণ নেওয়া যায়, তাহলে সুদের হার ২ শতাংশ অতিক্রম করবে না বলে জানিয়েছেন ইআরডির কর্মকর্তারা। এতদিন বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে উন্নয়ন সহযোগীরা পরিবর্তনশীল সুদহার (ইন্টারেস্ট রেট ক্যাপ) বেঁধে দিত। বিশ্বব্যাংক ও এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবিসহ) আর এই সুবিধা দেবে না। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকও (এডিবি) এ পথে হাঁটবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে ২০২৪ সাল পর্যন্ত লাইবর ও সোফর রেট ঊর্ধ্বমুখী থাকার আশঙ্কা রয়েছে। তাই আগামী দুই-তিন বছর বিশ্বব্যাংকের রেগুলার আইডিএ উইন্ডো ফিক্সড রেটের ঋণ বেশি নিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, একইভাবে এডিবির ২০ শতাংশের স্থির সুদের ঋণ আগে নিয়ে নিতে হবে। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পরিবর্তনশীল সুদহারের ঋণের দিকে যাওয়া যাবে। এদিকে ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বব্যাংকের আইডিএ২০ প্যাকেজের আওতাধীন স্থির সুদের নমনীয় ঋণ কমার পাশাপাশি পাশাপাশি বাজারভিত্তিক ঋণ হারের পরিমাণ বাড়বে।
বহুপাক্ষিক ঋণদাতা সংস্থাটি ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা আইডিএ২০-তে বাংলাদেশকে কোর আইডিএর নমনীয় ঋণ থেকে ২.৪৫ এসডিআর (স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস) বা ৩.২ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে। আইডিএ১৯-এ বাংলাদেশ নমনীয় সুদে ঋণ পেয়েছিল ৩.৩৫ বিলিয়ন ডলার। ফলে আগামী তিন বছরে বিশ্বব্যাংকের স্থির সুদহারের নমনীয় ঋণ বাড়ছে না। আইডিএ১৯-এর মোট ঋণের ১৩ শতাংশ ছিল বাজারভিত্তিক। বর্তমান আইডিএ২০ ঋণে অনুপাত এখনও নির্ধারিত না হলেও ইআরডির কর্মকর্তারা ধারণা করছে, আগামী তিন বছরে এই বাজারভিত্তিক ঋণ দ্বিগুণের বেশি হবে।
এতদিন বাংলাদেশের জন্য বাজারভিত্তিক ঋণের ক্ষেত্রে ঋণের সুদহা বেঁধে (ইন্টারেস্ট রেট ক্যাপ) দিত বিশ্বব্যাংক। এখন আর ক্যাপ থাকবে না। ক্যাপ উঠে যাওয়ার ফলে সুদহারের ঝুঁকি আরও বাড়বে।
এদিকে বাংলাদেশের জন্য এডিবি ঋণের যে পাইপলাইন ঘোষণা করেছে, তাতে যাতে দেখা যাচ্ছে ২০২৩ সালে ৩.১৬৪ বিলিয়ন ডলার ঋণের প্রস্তাব রয়েছে, যার মধ্যে ৬৪.৫৭ শতাংশ বাজারভিত্তিক ঋণ এবং ৩৫.৪২ শতাংশ হলো স্থির ২ শতাংশ সুদহারের ঋণ। অন্যদিকে ২০২৪ সালের জন্য ৩.২২ বিলিয়ন ডলারের ঋণপ্রস্তাবের মধ্যে ৭৬,৩৯ শতাংশ হলো বাজারভিত্তিক এবং ২৩.৬ শতাংশ নমনীয় সুদহারের ঋণ।
ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, একসময় সুদের হার এডিবি নির্ধারিত ২ শতাংশের বেশি ছিল। কিন্তু ঋণের পরিমাণ বাড়তে থাকায় এডিবি বাজারভিত্তিক ঋণের দিকে যায়। তবে বাজারভিত্তিক ঋণে এতদিন সমস্যা হতো না, কারণ লাইবর রেট কম ছিল। এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) ২০১৬ সালে কার্যক্রম শুরুর পর থেকে সবসময় বাজারভিত্তিক সুদে বাংলাদেশকে ঋণ দিয়ে আসছে। বহুজাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাটি বাংলাদেশকে স্থির সুদের ঋণ দেয় না।
ইআরডি, অর্থ বিভাগ ও পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করা সাবেক সচিব আরাস্তু খান বলেন, বিশ্বব্যাংকের আইডি ঋণের মতো নমনীয় ঋণ নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে কোনো সমস্যা নেই। তবে আমাদের ডেবট সার্ভিসিংয়ের ঝুঁকি বাড়াবে পরিবর্তনশীল সুদহারের ঋণ। বিশ্বব্যাপী ঋণের সুদহার বাড়ছে। তাই এ পরিস্থিতিতে বৈদেশিক ঋণের প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষকে আরও সতর্ক হতে হবে। সাবেক এই সচিব মন্তব্য করেন, আগে অনেক হিসাবনিকাশ করে বৈদেশিক ঋণ নেওয়া হতো। কিন্তু এখন কমগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পও বৈদেশিক ঋণে বাস্তবায়ন হচ্ছে।
পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট অভ বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, এই মুহূর্তে উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে আলোচনায় গিয়ে স্থির সুদহারের ঋণের অংশ বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। উন্নয়ন সহযোগীদের শর্ত অনুযায়ী ভাসমান সুদহারে কিছু ঋণ আমাদের নিতেই হবে। সেক্ষেত্রে এমন প্রকল্প নিতে হবে যেগুলো থেকে অর্থনৈতিক সুফল আসবে। পদ্মা রেল সংযোগের মতো প্রকল্প, যেখানে ঋণের অর্থ কবে উঠে আসবে তার নিশ্চয়তা নেই, এ ধরনের প্রকল্প নেওয়া যাবে না বলে মত দেন তিনি। লাইবর বা সোফর রেট আরও কিছু দিন বাড়বে। বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি কমে গেলে সুদহারও কমে যাবে। লাইবর বা সোফর রেট যত দ্রæত বাড়ছে, তত দ্রæতই কমে যাবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। সূত্র : টিবিএস