ডেঙ্গুর হাত থেকে বাঁচতে পেঁপেঁ পাতার রসের জুড়ি মেলা ভার
মতিনুজ্জামান মিটু : পেঁপে পাতার রস হয়ে উঠছে ডেঙ্গু রোগীদের নিদেনের উপায়। তাই এপাতার রস হয়ে উঠেছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের জন্য মহাঔষধ। ইদানিং নিরুপায় হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অনেক রোগীকেই পুষ্টি ও ঔষধীগুণে ভরপুর পেঁপেঁ পাতার রস খেতে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। আক্রান্তদের প্রায় সবাই এ পেঁপেঁ পাতার রস খাওয়ার ২ থেকে ৩ দিনের মধ্যেই নিরাময় হয়ে বাড়ি ফিরে যেতে সক্ষম হয়েছেন। বাংলাদেশ ফলিত পুষ্টি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (বারটান) এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জ্যোতি লাল বড়–য়া এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের পুষ্টি ইউনিটের বিদায়ী পরিচালক ও পুষ্টিবিদ ড. মো. মনিরুল ইসলামসহ চিকিৎসকদের মতে ডেঙ্গু হলে প্লাটিলেট কমতে শুরু করে, পেঁপে পাতার রস এটি বাড়াতে সাহায্য করে। এছাড়া পেঁপে পাতায় রয়েছে অ্যান্টি-ম্যালেরিয়া উপাদান। এতে থাকা এসিটোজেনিন যৌগ ডেঙ্গুর পাশাপাশি ম্যালেরিয়া সারিয়ে তুলতেও সাহায্য করে।
প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জ্যোতি লাল বড়–য়া বলেন, আমি এবং আমার মেয়ে সুস্মিতা বড়–য়া ও ছোট ছেলে সহৃদ বড়–য়া হাসপাতালে চিকিৎসাধিন থাকাকালে পেঁপেঁ পাতার রস প্রতিদিন চা চামচের ৫ থেকে ৬ চামচ করে কয়েকবার খেয়ে দু’দিনের মধ্যে সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফিরেছি। পুষ্টিবিদ ড. মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, আয়ুর্বেদ গবেষণায় ডেঙ্গু রোগীরা পেঁপেঁ পাতার রস খেয়ে দ্রæত সুস্থ্য হয়ে ওঠেন। অনেক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন নামের পাপাইয়া ক্যাপসুল তৈরী করে বাজারজাত করেছে। অনেক চিকিৎসক তা ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় খাওয়ার নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। অনেকে গন্ধ এড়াতে এক্যাপসুল খেতে সচ্ছন্দ বোধ করেন। তবে হালকা গরম পানিতে ভালভাবে পরিস্কার করে সরাসরি পেঁপেঁ পাতার রস দিনে কয়েকবার অল্প অল্প করে ৭দিন খেলে ডেঙ্গু রোগীরা সুস্থ্য হয়ে ওঠেন। রাজধানীসহ দেশের নানা জায়গায় বেড়েছে ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ। তেজগাঁও এর এম এইচ শমরিতা হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজসহ ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল এরোগীতে ভরে উঠেছে। পেঁপেঁ পাতা গরম পানিতে ভাল করে ধুয়ে পরিস্কার করার পর জুস করে খেলে ডেঙ্গু রোগ সেরে বলে রোগীদের অনেকে জানিয়েছেন।
এদিকে ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডসহ দেশের বিভিন্ন আয়ুর্বেদ ও হোমিওপ্যাথিকই নয়, ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডসহ অ্যালোপ্যাথিক ঔষধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেকেই হারবাল পাপাইয়া ক্যাপসুল তৈরী করে বাজারজাত করেছে। ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডের পাপাইয়া ২৫০ হারবাল পাপাইয়া ক্যাপসুল সম্পর্কে জানানো হয়, কারিকা পাপাইয়া লিফ এক্সট্রাক্ট রোগ সমুহের নির্দেশনা মতে, ডেঙ্গুজ্বর থেকে উদ্ভূত থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া(প্লাটিলেট সংখ্যা কমে যাওয়া) এবং কেমোথেরাপি হতে সংঘটিত থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া(প্লাটিলেট সংখ্যা কমে যাওয়া)। কারিকা পাপায়া উদ্ভিদ গোত্রের কারিকাসিয়া গণের অন্তর্গত বাণিজ্যিকভাবে বিশ্বব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ একটি ফসল। প্রচুর গবেষণা হয়েছে এউদ্ভিদটির পাতা, ফল, ফলের খোসা, বীজ, কান্ড, মূল ও তরুক্ষির সহ বিভিন্ন অংশের ওপর। বিবেচনা করা হয়, পেঁপেঁ পাতা নন টক্সিক। কারণ এর লিথাল ডোজ হচ্ছে, ১১৫ গ্রাম/বডিওয়েট। ইঁদুরের ওপর প্রিক্লিনিক্যাল স্ট্যাডিতে দেখা যায়, পেঁপেঁ পাতার রস গুড়া রক্তের প্লাটিলেট বাড়ানোর উৎসাহব্যাঞ্জক কার্যকারিতা দেখায়। সাম্প্রতিকালের ইন-ভিট্রো(ল্যাবরেটরি) গবেষণায় দেখা যায়, কারিকা পাপায়া লিফ এক্সট্র্যাক্ট উল্লেখযোগ্যভাবে হেমোসাইটিস বন্ধ করে এর মেমব্রেইন স্ট্যাবিলাইজিং সামর্থের মাধ্যমে।
ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকেরমতে, পেঁপে পাতায় রয়েছে অ্যাচেটোজেনিন নামের এক ধরণের উপাদান। যা ক্যান্সার কোষকে নষ্ট করে ফেলতে সক্ষম। শুধু তাই নয়, কোমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমাতেও পেঁপে পাতার রস অত্যন্ত কার্যকরী।
বোল্ডস্কাই বাংলার মতে, সবজি হিসেবে কাঁচা পেঁপে কিংবা ফল হিসেবে পাকা পেঁপেতে রয়েছে নানাবিধ স্বাস্থ্য উপকারিতা। এমনকি পেঁপের বীজও পুষ্টিগুণে ভরপুর। তবে অনেকেই জানেনা পেঁপে পাতায় কি গুণ রয়েছে?
স্বাস্থ্যের জন্য পেঁপে পাতার রস বা জুস যেমন উপকারী তেমনি ত্বকের জন্যও। পেঁপে পাতায় রয়েছে পাপাইন, যা হজমে সাহায্য করে। পেট ফুলে যাওয়া এবং অন্যান্য হজম সংক্রান্ত ব্যাধি প্রতিরোধ করে। হজমের পাশাপাশি কারপেইনের মতো শক্তিশালী যৌগ খুশকি ও চুল পড়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখে। এছাড়া পেঁপে পাতায় ভিটামিন এ, সি, ই, কে ও বি এবং ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, সোডিয়াম ম্যাগনেশিয়াম ও আয়রন প্রচুর পরিমাণে থাকে।
ডেঙ্গু ছাড়াও লিভার পরিস্কার রাখতে, হজমে সহায়তা, রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে, মাসিকের ব্যথা নিরাময়ে, ক্যানসার প্রতিরোধে, ত্বক ও চুলের সমস্যা নিরসনসহ নানা রোগ সারতে পেঁপেঁ পাতার রস অব্যর্থ ঔষধ হিসেবে কাজ করে বলে বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। লিভার পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে পেঁপে পাতার রস। এই রস নিয়মিত খেলে লিভারের অনেক সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। জন্ডিস এবং লিভার সিরোসিস হওয়ার ভয় অনেকটাই কমে।
পেঁপে পাতায় থাকা এনজাইম প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেড এবং মিনারেল ভেঙে হজমে সাহায্য করে। এর উচ্চ অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান পেট এবং মলাশয়ের প্রদাহ কমায়। পেঁপে পাতার রস আলসার নিরাময়ে সহায়ক।
রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে অর্থাৎ ডায়াবেটিসে দারুণ কাজ করে পেঁপে পাতার রস। এটি ইনসুলিন উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে, ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা ঠিক থাকে। এর অ্যান্টি অক্সিডেন্ট উপাদান কিডনি ড্যামেজ এবং ফ্যাটি লিভারের মতো ডায়াবেটিসের ফলে যে জটিলতা দেখা দেয় তা কমিয়ে আনতে সহায়তা করে। মাসিক বা পিরিয়ডের সময় পেটের যন্ত্রণা যন্ত্রণা সবারই হয়। পেঁপে পাতার রস খেলে এব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এই রস হরমোন এবং মাসিক চক্র ঠিক রাখতে সহায়তা করে।
পেঁপে পাতায় থাকা এসিটোজেনিন যৌগ অ্যান্টি-ক্যানসার উপাদান। এথনোফার্মাকোলজির জার্নালের গবেষণা মতে, পেঁপে পাতায় থাকা এনজাইমগুলো লিভার ক্যানসার, ফুসফুসের ক্যানসার, অগ্ন্যাশয় ক্যানসার এবং স্তন ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে। পেঁপে পাতার অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান প্রদাহ এবং কেমোথেরাপির পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া কমাতে সহায়ক হতে পারে।
ত্বক এবং চুলের সমস্যা দূর করতে পেঁপে পাতার রসে ভিটামিন সি এবং এ থাকে, যা ত্বকের স্বাস্থ্য ভালো রাখে এবং উজ্জ্বল ত্বক দেয়। এপাতার রস ফ্রি র্যাডিক্যালসের ক্রিয়াকে দমন করে। এছাড়া এতে থাকা কারপাইন যৌগ ব্রণ থেকে সুরক্ষা দেয়। পাশাপাশি চুল পড়া, চুল পাতলা হয়ে যাওয়া প্রতিরোধ করতে সহায়ক পেঁপে পাতার রস। খুশকি দূর করতেও দারুণ কাজ করে।
ভারতীয় গণমাধ্যম সূত্র মতে, কলকাতাসহ গোটা পশ্চিম বঙ্গ রাজ্যে ডেঙ্গু আতঙ্ক থাবা বসিয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় থাবা বসিয়েছে মশাবাহিত এই রোগ। ইতিমধ্যেই এরোগে প্রাণ হারিয়েছেন বেশ কয়েকজন, আক্রান্ত বহু। আর তাই রীতিমতো আতঙ্কিত রাজ্যবাসী। খোঁজ চলছে কীভাবে প্রতিকার পাওয়া যায় এরোগের হাত থেকে? এর মধ্যেই সামনে এসেছে পেঁপে পাতার রসের তত্ত¡। যা কিনা বাড়াতে সাহায্য করবে রক্তের প্লেটলেটের পরিমাণ।
সেখানকার বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেঙ্গুর জীবাণু ও প্লেটলেটের গঠন প্রায় একরকম। তাই ডেঙ্গু সেরে যাওয়ার সময় রোগীর শরীরে প্লেটলেট হুহু করে কমতে থাকে। চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের একাংশের মতে, মানুষের শরীরে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি ডেঙ্গু জীবাণুকে মারতে গিয়ে প্লেটলেটকে মারে, তৈরি হয় সমস্যা। প্লেটলেট বাড়াতে ডাক্তারদের একাংশই তাই পেঁপে পাতার রস প্রেসক্রাইব করছেন। তাদের একাংশের দাবি, অ্যালক্স ১২ নামে জিন রক্তে প্লেটলেটের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে। পেঁপে পাতার রস এই জিনকেই প্লেটলেট উৎপাদনে প্রভাবিত করে। শুধু আয়ুর্বেদ চিকিৎসকরাই নন, অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসকরাও পেঁপে পাতার রস থেকে তৈরি ক্যাপসুল প্রেসক্রাইব করছেন।
যদিও ডাক্তারদের একাংশের মত, পেঁপে পাতার রসের কার্যকারিতা এখনও ‘ক্লিনিক্যালি’ প্রমাণিত হয়নি। তবে, কাজ যে হয় না তা নয়। তবে সমস্যা রয়েছে। অনেকে পেঁপে পাতা ঠিকমতো পরিষ্কার না করেই রস তৈরি করে খাচ্ছেন। পরিমাণেরও ঠিক নেই। রক্তে শর্করার পরিমাণ হঠাৎ করেই নেমে গিয়ে ‘হাইপোগøাসিমিয়া’ হচ্ছে। কখনও আবার ডায়েরিয়া। পেঁপে পাতার রস থেকে তৈরি ক্যাপসুল নিয়মমাফিক খেলে সমস্যার সম্ভাবনা কমে। এমনই পর্যবেক্ষণ মেডিসিন চিকিৎসক ডা. অরিন্দম বিশ্বাসের। তাঁর মতে, জিনের তত্ত¡টা যে ভুল তা এখনও প্রমাণিত হয়নি। তাই রোগীর পরিবার চাইলে পেঁপে পাতার রস থেকে তৈরি ক্যাপসুল অনেকেই দিচ্ছেন।
ভারতীয় আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞ প্রদ্যেৎবিকাশ কর মহাপাত্র জানান, গবেষণায় প্রমাণিত, পেঁপের বীজে ‘লার্ভিসাইডাল এফেক্ট’ রয়েছে। যা ডেঙ্গু ভাইরাসকে মারতে সাহায্য করে। ‘মলিক্যুলার ডকিং’ করে দেখা গেছে, পেঁপে পাতার রস অ্যান্টি ভাইরাল। আসলে, ভাইরাস প্লেটলেটের মেমব্রেনকে নষ্ট করে দেয়। পেঁপে পাতার রস মেমব্রেনকে শক্তিশালী করে। ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করার জন্য প্লেটলেটকে বাড়তি শক্তি জোগায়। বাড়ায় সেকেন্ডারি ইমিউনিটি।
হোমিওপ্যাথিক মেডিসিন কারিকা পাপাইয়া। এহোমিওপ্যাথিক ঔষধটিই সবার আগে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রæভিং করা হয়। সেহিসাবে অনেকে এই ঔষধটিকে ভারতীয় ঔষধও বলে থাকে। ডা. ডি, এন রায় কারিকা পাপাইয়া হোমিওপ্যাথিক ঔষধটি প্রæভিং করেন। এঔষধটি পাকা পেঁপে থেকে তৈরী করা হয়।