কোম্পানিগুলো আগে থেকেই ছিল মরণদশায় করোনা তাদের মৃত্যুকে কেবল ত্বরান্বিত করেছে
অর্থনীতি ডেস্ক : অনেক ছোট ব্যবসাই করোনার ধাক্কা সামলাতে পারেনি। এছাড়া মূল্যস্ফীতি, গ্যাসের ঘাটতি এবং রেকর্ড পরিমাণ জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে অনেক ব্যবসা এখনো ক্ষতির মুখে রয়েছে। ২০১৮, ২০১৯, ২০২০, ২০২১ এবং ২০২২ অর্থবছরে অবসায়ন হওয়া কোম্পানির সংখ্যা ১০৮, ১৩১, ৯৩, ১৪৩ এবং ২৮১।
বিগত কয়েক বছরে করোনা মহামারিতে মানুষের পাশাপাশি মৃত্যু ঘটেছে বেশকিছু কোম্পানিরও। ফুটওয়্যার অ্যাকসেসরি-নির্মাতা ইনারবিডি প্রোডাক্টস লিমিটেড এবং পোশাক রপ্তানিকারক মিডলি ফ্যাশন লিমিটেডের মতো কোম্পানি রয়েছে এ তালিকায়। দুটি কোম্পানিই ভুগছে উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে। রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানি অ্যান্ড ফার্ম এখন আরও ২০৮টি লিকুইডেশন রিকুয়েস্ট বা অবসায়ন আবেদন প্রক্রিয়া করছে।
মালিকানা সংকট, অভ্যন্তরীণ বিরোধ এবং করোনা প্রভাবিত জটিল ব্যাংক ঋণের কারণে কোম্পানিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে উঠে এসেছে রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানি অ্যান্ড ফার্মের তথ্যে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ইনারবিডি প্রোডাক্টস লিমিটেডের কথা। ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এ কোম্পানির ২০১৪ সালে বার্ষিক টার্নওভার ছিল ২০০ কোটি টাকা। কোম্পানিটি ফুটওয়্যারের অনুষঙ্গ ও ওয়ান-টাইম পেপার কাপ তৈরি করতো।
ইনারবিডি’র প্রতিষ্ঠাতা-ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমজাদ হোসেন ২০১৫ সালে মারা যান। এরপর কোম্পানির দায়িত্ব নেন তার স্ত্রী, ছেলে ও মেয়ে। নতুন নেতৃত্বে কোম্পানিটি ভালোভাবে লাভ করতে পারেনি। তারপরে করোনাকালে শ্রম এবং আর্থিক সংকটের কারণে নতুন মালিকরা ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হন।
কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া আমজাদ হোসেনের বড় ছেলে আশিকুর রহমান শুভ বলেন, আমরা ব্যবসাকে সচল রাখার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু এটা সত্য যে আমরা আসলে ব্যবসা বুঝতে পারিনি। শুভ জানান, কোম্পানিটির গাজীপুর, টঙ্গী ও নারায়ণগঞ্জের কারখানায় তিন শতাধিক শ্রমিক রয়েছে। মহামারিতে তাদের বিক্রি কমেছে। একইসাথে চলাচলে নিষেধাজ্ঞা শ্রম সংকটকে আরো তীব্র করে তুলেছে। তিনি বলেন, এক পর্যায়ে আমরা লিকুইডেশনের জন্য আবেদন করার সিদ্ধান্ত নেই।
কিছু অফিসিয়াল প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর, কোম্পানিটি ২০২১ সালের ফেব্রæয়ারিতে বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারখানা, জমি এবং ইনভেন্টরির কাঁচামাল ২৪০ কোটি টাকায় বিক্রি করা হয়, ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করা হয়, শ্রমিকদের বিদায় করে দেওয়া হয় এবং অবশিষ্ট অর্থ ভাগ করে নেওয়া হয় পরিবারের সদস্যদের মধ্যে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, অনেক ছোট ব্যবসাই করোনার ধাক্কা সামলাতে পারেনি। এছাড়া মূল্যস্ফীতি, গ্যাসের ঘাটতি এবং রেকর্ড পরিমাণ জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে অনেক ব্যবসা এখনো ক্ষতির মুখে রয়েছে। রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানি অ্যান্ড ফার্ম অনুসারে, ২০১৮, ২০১৯, ২০২০, ২০২১ এবং ২০২২ অর্থবছরে অবসায়ন হওয়া কোম্পানির সংখ্যা ১০৮, ১৩১, ৯৩, ১৪৩ এবং ২৮১।
নিজেদের কোম্পানিগুলোকে অবসায়ন করা ব্যবসায়ীরা বলেছেন, ব্যবসায়ীক সমস্যার কারণে তারা সরকার প্রদত্ত প্রণোদনা ঋণ দিয়েও কোম্পানি বাঁচাতে পারেননি। সাভারে অবস্থিত পোশাক রপ্তানিকারক কোম্পানি মিডলি ফ্যাশন লিমিটেড ২০২০ সালে অভ্যন্তরীণ বিরোধে ভুগছিল। মিডলির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসিবুর রহমান বলেন, স্টেকহোল্ডাররা কোম্পানির আর্থিক বিষয় নিয়ে কাজ করতে নারাজ। এছাড়াও, ব্যাংক ঋণ বাড়তে থাকে, যার ফলে কোম্পানি অবসায়ন করতে বাধ্য হন তারা। ঢাকার শাফিন উডেন বোর্ড লিমিটেডের ঘটনাও প্রায় একই।
এ তালিকায় আছে রিয়েলটর রাসেল লজ হোল্ডিংস লিমিটেডও। চলতি বছরের জুনে অবসায়ন হওয়া এই কোম্পানিকে ব্যবসা বন্ধ করার জন্য আদালতের আদেশের মুখোমুখি হতে হয়েছিল।
দশ বছর আগে কোম্পানিটির সাথে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করা এক জমির মালিক আদালতে একটি লিকুইডেশন পিটিশন দাখিল করেন। তিনি দাবি করেন, কোম্পানিটি প্রতিশ্রæত আবাসন প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করেনি এবং এক দশক পরেও তার অ্যাপার্টমেন্টগুলো হস্তান্তর করেনি। বেশ কয়েকদিন আগে নর্দার্ন কনজিউমার প্রোডাক্টস লিমিটেড নামক আরেকটি প্রতিষ্ঠান অবাসয়নের আবেদন করেছে। ঐ কোম্পানির একজন দায়িত্বশীল জানান, কোভিডের সময় ব্যবসায় ধ্বস নামায় টিকে থাকতে পারেনি কোম্পানিটি। রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মের রেজিস্ট্রার শেখ শোয়েবুল আলম বলেন, কোম্পানিগুলো কৃত্রিম জীবন্ত সত্ত¡ার মতো যারা নিজেরা মরতে পারে না।
আমাদের বেশ কয়েকটি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। এরপরই মৃত্যু হয় একেকটি কোম্পানির, অবসায়ন হলো একটি আইনি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে একটি ব্যবসা তার আইনি অস্তিত্ব গুটিয়ে ফেলে কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়, যোগ করেন তিনি। ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ব্যবসা বন্ধের জন্য মহামারিকে এককভাবে দায়ী করা যাবে না। তিনি বলেন, কোম্পানিগুলো আগে থেকেই বেহাল দশায় ছিল এবং করোনার ধাক্কা থেকে তারা আর বাঁচতে পারেনি।
পিআরআই নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বিশ্বাস করেন, কোম্পানিগুলোর সঠিকভাবে পরিচালনা নিশ্চিত করার জন্য কর্তৃপক্ষও দায়ী। তিনি বলেন, ব্যবসায়ী সংস্থাগুলোরও নৈতিক দায়িত্ব আছে রুগ্ন ব্যবসায়িকদের পাশে দাঁড়ানো। রাজশাহীর নাজমুল হোসেন রনি ২০২০ সালের শেষ দিকে সোভিয়েত মেশিনারিজ নামে একটি কোম্পানি নিবন্ধন করেন। আমদানিকৃত ওষুধের যন্ত্রপাতি কিনে স্থানীয় কোম্পানির কাছে বিক্রি করতেন বলে জানান তিনি। আমি খুচরা ব্যবসা করতাম। মহামারি চলাকালীন চিকিৎসা সরঞ্জামের চাহিদা বেড়ে যায়। সে সুযোগ কাজে লাগিয়েই আমি ব্যবসা শুরু করি, বলেন তিনি।
বর্তমানে আমি চীন, রাশিয়া এবং যুক্তরাজ্য থেকে ফার্মাসিউটিক্যাল যন্ত্রপাতি আমদানি করছি। আমার ব্যবসা বেশ ভালোই চলছে, জানান রনি। তার কোম্পানির মতো, অনেক নতুন কোম্পানি – বিশেষ করে আমদানি, রপ্তানি এবং ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম- করোনার সময় নতুন নিবন্ধন করেছে। ২০২২ অর্থবছরে প্রায় ১৩ হাজার ২১৮টি কোম্পানি এবং ফার্ম ব্যবসার নিবন্ধন নিয়েছে। ২০১৯ অর্থবছরে এই সংখ্যা ছিল ৬৯৪৫, ২০২০ এ ১১,১২৮ এবং ২০২১ এ ১৪,৮২৬। এছাড়া সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনার সময় অনলাইন কেনাকাটা ও খাদ্য সরবরাহে বিশেষ অগ্রগতিও লক্ষ্য করা গেছে। সিনিয়র বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, নিবন্ধন বৃদ্ধির পাশাপাশি অনেক নতুন ব্যবসা উদ্ভাবন করেছে উদ্যোক্তারা, যোগ করেন তিনি। সূত্র : টিবিএস