বছরে ২৬ হাজার কোটি টাকা বাড়তি ভ্যাট আদায়
অর্থনীতি ডেস্ক : এনবিআর সূত্র জানায়, পরীক্ষামূলক ইএফডি চালুর পর এ পর্যন্ত প্রায় আট হাজার মেশিন বসানো হয়েছে। এর মাধ্যমে সেপ্টেম্বরে ভ্যাট এসেছে প্রায় ৩০ কোটি টাকা। আর আগস্টে আদায় হয়েছে ৩৭ কোটি ৬১ লাখ টাকা।
ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে আধুনিক প্রযুক্তির ভ্যাট আদায়ের মেশিন ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) চালুর পর এর সুফল মিলছে।
প্রচলিত প্রথায় যে পরিমাণ মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট আদায় হয়, ইএফডি মেশিন বসানোর পর তার চেয়ে বহুগুণ আহরণ হচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, একটি দোকানে আগে যেখানে মাসে গড়ে ৩ থেকে ১০ হাজার টাকার ভ্যাট আদায় হতো, সেখানে ইএফডি মেশিন বসানোর পর আদায় হচ্ছে গড়ে ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা।
তার মানে ভ্যাট আদায়ে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে ইএফডি ব্যবহারে। ভ্যাট আদায় বাড়াতে সারা দেশে তিন লাখ ইএফডি মেশিন বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনবিআর।
আগামী তিন বছরে পর্যায়ক্রমে এসব মেশিন ভ্যাট পরিশোধে সামর্থ্য রয়েছে- এমন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বসানো হবে। ইতোমধ্যে ক্রয়সংক্রান্ত এবং অর্থনৈতিক সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে এ-সংক্রান্ত দরপ্রস্তাবের অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ইএফডি মেশিন বসানো সম্পন্ন হলে বছরে কমপক্ষে অতিরিক্ত ২৬ হাজার কোটি টাকার ভ্যাট আহরণ হবে। আদায় আরও বৃদ্ধির যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে বলে ওই কর্মকর্তা জানান।
এনবিআর সূত্র জানায়, পরীক্ষামূলক ইএফডি চালুর পর এ পর্যন্ত প্রায় আট হাজার মেশিন বসানো হয়েছে। এর মাধ্যমে সেপ্টেম্বরে ভ্যাট এসেছে প্রায় ৩০ কোটি টাকা। আর আগস্টে আদায় হয়েছে ৩৭ কোটি ৬১ লাখ টাকা।
গত বুধবার এনবিআরের সম্মেলন কক্ষে ইএফডি লটারি ড্র উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এনবিআর সদস্য (মূসক মূল্যায়ন ও বাস্তবায়ন) ড. মইনুল খান বলেছেন, ইএফডি মেশিনের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। এই মেশিন বসানোর ফলে খুচরা ও পাইকারি ব্যবসা খাতে যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে। যখন তিন লাখ মেশিন বসানো সম্পন্ন হবে, তখন দীর্ঘমেয়াদে আরও সুফল মিলবে বলে মত দেন তিনি।
ভ্যাট আদায় বাড়াতে ২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ইএফডি মেশিন পরীক্ষামূলক চালু করা হয়। অতিমারি করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে এর কার্যক্রমে ভাটা পড়ে। এখন আবার জোর দেয়া হয়েছে। এই ব্যবস্থা জনপ্রিয় ও ক্রেতাদের ভ্যাট দিতে উৎসাহিত করতে গত বছর থেকে নিয়মিত লটারির ড্রয়ের আয়োজন করে আসছে এনবিআর। ইএফডি হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তির হিসাব যন্ত্র। এটি ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্টার বা ইসিআরের উন্নত সংস্করণ। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে এই যন্ত্র বসানোর ফলে এনবিআরের কর্মকর্তারা প্রতিদিনের বিক্রির প্রকৃত তথ্য জানতে পারেন। ফলে তথ্য গোপনের সুযোগ নেই ব্যবসায়ীদের। এই পদ্ধতিতে ফাঁকি বন্ধ হওয়ায় ভ্যাট আদায় বর্তমানের চেয়ে বহুগুণ বাড়বে বলে প্রত্যাশা করছে সরকার।
বর্তমানে মোট রাজস্বের ৩৯ শতাংশই আদায় হয় ভ্যাট থেকে। ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, বিপণিবিতান, হোটেল-রেস্তোরাঁসহ ২৫টি খাতে ইএফডি বসানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। দৈনিক গড়ে বিক্রয় ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ভ্যাটমুক্ত। এর বেশি হলে প্রযোজ্য হারে ভ্যাট দিতে হয়। চলতি অর্থবছরে এনবিআরের মাধ্যমে মোট রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ভ্যাট থেকে আসবে ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা।
আদায় করবে এজেন্ট: আগে সিদ্ধান্ত ছিল, ব্যবসায়ীদের ইএফডি মেশিন সরবরাহ করবে এনবিআর। পরবর্তী সময়ে ওই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে এজেন্টের মাধ্যমে আদায়ের পরিকল্পনা নেয়া হয়। এ জন্য জেনেক্স ইনফোসিস লি. নামে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দিয়েছে সরকার। যে পরিমাণ ভ্যাট আহরণ হবে তার ভিত্তিতে নির্ধারিত হারে কমিশন দেয়া হবে। এই প্রথম বেসরকারি খাতের একটি প্রতিষ্ঠানকে রাজস্ব আদায়ে অনুমতি দিল সরকার। প্রতিষ্ঠানটি মেশিন সরবরাহ ও রক্ষণাবেক্ষণ করবে। বিনিময়ে পাবে সার্ভিস চার্জ বা কমিশন। কমিশনের হার আদায়কৃত ভ্যাটের শূন্য দশমিক ৫২ শতাংশ হতে পারে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
বেসরকারি পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানকে রাজস্ব আদায়ের মতো রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব দেয়া যায় কি না এ প্রশ্নের উত্তরে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, সিস্টেম অটোমেশন হলে কোনো সমস্যা নেই। আমরা অটোমেশন সম্পন্ন করেছি। তা ছাড়া পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস বা পিপিআর অনুযায়ী এতে কোনো বাধা নেই। বর্তমান পিপিআরের সঙ্গে ভ্যাট আইনের কোনো সাংঘর্ষিক নেই বলে মত দেন ওই কর্মকর্তা।
এনবিআর বলেছে, ইএফডি বসানো সম্পন্ন হলে রাজস্ব আয় বাড়বে। ঘরে বসেই তদারক করা যাবে। সূত্র জানায়, বর্তমানে অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধন নিয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩ লাখ ৮০ হাজার। এনবিআর দাবি করেছে, এখন ৮০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান মাসিক ভ্যাট রিটার্ন জমা দেয়।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির তথ্যানুযায়ী, সারা দেশে খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ে ২০ লাখ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে কতটি প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট দেয়ার সামর্থ্য আছে, তার কোনো সঠিক সংখ্যা নেই। জানা যায়, যোগ্য প্রতিষ্ঠান নিয়ে জরিপ করছে রাজস্ব বোর্ড।
যোগাযোগ করা হলে জেনেক্স ইনফোসিস লিমিটেড কোম্পানির সচিব জুয়েল রাশেদ সরকার দৈনিক বাংলাকে বলেন, আমাদের সঙ্গে চুক্তি হয়নি এখনো। এটি হলে নিয়োগের শর্তসমূহ জানা যাবে। এরপর কাজ শুরু হবে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এ কাজে অভিজ্ঞতা না থাকলেও কোনো অসুবিধা হবে না। কারণ আমরা তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করছি। আমরা শুধু মেশিন সরবরাহ করব এবং টেকনিক্যাল সাপোর্ট দেব। ফলে কাজটি আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ নয়- মন্তব্য করেন তিনি।
খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায় বিশাল ভ্যাট ফাঁকি: খুচরা ও পাইকারি ব্যবসা অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে এ খাতের অংশ চলতি মূল্যে সাড়ে ৫ লাখ কোটি টাকা, যা শতকরা হারে ১৫ শতাংশ। জিডিপির প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে পাঁচটি খাত প্রধান চালিকাশক্তি। এর মধ্যে খুচরা ও পাইকারি ব্যবসা অন্যতম। উৎপাদন বা ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের পরই এ খাতের অবস্থান। খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায় বিপুল পরিমাণ ভ্যাট আহরণের সম্ভাবনা থাকলেও বাস্তবতা হচ্ছে খুব কমই ভ্যাট আসে। বছরে মাত্র ৭০০-৮০০ কোটি টাকা। অথচ আদায়ের সম্ভাবনা আছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। এনবিআরের তথ্যানুযায়ী, খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায় আদায়যোগ্য ভ্যাটের ৯০ শতাংশই ফাঁকি হয়। এর প্রধান কারণ দুটি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। প্রথমত বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই আওতার বাইরে। দ্বিতীয়ত, অটোমেশন না করা।
এনবিআরের সাবেক সদস্য রেজাউল হাসান বলেন, ছোট ব্যবসায়ীদের মূল সমস্যা হচ্ছে তারা যে লেনদেন করে থাকে, তার জন্য কোনো হিসাব সংরক্ষণ করে না। যে কারণে সরকার থেকে রেয়াত বা ভ্যাট ফেরত পায় না। তিনি আরও বলেন, এ খাত থেকে ভ্যাট আদায় বাড়াতে হলে সামর্থ্যবান সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে আওতায় এনে অটোমেশন করতে হবে। তা হলে আদায় বর্তমানের চেয়ে বহুগুণ বাড়বে।
জানা যায়, দু-তিনটি খাত ছাড়া বেশির ভাগ খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায় ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা জানান, ৫ শতাংশ ভ্যাট তাদের জন্য অনেক বেশি। এই হারে ভ্যাট দিতে হলে তাদের ব্যবসায় কমপক্ষে ৩৩ শতাংশ মূল্য সংযোজন করতে হয়। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় এ খাতে সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন হয়। কাজেই নিট বা প্রকৃত মূল্য সংযোজন যা হয়, তার ওপর ভিত্তি করেই এ খাত থেকে ভ্যাট আদায় করা উচিত। নিয়ম অনুযায়ী, যেকোনো ব্যবসায় যে পরিমাণ মূল্য সংযোজন হয়, তার ওপর ভিত্তি করে প্রযোজ্য হারে ভ্যাট আদায় করে সরকার। মাসিক রিটার্নের সময় এই ভ্যাট পরিশোধ করা হয়।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, ২০১৯ সালের ভ্যাট আইন অনুযায়ী ভোক্তার কাছ থেকে সরাসরি ভ্যাট আহরণ করবে খুচরা ও পাইকারি প্রতিষ্ঠান। এ জন্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস বা ইএফডি যন্ত্র বসানোর কথা। তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এখন পর্যন্ত অল্পসংখ্যক প্রতিষ্ঠানে তা স্থাপন করতে পেরেছে। ফলে ভ্যাট আদায় নিয়ে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। যতদিন পর্যন্ত রাজস্ব বোর্ড সব দোকান ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ইএফডি মেশিন স্থাপন করতে না পারে, ততদিন পর্যন্ত খুচরা ও পাইকারি থেকে ভ্যাট আদায় বাড়বে না। সূত্র : নিউজবাংলা