বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী ভোঁদড় সংরক্ষণে নেই তেমন কোনও উদ্যোগ
মতিনুজ্জামান মিটু : গলায় বাঁধা দড়ি বা রশির টানে পানিতে নামে ওরা। জেলেরা নৌকা থেকে রশি ধরে রাখেন আর ওরা মাছদের তাড়া করে জেলেদের জালে আনে। এরপর এই মাছ হাটে বিক্রি করেন তাঁরা। বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী ভোঁদড় দিয়ে এভাবেই এখনো মাছ ধরছে নড়াইল সদর উপজেলার কলোড়া ইউনিয়নের গোয়ালবাড়ি গ্রামের প্রায় ৩০টি পরিবার। অথচ ভোঁদড় সংরক্ষণে নেই কোনো উদ্যোগ।
মৎস্য অধিদপ্তরের সুত্রমতে, গোয়ালবাড়ি গ্রামে অন্তত ২০০ জেলে পরিবার বসবাস করে। ওই ৩০টি পরিবারের পাশাপাশি ইউনিয়নের রতডাঙ্গা ও পঙ্কবিলা গ্রামের আরও কয়েকটি জেলে পরিবার একইভাবে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। গোয়ালবাড়িসহ তিনটি গ্রামের জেলেরা জানান, ভোঁদড় (আঞ্চলিক ভাষায় ধাড়িয়া বা ধেড়ে) পানিতে নেমে মাছ শিকার করে খেতে পছন্দ করে। প্রতিটি জেলেনৌকার এক প্রান্তে ভোঁদড়ের জন্য আলাদা করে খাঁচা বানানো থাকে। মাছ ধরার সময় খাঁচার ডালা খুলে দেওয়া হয়। জেলেরা নৌকায় বাঁধা জাল নদীতে ফেলে ভোঁদড় ছেড়ে দেন। এ সময় লাঠির সঙ্গে এদের শরীর এমনভাবে বাঁধা থাকে, যাতে ছুটে যেতে না পারে। নৌকা নদীর তীরে আসতে থাকে আর ভোঁদড়ের তাড়া খেয়ে মাছগুলো জেলেদের জালে এসে ধরা পড়ে।
প্রতিটি ভোঁদড় বছরে সাত থেকে আটবার বাচ্চা দেয়। অন্তত ১০ বছর পর্যন্ত এরা বেঁচে থাকে। পূর্ণবয়স্ক একেকটি ভোঁদড় ৭ থেকে ১২ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। ভোঁদড়ের চামরা খুবই মুল্যবান ও এর চাহিদা বিশ্বের সর্বত্র। তাছাড়া জেলেদের বন্ধু হিসাবে এর গুরুত্ব অপরিসীম। বিভিন্ন চিরিয়াখানায় ও সার্কাসে এদেরকে দিয়ে দেশে বিদেশে বিপুল সংখ্যক দর্শকের চিত্তবিনোদন ও মনোরঞ্জন ঘটানো হয়।
পঙ্কবিলা গ্রামের গুরুপদ বিশ্বাস বলেন, প্রতিবছরই অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত তিন মাসের বেশি সময় ধরে তাঁরা ১০ থেকে ১২টি নৌকা আর দুই থেকে চারটি ভোঁদড় নিয়ে নদীপথে পাড়ি জমান। মাছ ধরেন আর ঘাটে ঘাটে বিক্রি করেন। বছরের এই সময়ে যা আয় হয়, তা দিয়ে প্রায় সারা বছর সংসার চালান।
গোয়ালবাড়ি গ্রামের মৎস্যজীবী শচীন বিশ্বাস জানান, বংশপরম্পরায় ভোঁদড় দিয়ে তাঁরা মাছ ধরে আসছেন। রতডাঙ্গা গ্রামের পাগল চান বিশ্বাস জানান, নদীতে বেশি পানি থাকলে সুন্দরবন পর্যন্ত মাছ ধরতে যান। এখন জলদস্যুদের ভয়ে সুন্দরবন না গিয়ে চিত্রা নদীর পাশের মধুমতী, আড়িয়াল খাঁ পাড়ি দিয়ে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর ও ফরিদপুর চলে যান। ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরা জেলেদের পেশা হলেও বিলুপ্তপ্রায় এই প্রাণী সংরক্ষণ করা দরকার। কিন্তু এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের আলাদা কোনো নীতিমালা বা বরাদ্দ না থাকায় কোনো কিছু করা সম্ভব হচ্ছে না।
সমাজ উন্নয়নকর্মী ও পরিবেশবিদ কাজী হাফিজ জানান, আগের মতো এখন আর তেমন ভোঁদড় দেখা যায় না। ২০১২ সালের ১২ জুলাই বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা-সম্পর্কিত ৩০ নম্বর আইন পাস হয়েছে। এই আইন পাসের ১৮০ দিনের মধ্যে কোনো ব্যক্তির কাছে সংগৃহীত ও সংরক্ষিত কোনো বন্য প্রাণী থাকলে সেগুলো নিবন্ধন করাতে হবে। আইনে নিবন্ধনের কথা উল্লেখ থাকলেও সংরক্ষণের তেমন জোর দেওয়া হয়নি।
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, সরকারের সময়োপযোগী এ আইনে বিলুপ্তপ্রায় ভোঁদড় সংরক্ষণের জন্য অভয়াশ্রম সৃষ্টির উল্লেখ থাকা জরুরি ছিল। যেসব অঞ্চলে জেলেদের জীবিকার জন্য বংশপরম্পরায় মাছ ধরার কৌশল হিসেবে ভোঁদড় ব্যবহার করে আসছে, তাদের দ্রæত নিবন্ধনের আওতায় এনে বিলুপ্তপ্রায় এসব প্রাণী সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।’
পরিবেশ অধিদপ্তরের সুত্র মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে ভোঁদড়ের সংখ্যা আশংকা জনকভাবে কমছে। কারণে অকারণে এদেরকে দেশের বিভিন্ন স্থানে হত্যা করা হচ্ছে। তাই দিন দিন এদের কমছে এদের সংখ্যা। দেশের রাজশাহী, বগুড়া, দিনাজপুর ও রংপুর অঞ্চলে প্রচুর সাওতাল নৃতাত্বিক জনগোষ্ঠির বসবাস। এদের কাছে মাছ, কাঁকড়া, শুকর, বন মোরগ মুরগি, বন জঙ্গলের পশু, পাখি, খরগোশ, গুইসাপ, ইঁদুর, বেঁজি ও ভোঁদড়ের মাংস খুবই প্রিয় খাবার। এরা পাকা শিকারিও বটে । এদের কাছেও এই উদবিড়াল তথা ভোঁদড়েরা মাঝে মাঝেই ধরা খেয়ে নিধন হচ্ছে।
নড়াইল জেলা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ ও সিলেটের হাওড় বাওড় এলাকায় প্রচুর ইউরেশিয়া ভোঁদড় বসবাস করে থাকে। নীশাচর এই প্রাণীটি রাতের আধারে পুকুর জলাশয় ও মাছের খামার হতে মাছ খেয়ে ফেলে বলে এদেরকে সুযোগ পেলেই স্থানীয়রা নিধন করে ফেলে। একদিকে খাবারের দুস্প্রাপ্যতা অন্যদিকে মানুষের হাতে পড়ে এরা সারাদেশেই দ্রæত বিলুপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশে তাই ভোঁদড় এখন বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী হিসাবে ঘোষিত। জীববৈচিত্র রক্ষার জন্য এদের জন্য দরকার নিরাপদ অভয়ারন্য ও কনজারভেশন।
‘আয়রে আয় টিয়ে, নায়ে ভর দিয়ে, না নিয়ে গেল বোয়াল মাছে, তাই না দেখে ভোঁদড় নাচে, ওরে ভোঁদড় ফিরে চা, খুকুর নাচন দেখে যা।’ শিশুদের জন্য ছড়ায় ভোঁদড় নিয়ে কথামালায় ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের কৌতুহলী প্রশ্নের উত্তরে নিজের জন্যই কিছু তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তা অনুভব হয়। অনেকেই পাকৃতিক বন্য পরিবেশে ভোঁদড় দেখেনি, এর সম্পর্কে তেমন কিছু জানেওনা। শিশুদের জন্য ছড়ায় নিশাচর এপ্রাণীটি নিয়ে শিশুমনের কিছু প্রশ্ন যথা ভোঁদড় কোথায় থাকে? কি খায়? বাচ্চা দেয় না ডিম দেয়? নৌকা বড় না বোয়াল মাছ বড়? ভোঁদড় কিভাবে নাচে ইত্যাদি হরেক রকম প্রশ্নের মুখে নীজকে বড়ই অসহায় মনে হয়। অনুসন্ধানমতে, ভোঁদড় একটি আধা জলচর মৎস্যভূক স্তন্যপায়ী প্রাণী। ছোট কান, চওড়া মাথা তেলতেলা শরীর, লম্বা লেজ , হাসের পালকের মত পা নিয়ে গঠিত প্রাণীটি দেখতে বেশ সুন্দর। অস্ট্রেলিয়া ও এন্টারটিকা ছাড়া পৃথিবীর প্রায় সব মহাদেশেই ভোঁদড় আছে, ভোঁদড়েরা পৃথিবীর বুকে আছে প্রায় ৩ কোটি বছর ধরে।
বাংলাদেশে ভোঁদড়ের তিনটি প্রজাতি দেখা যায়; ওরিয়নটাল ইন্ডিয়ান স্মল ক্লোড ওটার, ইউরেসিয়ান ওটার ও ইন্ডিয়ান স্মোথ কোটেড ওটার। উল্লেখ্য ভোঁদড়কে ইংরেজীতে ‘ওটার’ বলে । সবগুলোর বাংলা নাম হচ্ছে উদ , উদবিড়াল ও ভোঁদড় বা মাছনেউল। বাংলাদেশে ‘ইন্ডিয়ান স্মোথ কোটেড ওটার’ নামের ভোঁদড়টি বেশী পাওয়া যায়।
এদের লেজ মোটা আকারের এবং শরীর লম্বাটে গড়নের। বেশির ভাগেরই পায়ে ধারালো নখযুক্ত থাবা আছে। সাঁতার কাটার সময়ে ভোঁদড়ের নাক ও কানের ফুটো বন্ধ থাকে। এদের নাকের ডগায় লম্বা গোঁফের মতো খাড়া লোম থাকে। এদের শক্তিশালী ছুঁচালো দাঁত আর মাড়ি পিচ্ছিল শিকার ধরতে বা মাছের মুড়ো চিবোতে অত্যন্ত কার্যকর। এদের লেজ চ্যাপ্টা, ১০ থেকে ১২ ইঞ্চি। ভোঁদড় লিপ্তপদী বলে পানির নিচে খুব ভালো সাঁতার কাটতে পারে এবং পানির উপরে মাথা না তুলে ডুব দিয়ে একবারে প্রায় আধা কিলোমিটার পর্যন্ত যেতে পারে। ভোঁদড় বা উদবিড়ালের শরীরে একপ্রকার বিকট গন্ধ রয়েছে; অভিজ্ঞজনেরাও এ গন্ধকে বাঘের গন্ধ বলে ভুল করতে পারেন। ভোঁদড়েরা দলবেঁধে থাকলে প্রচন্ড চেঁচায়। অধিকাংশ সময় এরা বাচ্চা সঙ্গে নিয়ে শিকার খোঁজে। ভোঁদড়ের মূল খাদ্য মাছ, তবে এরা অন্যান্য জলজ অমেরুদন্ডী প্রাণী, যেমন: কাঁকড়া, পানির ব্যাঙ ইত্যাদিও দলবেঁধে শিকার করে থাকে। বেশিরভাগ ভোঁদড় জলাশয়ের কিনারে, গর্তে বাস করে। শিকার করা বা ভ্রমণের উদ্দেশ্য ছাড়া এরা পানিতে নামে না, ডাঙাতেই বেশিরভাগ সময় কাটায়। ভোঁদড়, জোয়ারপ্রবণ এলাকায় বাসা তৈরি করে, জোয়ার-সীমানার উঁচুতে কোনো বড় গাছের তলায় গর্ত করে। গর্তের কয়েকটি মুখ থাকে, নদীর তলদেশ পর্যন্ত গর্ত থাকে , শত্রæর আক্রমন ঘটলে এই সুরঙ্গ পথে এরা পালিয়ে যায়। গর্তে ঢুকতে হয় জলের তলা দিয়ে। কিন্তু বাচ্চা প্রসবের জায়গাটি থাকে শুকনো এলাকায়।