রিজার্ভ কমবে ৮ বিলিয়ন ডলার আইএমএফের ফর্মুলা মানবে বাংলাদেশ
অর্থনীতি ডেস্ক : আগামীতে আন্তর্জাতিক মানদÐ অনুযায়ী আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি অনুসরণ করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসাবায়ন করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আইএমএফের প্রতিনিধি দল নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে রিজার্ভ ইস্যুটি খুবই স্পর্শকাতর, এ কারণে আইএমএফের পদ্ধতিতে রিজার্ভ গণনা শুরু হতে একটু সময় লাগবে। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আইএমএফের সফররত মিশনের বৈঠকে এমন সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।
মিশনের প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে চার সদস্যের প্রতিনিধি দল আগামী ৯ নভেম্বর পর্যন্ত অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করবে। বাংলাদেশ সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ চাওয়ার পর আনুষ্ঠানিক আলোচনার জন্য এ মিশন ঢাকায় এসেছে। একটি সেশনে আইএমএফ প্রতিনিধি দলকে জানানো হয়, আন্তর্জাতিক মানদÐের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হিসাব প্রকাশের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় সরকারের উচ্চপর্যায়ে আলোচনা করে কবে নাগাদ শুরু করা হবে, তা সিদ্ধান্ত হবে। আইএমএফের পদ্ধতি অনুসরণের পাশাপাশি শুরুতে বিদ্যমান পদ্ধতির হিসাবও প্রকাশ করা হবে।
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ৬ সেশনে বৈঠক করেন তারা। প্রথম পর্বে দুপুর ২টা পর্যন্ত তিনটি সেশন হয়। প্রথম পর্বের বৈঠকে বাংলাদেশকে প্রতিশ্রæতি দেওয়া ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণসহ আর্থিক খাতের সংস্কার, নীতি ও ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা নিয়ে আলোচনা হয়। বিকালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ এবং অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের সঙ্গে বৈঠকে বসে প্রতিনিধি দল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরসহ বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গে ছয়টি বৈঠক হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে প্রথম বৈঠকে আইএমএফ’র মিশন প্রধান রাহুল আনন্দ নেতৃত্ব দেন। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামাল, কাজী ছাইদুর রহমান, সাজেদুর রহমান খান ও প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. হাবিবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া আইএমএফ মিশনের সদস্যরাও ছিলেন।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতি নিয়ে আপত্তি তুলেছে। তারা রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতিতে আন্তর্জাতিক রীতি অনুসরণ করতে বলেছে। এছাড়া ডলারের একাধিক দর নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। আইএমএফ মনে করে এতে আন্তর্জাতিক মহলে বিভ্রান্তি দেখা দিচ্ছে। তারা ডলারের দরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব দিয়েছে। একই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন পদ্ধতিকে আরও স্বচ্ছ ও নিরাপদ করার কথা বলেছে। বৈঠকে আইএমএফ’র পক্ষ থেকে বলা হয়, রিজার্ভ থেকে অর্থ নিয়ে আলাদাভাবে বিভিন্ন তহবিল গঠন ও সেখান থেকে ঋণ দেওয়া হচ্ছে। আবার ওইসব অর্থ রিজার্ভে দেখানো হচ্ছে। এতে রিজার্ভ বেশি দেখানো হচ্ছে। যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। এভাবে রিজার্ভের হিসাব দেখানো ঠিক হচ্ছে না। আইএমএফ মনে করে এতে দেশের প্রকৃত রিজার্ভের চিত্র ফুটে উঠছে না। রিজার্ভের প্রকৃত চিত্র আড়াল করায় বাংলাদেশেরই বরং ঝুঁকি বাড়ছে। আইএমএফের দৃষ্টিতে এই গরমিলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট দেখা দিতে পারে। বাংলাদেশের স্বার্থেই এ হিসাব আন্তর্জাতিকমান অনুযায়ী করা উচিত। তারা আরও বলেছেন—ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ আইএমএফ’র সদস্য সব দেশই আইএমএফ’র প্রচলিত আন্তর্জাতিকমান মেনে রিজার্ভের হিসাব করে এবং তা প্রকাশ করে। কিন্তু বাংলাদেশ রিজার্ভের হিসাবের ক্ষেত্রে আইএমএফ’র মান মানছে না। নিজেদের মতো করে হিসাব করে বেশি রিজার্ভ দেখাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র জিএম আবুল কালাম আজাদ বলেন, বৈঠকে রিজার্ভ নিয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে। এ নিয়ে যার যার অবস্থান থেকে যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে তাদেরকে বলা হয়েছে, রিজার্ভের হিসাব বাংলাদেশ দুভাবে করছে। গ্রস ও নিট হিসাব। গ্রস হিসাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে থাকা সব বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে দেখানো হচ্ছে। নিট হিসাবে বিভিন্ন তহবিলের অর্থ বাদ দেওয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) সরবরাহ করা সাত বিলিয়ন ও শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া ২০ কোটি ডলার রিজার্ভে দেখাচ্ছে। এছাড়া গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ড (জিটিএফ) ২০ কোটি, লং টার্ম ফিন্যান্সিং ফ্যাসিলিটি (এলটিএফএফ) তহবিলে ৩ কোটি ৮৫ লাখ, সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিমানকে ৪ কোটি ৮০ লাখ এবং ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইটিএফসি) আমানত রিজার্ভে দেখাচ্ছে। সবমিলিয়ে বর্তমানে রিজার্ভে যে অর্থ দেখানো হচ্ছে, সেখান থেকে ৮ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার বাদ যাবে বলে মনে করে আইএমএফ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, রিজার্ভের বিষয়ে যে বিতর্ক তা আংশিক সত্য। আইএমএফ চায় ৮০০ কোটি ডলারের তহবিল রিজার্ভ থেকে বাদ দিতে। বৈঠকে উপস্থিত থাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক কর্মকর্তা জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে তাদেরকে জানানো হয়েছে, আমরা নীতিগতভাবে আইএমএফের সঙ্গে একমত। আগামীতে আন্তর্জাতিক হিসাব পদ্ধতি অনুসরণ করেই রিজার্ভ হিসাবায়ন করব। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক এখন যে পদ্ধতিতে হিসাব করে সেটাও প্রকাশ করবে। বর্তমানে দেশের রিজার্ভের পরিমাণ ৩৫ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার। তবে আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি অনুসরণ করলে তা কমে দাঁড়াবে ২৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। বৈঠকে আইএমএফ ডলারের একাধিক দর নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। সংস্থাটির মতে, ডলারের একটি ইউনিক দর থাকা উচিত। যেটি বাংলাদেশে নেই।
এদিকে ঋণ ও আমানতে সুদহারে আরোপিত সীমাও প্রত্যাহার চায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল। বর্তমানে ঋণে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ এবং ব্যক্তি পর্যায়ের মেয়াদি আমানতে গড় মূল্যস্ফীতির চেয়ে বেশি সুদ দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে উঠলেও সুদহারে সীমা তুলে দেওয়ার বিষয়ে অর্থনীতিবিদ অনেকেই পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন।
এদিন আইএমএফ মিশন বলেছে, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সুদহার বাজারভিত্তিক হওয়া উচিত। এ ছাড়া ঋণের সুদহার এত কম রেখে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কঠিন হবে। চাহিদা ব্যবস্থাপনার জন্য সুদহার বাড়ানো প্রয়োজন। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সুদহারকে একটি লক্ষ্যভিত্তিক করার কথা বলেছে আইএমএফ। এ ছাড়া আগামীতে প্রতিবছর চারবার মুদ্রানীতি প্রকাশের লক্ষ্যে আপাতত বছরে দুইবার ঘোষণা করতে বলা হয়েছে। আগে ৬ মাস অন্তর মুদ্রানীতির ভঙ্গি ঘোষণা করতো বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে সাবেক গভর্নর ফজলে কবির দায়িত্ব নেওয়ার পর বছরে একবার মুদ্রানীতি ঘোষণা শুরু করেন। সূত্র : বাংলাট্রিবিউন