অক্টোবরে রপ্তানি কমলেও তৈরি পোশাক রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ৩ শতাংশের বেশি
অর্থনীতি ডেস্ক : সার্বিকভাবে রপ্তানি আয় কমলেও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, অক্টোবর মাসে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের আয় ৩ শতাংশ বেড়েছে। এ পরিসংখ্যান অবাক করেছে আরএমজি মালিকদেরও।
ইপিবির প্রকাশিত সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে, মহামারির পর পোশাক রপ্তানির ১৩ মাসের পুনরুদ্ধার ও আশাব্যঞ্জক প্রবৃদ্ধির পর, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের অক্টোবরে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় দেশের সামগ্রিক রপ্তানি আয় ৭.৮৫ শতাংশ কমে ৪.৩৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। গত অর্থবছরের এই সময় সার্বিক রপ্তানি আয় ছিল ৪.৭২ বিলিয়ন ডলার।
তবে অক্টোবরে পোশাক খাতের রপ্তানি আয় ৩.৬৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা ২০২১-২২ অর্থবছরের অক্টোবরের ৩.৬৫ বিলিয়ন ডলারের চেয়ে বেশি।
পোশাক ছাড়াও পাট ও পাটজাত পণ্য, হিমায়িত ও জীবন্ত মাছ এবং চিংড়ি রপ্তানিসহ অন্যান্য প্রধান খাতের আয় কমেছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮৩ শতাংশ এসেছে পোশাক খাত থেকে। তাই পোশাক খাত ভালো করলে রপ্তানি আয়ও হৃষ্টপুষ্ট হয়।
কিন্তু অন্তত ২০ জন নেতৃস্থানীয় রপ্তানিকারক জানান, সবাই এই পরিসংখ্যান দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। এই রপ্তানিকারকদের দাবি, তাদের প্রত্যেকের কারখানা গত বছরের একই মাসের তুলনায় ৩০ শতাংশ কম সক্ষমতায় চলছে।
গত রোববার বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন, অক্টোবরে পোশাক রপ্তানি ২০ শতাংশ কমতে পারে।
এছাড়া কাস্টমসের তথ্যের ভিত্তিতে বিজিএমইএ আরও বলেছে যে, গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি বছরের ২০ অক্টোবর পর্যন্ত পোশাক রপ্তানি ১৯ শতাংশ কমেছে।
বিজিএমইএর ফার্স্ট ভাইস-প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘অক্টোবরের রপ্তানির তথ্য সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। তাই এ বিষয়ে মন্তব্য করতে পারছি না। একজন রপ্তানিকারক হিসাবে বলতে পারি, আমার কোম্পানি [ওয়েল গ্রæপ] গত দুই মাস ধরে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩০ শতাংশ কম সক্ষমতায় চলছে, যা আগামী জানুয়ারি পর্যন্ত চলতে পারে।’
তিনি আরও জানান, ক্রেতাদের অনুরোধের কারণে তাকে ২০ শতাংশ পণ্যের শিপমেন্ট আটকে রাখতে হয়েছে।
‘ওয়্যারহাউসে ফাঁকা জায়গা নেই বলে এখন আমরা ক্রেতাদেরকে বিলম্বে অর্থ প্রদানের শর্তে পণ্যগুলো রিসিভ করার জন্য অনুরোধ করছি,’ বলেন তিনি।
দেশের অন্যতম বৃহৎ স্পিনিং মিল এনভয় টেক্সটাইলের চেয়ারম্যান কুতুবউদ্দিন আহমেদ টিবিএসকে বলেন, এ বছরের অক্টোবরে তার কারখানার উৎপাদন সক্ষমতার ৫০ শতাংশ হয়েছে, বিক্রিও ৫০ শতাংশ ছিল।
তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক কুতুবউদ্দিন আহমেদ বলেন, অক্টোবরে আরএমজির প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক হওয়ার কথা ছিল না। তবে তথ্যটি যেহেতু ইপিবি দিয়েছে, তাই এর ব্যাখ্যাও তারাই আরও ভালোভাবে দিতে পারবে।
অবশ্য ইপিবি বলছে, তাদের তথ্যে কোনো ভুল নেই।
তথ্যটি প্রস্তুতের সঙ্গে যুক্ত ইপিবির একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে টিবিএসকে বলেন, এনবিআর থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তারা এই পরিসংখ্যান তৈরি করেছেন।
তিনি বলেন, তাদের দিক থেকে ভুল নেই, এনবিআরের তথ্যে যদি কোনো ভুল না থেকে থাকে।
এনবিআরের একজন কর্মকর্তা প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এনবিআর তাদের সমস্ত ট্রেড ডেটা অ্যাসাইকুডাওয়ার্ল্ড নামের একটি সফটওয়্যারে সংরক্ষণ করে। ‘সফটওয়্যারের তথ্য আমরা ইপিবিতে পাঠাই। সেখানে ভুল হওয়ার কথা নয়।’
এ বিষয়ে জানতে বানিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ ও ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান এএইচএম আহসানের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।
নারায়ণগঞ্জভিত্তিক নিট পোশাক কারখানা এমবি নিট ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হাতেম টিবিএসকে জানান, তার কারখানায়ও রপ্তানি কমেছে।
দেশের অন্যতম বৃহত্তম আরএমজি রপ্তানিকারক স্প্যারো গ্রæপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলামও টিবিএসকে জানিয়েছেন যে অক্টোবরে তাদের নিয়মিত রপ্তানির চেয়ে ২০-২৫ শতাংশ কম রপ্তানি হয়েছে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফজলে শামীম এহসান ইপিবির পরিসংখ্যান নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তিনি অবশ্য বলেছেন যে অক্টোবরে তার কারখানা থেকে রপ্তানি ৩০ শতাংশ কমেছে। সেইসঙ্গে তার খাতের আরও ১০০ রপ্তানিকারকের রপ্তানি আগের মাসের তুলনায় কমেছে বলে জানান তিনি।
জাবের অ্যান্ড জুবায়ের ফেব্রিক্স লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক (হোম) রাশেদ মোশাররফ বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে রপ্তানি ৩০ শতাংশ কমেছে এবং ক্রেতাদের পূর্বাভাস অনুযায়ী আগামী জানুয়ারি পর্যন্ত এই প্রবণতা অব্যাহত থাকবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ঊর্মি গ্রæপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসিফ আশরাফ এবং ইয়াংফরেভার টেক্সটাইল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাজীব চৌধুরী উভয়েই অবশ্য জানিয়েছেন, অক্টোবরে তাদের রপ্তানিতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
রাইজিং গ্রæপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবরে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত করতে পারেননি তিনি।
ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১০.৫৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১৩.৯৫ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। গত মাসে শিল্প নেতারা নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, তাকে মিথ্যা প্রমাণ করেছে এই প্রবৃদ্ধি।
গত বছরের জুলাই-অক্টোবর মেয়াদে আরএমজি রপ্তানি থেকে দেশের আয় হয় ১২.৬২ বিলিয়ন ডলার।
টানা ১৩ মাস প্রবৃদ্ধির পর গত বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় চলতি বছরের একই সময়ে পোশাক রপ্তানিতে ৭.৫ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
এই খাতের প্রধান গন্তব্যগুলোতে রেকর্ড মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক মন্দার কারণে পোশাকের চাহিদা কমে যাওয়াই এই পতনের প্রধান কারণ।
‘আশঙ্কাজনক, কিন্তু প্রত্যাশিত’
ইপিবির তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে রপ্তানি আয় ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ের ১৫.৭৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ৭.০১ শতাংশ বেড়ে ১৬.৮৫ বিলিয়ন ডলার হয়েছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে পোশাক রপ্তানি ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ের ১২.৬২ বিলিয়ন ডলার থেকে ১০.৫৫ শতাংশ বেড়ে ১৩.৯৫ বিলিয়ন ডলার হয়েছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ওভেন পোশাক রপ্তানি থেকে আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৫.০৮ শতাংশ বেড়ে ৬.২২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে নিট পোশাক থেকে রপ্তানি আয় আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৭.১৪ শতাংশ বেড়ে ৭.৭২ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে হোম টেক্সটাইল রপ্তানি থেকে আয় আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৫.১৮ শতাংশ বেড়ে ৪৩৪.১৬ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
ইপিবির তথ্য বলছে, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে রপ্তানি আয়ও ১৭.৪২ শতাংশ বেড়েছে। তবে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় কৃষিপণ্য থেকে আয় কমেছে ২৩.৮১ শতাংশ, পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে আয় কমেছে ১.৯৬ শতাংশ, হিমায়িত ও জীবন্ত মাছ থেকে আয় কমেছে ২৩.৭৮ শতাংশ এবং প্রকৌশল পণ্য থেকে আয় কমেছে ৪৭.৬৬ শতাংশ।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অভ বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স একসঙ্গে কমে যাওয়াটা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের জন্য উদ্বেগজনক।
তিনি বলেন, রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ না বাড়া পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।
বাংলাদেশের রপ্তানি বৃদ্ধি পেতে শীতের শেষ পর্যন্ত লেগে যাবে বলে মন্তব্য করেন মনসুর।
রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক বলেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে অক্টোবরে রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক ধারা দেখাটা প্রত্যাশিতই ছিল।
তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধি খুব একটা কমেনি, কারণ গত বছরের অক্টোবরে রপ্তানি আয়ে বড় উল্লম্ফন হয়েছে এবং সর্বকালের সর্বোচ্চ রপ্তানি আয় এসেছে। সূত্র : টিবিএস