বিশ্বে সবচেয়ে বেশি হারে সবজির আবাদি জমি বেড়েছে দেশে
মতিনুজ্জামান মিটু : এক সময় দেশের মাত্র কয়েকটি অঞ্চলে, আর এখন দেশের প্রায় সব এলাকাসহ বসতবাড়ির আঙিনা, এমনকি ঘরের সাদেও সারা বছর সবজি চাষ হচ্ছে। শীত মৌসুমের সবজি এখন গ্রীষ্মকালেও পাওয়া যাচ্ছে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে দেশে ৬০ ধরনের প্রায় ২০০ জাতের সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেব মতে বর্তমানে দেশে ০.৪ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে সবজি চাষ হয়। এফএও অনুযায়ী সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন চীন ও ভারতের পরে এবং মোট উৎপাদন বাড়ানোর বার্ষিক হারে বিশ্বে তৃতীয়।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার ও প্রধান ডকুমেন্টেশন কর্মকর্তা ড. সুস্মিতা দাস বিভিন্ন সুত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে জানান, বাংলাদেশ গত একযুগে সবজি উৎপাদনে বিপ্লব ঘটিয়েছে। এসময় ব্যাপক হারে কৃষি জমি কমলেও উৎপাদন বেড়েছে পাঁচগুণ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা’র হিসেব মতে, প্রতিদিন একজন সুস্থ সবল মানুষের ২২০ গ্রাম সবজি গ্রহণ করা উচিত।
কিন্তু এফএও এবং ডিএই সূত্র মতে দেশে মাথাপিছু সবজি সরবরাহ নিশ্চিত করা যাচ্ছে মাত্র ১২৫ গ্রাম। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য এসডিজিতে ১৭টি অভীষ্টের মধ্যে কৃষি সম্পর্কিত অন্যতম অভীষ্ট হলো: ক্ষুধার অবসান, খাদ্য নিরাপত্তা ও উন্নত পুষ্টিমান অর্জন এবং টেকসই কৃষির প্রসার। ২০৩০ সালের মধ্যে ফসলের উৎপাদন দ্বিগুণ করতে হবে। বর্তমান সরকার কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচনের সঙ্গে সঙ্গে খাদ্য নিরাপত্তার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং কর্মসংস্থানে কৃষির ভ‚মিকা অনেক। উৎপাদিত কৃষিপণ্য সঠিকভাবে রপ্তানি করতে পারলে আয় ও সক্ষমতা বাড়বে। তখন মানুষের নিরাপদ ও পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্য গ্রহণের হারও বাড়বে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০৪১ সালের মধ্যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য বর্তমান সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। সরকার শুরু থেকেই কৃষিবান্ধব নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
সময়োপযোগী নির্দেশনায় বরেণ্য কৃষি বিজ্ঞানী কৃষিমন্ত্রীর আন্তরিক প্রচেষ্টায় আজ কৃষি ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে দেশ খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে এগিয়ে গেলেও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে এখনও পিছিয়ে। খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি নিরাপত্তা একে অপরের পরিপূরক। পুষ্টি নিরাপত্তা ছাড়া খাদ্য নিরাপত্তা সম্ভব নয়। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ এর অন্যতম উদ্দেশ্য হল টেকসই কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জন। বছরব্যাপী সবজিচাষ পারিবারিক পুষ্টি চাহিদার পাশাপাশি দারিদ্র্য দূরীকরণে সহায়ক হবে। এদেশের বাড়তি জনগোষ্ঠীর পুষ্টি ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য পরিমিত পরিমাণ সবজি ও ফল খাওয়ার কোনও বিকল্প নেই। কারণ শাকসবজি খনিজসহ পুষ্টির সঙ্গে অনেক বেশি জড়িত। এজন্য বসতবাড়ি আঙিনায় সারাবছর সবজি ও ফলের চাষ বাড়ানো দরকার। সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি কৃষি ক্ষেত্রে সরকারি কার্যক্রমের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা গেলেই পুষ্টিকর খাদ্য জোগানের মাধ্যমে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্ত জনপদ গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি), বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো’র শাকসবজির গবেষণা ও উন্নয়ন করার কাজ অব্যাহত রয়েছে। সরকার ৯০ এর দশকের শেষের দিকে হাইব্রিড ফসলের সূচনা করে এবং এটি দেশে হাইব্রিড সবজি উৎপাদনের সূত্রপাত। বেসরকারি খাত বিশেষ করে লাল তীর, এসিআই, মেটালএগ্রো এবং আরও কিছু প্রতিষ্ঠান প্রধানত: হাইব্রিড ফসল নিয়ে গবেষণা করছে। বেসরকারি খাতের সবজির বীজ বেশিরভাগই উৎপাদনে প্রাধান্য পায়। এদেশের বিজ্ঞানীদের উল্লেখযোগ্য হাইব্রিড বীজ আবিষ্কারের গবেষণা অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে বারি হাইব্রিড বীজ জাতের ওপর গবেষণা জোরদার করেছে। এর জন্য দরকারে বেশি সংখ্যক দক্ষ সবজি প্রজননবিদ। যাদের পর্যাপ্ত উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দরকার। বাংলাদেশে কৃষি গবেষণা কাউন্সিল সবজিসহ কৃষিতে গবেষণার অগ্রাধিকার চিহ্নিত করার সঙ্গে জড়িত। সবজিসহ নানামুখী গবেষণায় তহবিল সংগ্রহ ও বিতরণ করে থাকে। উচ্চতর অধ্যয়ন এবং বৃত্তিমূলক দক্ষতা অর্জন প্রোগ্রামেরও আয়োজন করে। বর্তমানে বিএআরসি সবজি বৈচিত্র্যময় এলাকায় গবেষণা প্রকল্পে সহায়তা করছে। হাইব্রিড বীজ আমদানি করে বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হচ্ছে সিড কোম্পানিগুলো। বেশি দামে বীজ সংগ্রহ করতে কৃষকের লাভের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। বিএআরআই এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিভিন্ন জাতের সবজি অবমুক্ত করেছে। হর্টেক্স ফাউন্ডেশন কৃষি মন্ত্রণালয়ের তত্ত¡াবধানে বেসরকারি খাতের মাধ্যমে সবজি রপ্তানির প্রচার করছেণ। সব স্টেকহোল্ডারদের সম্পৃক্ত করে সবজি উৎপাদনের প্রচারের জন্য বাংলাদেশ অনেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এগুলো হলো জাতীয় ও তৃণমূল পর্যায়ে সবজিমেলা, পুষ্টি অভিযান, খাদ্যমেলা ইত্যাদি। এগুলো স¤প্রসারণকর্মী ও চাষিদের মধ্যে জ্ঞান স্থানান্তর করতে সহায়তা করে।
শাকসবজি স্বাস্থ্যের জন্য উত্তম কিন্তু বাজারে সব উৎপাদিত শাকসবজি এদেশের মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ নয়। কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শ ছাড়া অনেকে শাকসবজি উৎপাদনে ক্ষতিকর মাত্রায় বালাইনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হচ্ছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ফসল সংগ্রহোত্তর সংরক্ষণের অভাবে শাকসবজিতে বিভিন্ন জীবাণু পচন ধরে। শাকসবজি পরিষ্কারের জন্যও ব্যবহৃত হচ্ছে দূষিত পানি। তাই তা গ্রহণে মানুষের জন্য হয়ে উঠছে অনিরাপদ। অনেকে জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদের কথা বলেন। তবে মনে রাখা দরকার নিরাপদ শাকসবজি মানে শুধু জৈব পদ্ধতিতে চাষ করা শাকসবজিকে বুঝায় না। জৈব শাকসবজি ও ক্ষেত থেকে তোলার পর খাবার টেবিলে আসা পর্যন্ত নানাভাবে অনিরাপদ হতে পারে।
বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা মডিউলে রাসায়নিক সার ও মাটিতে সংযোজিত অন্যান্য বস্তু ব্যবহার করার সময় বাগানি বা কৃষককে মাটি জীবাণুমুক্ত করা, ভারী ধাতুর উপস্থিতি পরীক্ষা করে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়টি সংকটপূর্ণ বৈশিষ্ট্য বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। সবজি চাষের ক্ষেত্রে মাটি শোধনের পাশাপাশি গ্রোয়িং মিডিয়ার গুণাগুণ ও স্বাস্থ্য রক্ষা করতে হবে। ভার্মিকম্পোস্ট, রান্নাঘর ও খাবারের উচ্ছিষ্টাংশ দিয়ে বানানো সার, চা-কম্পোস্ট, ডিম খোসা ভাঙা মিশানো, নতুন মাশরুম কম্পোস্ট, নিমখৈল, সরিষাখৈল, ইত্যাদি ছাড়াও যে কোন বায়োলজিক্যাল কম্পোস্ট উৎস সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে ব্যবহার করতে হবে। রাসায়নিক পেস্টিসাইড ব্যবহারের ক্ষেত্রে বোতলের গায়ের নিয়মাবলি কঠোরভাবে পালন করতে হবে। বালাইনাশক ব্যবহারের পর পাতা ও ফল-জাতীয় সবজি আহরণের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণ করতে হবে। পোকা দমনে ফ্লাইং ইনসেক্টের জন্য ফেরোমন ট্রাপ, সোলার লাইট ট্রাপ, আঠালো ট্রাপ, পেঁয়াজ পাতার ও ছোলা পেস্ট বা নির্যাস, রসুনের, গাঁদা ও চন্দ্রমল্লিকার ফুলের নির্যাস ভালো কাজ করবে।
কৃষিমন্ত্রীর মতে বাংলাদেশের জন্য এখন দুটি চ্যালেঞ্জ : জনগণের জন্য পুষ্টি ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ এবং উৎপাদনমুখী খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করা। উৎপাদিত পণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে মূল্যসংযোজন ও রপ্তানি বাড়াতে পারলে দেশের বাজারও স¤প্রসারণ হবে। কৃষক তার ফসলের ন্যায্য দাম পাবে। আরও বাড়বে কৃষি উৎপাদন। নিশ্চিত হবে নিরাপদ ও পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্যের জোগান।