অর্থনীতির সংকট কবে শেষ কেউ বলতে পারছে না
বিশ্বজিৎ দত্ত : বিশ্ব অর্থনীতির আকাশে আবারো কালো মেঘ। অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কর্তা সকলেই প্রায় এক বাক্যে মানছেন যে, ২০২৩ সালের বিশ্বব্যাপী আর্থিক সঙ্কট এখনই শুরু হয়ে গিয়েছে। সামনের তা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা। এখনও পর্যন্ত যা ইঙ্গিত, তাতে এর প্রভাব বাংলাদেশের উপরেও পড়ছে। এমনিতেই দেশে অর্থনৈতিক সমস্যা আগে থেকেই অনেক। বিশ্বজোড়া মন্দায় সামনের বছরদেড়েক সেগুলি আরও বহু গুণ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। বাণিজ্য থেকে কাজের বাজার সঙ্কটের ছায়া পড়বে সর্বত্র। কত দিন এই সমস্যা চলবে, এর প্রভাব আগামী নির্বাচনে পড়বে কি না, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে সঙ্কটের কথা এখন সকলের মুখে। সরকার, বিরোধী, সিভিল কেউ একে অস্বীকার করতে পারছেনা।
১৯৩০-এর দশকে হওয়া গ্রেট ডিপ্রেশন বা মহামন্দার কথা আজও কেউ ভোলেননি। তার প্রভাব পড়েছিল সারা বিশ্বে। বিধ্বস্ত হয়েছিল বিশ্ব অর্থনীতি। এর পরের সাত দশকে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির আঙিনায় ধীরে ধীরে উন্নতি হয়েছে। এমন নয় যে, এই দীর্ঘ সময়ে সমস্যা আসেনি। উন্নত এবং উন্নয়নশীল দুনিয়ায় বার বার ধাক্কা এসেছে। চড়াই-উতরাইয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। তবু মোটের উপরে ভয়ঙ্কর সমস্যা এড়িয়ে একটা উন্নতির ধারা বজায় থেকেছে।
এবারের সমস্যার রূপ অনেকটা ১৪ বছর আগের ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরের মন্দার মতো সেই মন্দার অভিঘাতে ধসে গেল নিউ ইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিট। সে বার সমস্যার শিকড় ছিল বাড়ি তৈরি করা বা কেনার জন্য দেদার ধার। সঙ্কটের জেরেই নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছিল তখন সারা দুনিয়ায় এক ডাকে চেনা ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক লেম্যান ব্রাদার্স। কার্যত ডুবেছিল পুরো ব্যাংকি ব্যবস্থা। সেই সঙ্গে এআইজি, জিএম, ক্রাইসলার-সহ আরও অনেক সংস্থা। সেই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে সারা পৃথিবীর বহু দিন লেগেছিল।
এ বার আর্থিক সঙ্কটের কারণ রাশিয়া বনাম ইউক্রেনের যুদ্ধ। তেল, গ্যাসের দাম বাড়ছে হুহু করে। এতে প্রবল সমস্যার মুখে পশ্চিমি দুনিয়া। কারণ, সেখানে এর জেরে বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের মতো জ্বালানির দাম বাড়ছে হুড়মুড়িয়ে। অনেক জায়গায় ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ। ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের ২০০টি দেশের মধ্যে অন্তত ৫০টি দেশে খাওয়ার খরচে টান পড়তে শুরু করেছে। এক দিকে জ্বালানির বাড়তি খরচ মেটাতে গিয়ে খাবার কেনার সঙ্গতি নেই, অন্য দিকে টান খাবারের জোগানেও। আগামী দিনে এই সমস্যা আরও তীব্র হওয়ার সম্ভাবনা।জাতীসংঘ, বিশ্ব ব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার (আইএমএফ) থেকে শুরু করে প্রায় সকলেই মানছে যে, সামনে খুব খারাপ সময় অপেক্ষা করছে।
২০২০ সাল থেকে দেশে জাতীয় আয় কমেছে। বৃদ্ধির হার নয়, জিডিপি-র পরিমাণই কমে গিয়েছে সরাসরি। যেখানে দেশের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৮.১৫ এখন তা সাড়ে ৬ এর ঘরে। সিপিডির হিসাবে শুধু ২০২০-২১ সালে দারিদ্রসীমার নীচে নেমে গিয়েেছ ২০ লাখ মানুষ। বিশ্লেষকদের অনেকের মতে, এটি সর্বোচ্চ দারিদ্র। এই দরিদ্রদের আবার পর্যাপ্ত কাজও নেই। দেশে ২৮-২৯ বছর জনসংখ্যায় যুবক-যুবতীর এই বিপুল অনুপাত সম্পদ, যাকে আমরা ‘ডেমোগ্র্যাফিক ডিভিডেন্ড’ বলি। কিন্তু হাতে কাজ না পেলে, এই সম্পদেরই বোঝা হয়ে উঠতে দেরি হয় না।
এর সঙ্গে রয়েছে ধনের অসম বণ্টন। ধনকুবেরদের ঘরে টাকার পাহাড়, সেখানে দেশের বহু মানুষের খাবার জোটানোও কষ্টকর হচ্ছে। দেশের ইতিহাসে প্রথম বার দেড় বছর নাগাড়ে পাইকারি মূল্যসূচক (হোলসেল প্রাইস ইনডেক্স বা ডবিøউপিআই) ৯ শতাংশের উপরে। তেল-গ্যাস-খাদ্যপণ্য-নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র অগ্নিমূল্য। যাঁরা বাজারে যাচ্ছেন, তাঁদের হাতে দামের ছেঁকা। বিশ্ব অর্থনীতির বেহাল দশার কারণে সামনের বছরদেড়েক এই সমস্ত সমস্যা সম্ভবত আরও বাড়বে।