বাংলাদেশের দাবি-দাওয়া নিয়ে আলোচনা করতে আজ বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী
রিমন মাহফুজ, শার্ম আল শেখ (মিশর) থেকে : লোহিত সাগর উপকূলে মিসরীয় পর্যটন-নগরী শার্ম আল-শেখে পক্ষব্যাপী ২৭তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের (কপ-২৭) প্রথম সপ্তাহ শেষ হয়েছে। একদিন বিরতির পর আজ সোমবার থেকে দ্বিতীয় সপ্তাহে সম্মেলনে আলোচনা শুরু হবে। বাংলাদেশের পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন যোগ দিয়ে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক ফোরামের সঙ্গে আলোচনা করবেন।
গতকাল (রোববার) বন্ধ ছিল সম্মেলন। আজ দ্বিতীয় সপ্তাহে নেগিসিয়েশন পর্ব শুরু হচ্ছে। প্রথম সপ্তাহে ছিল শক্তিশালী কথামালা, নিঃশব্দ প্রতিবাদ ও সামান্য নগদ পাওয়া নিয়ে আলোচনা। বিশ্বের ১৯৬টি দেশের অন্তত ৪৫ হাজার প্রতিনিধি জলবায়ু সংকট থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে ৬ নভেম্বর থেকে জড়ো হয়েছেন নয়নাভিরাম শার্ম আল-শেখে। এ আলোচনা চলবে ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত। এ বছরের শুরু থেকেই বিশ্বব্যাপী বিধ্বংসী বন্যা, নজিরবিহীন তাপপ্রবাহ, তাপপ্রবাহের কারণে সৃষ্ট আগুন, মারাত্মক খরা ও ঘূর্ণিঝড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতারই লক্ষণ প্রকাশ করছে। সেই সঙ্গে সারা বিশ্বে লাখ লাখ মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য, জ্বালানি সংকট, মুদ্রাস্ফীতি এবং জীবনযাত্রায় ব্যয় বৃদ্ধি পরিস্থিতিকে আরও সংকটাপন্ন করেছে, যার প্রভাবে রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত এবং রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বের উন্নত ও উন্নয়নশীল বিভিন্ন দেশ তাদের জলবায়ু নীতি স্থগিত করে পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার দ্বিগুণ করেছে। এবারের কপ-২৭-এ মূলত তিনটি বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে; এক. জলবায়ু অভিযোজন, দুই. জলবায়ু অর্থায়ন এবং তিন. একটি ন্যায্যতাভিত্তিক রূপান্তর; যা জলবায়ু সংকটের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ, জাতি এবং নৃ-গোষ্ঠীগুলোর উন্নয়নের চাহিদাকে বিবেচনা করে।
এসব কিছু নিয়েই জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান প্রচেষ্টার পাশাপাশি চলতি সপ্তাহ সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মন্ত্রী পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক, বৈশ্বিক স্টকটেকের ওপর আলোচনা এবং অন্যান্য অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে।
ধনী বিশ্বই জলবায়ু সংকট সৃষ্টি করেছে। কিন্তু তুলনায় খুবই কম মাত্রায় কার্বন নিঃসরণ করা দরিদ্র বিশ্ব অত্যধিক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দরকার অর্থায়ন। সম্মেলনে উপস্থাপিত একটি নতুন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোয় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করতে হলে (জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে) ২০৩০ সালের মধ্যে বছরে প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন হবে।
দরিদ্র দেশগুলোকে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমাতে এবং চরম আবহাওয়ার প্রভাবগুলোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করার জন্য ২০২০ থেকে বছরে ১০০ বিলিয়ন দেওয়ার অঙ্গীকার করা হয়েছে। এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। ধনী দেশগুলো তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণে যত দীর্ঘ সময় ধরে ব্যর্থ হতে থাকবে, উন্নত দেশগুলোর ওপর উন্নয়নশীল বিশ্বের আস্থা তত কমতে থাকবে।
জলবায়ু অর্থায়নে উন্নত বিশ্ব যে অর্থ দেয়, তার বেশির ভাগই মধ্যম আয়ের দেশগুলোর নিঃসরণ কমানোর প্রকল্পে ব্যয় হয়। ফলে সবচেয়ে কম কার্বন নিঃসরণকারী দরিদ্র দেশগুলো সবচেয়ে কম সহায়তা পেয়েছে। চরম আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার উপায়গুলোর জন্য এসব দেশের সহায়তার বেশি প্রয়োজন। যেমন দরকার নতুন করে বনায়ন বাড়ানো, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা তৈরি করা এবং আগাম সতর্কতার ব্যবস্থা স্থাপন করা। বর্তমানে এসব খাতে তথা অভিযোজনের জন্য জলবায়ু অর্থায়নের মাত্র এক-পঞ্চমাংশ দেওয়া হচ্ছে। গত বছর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে এটি দ্বিগুণ করা হবে।
গ্লাসগো-শার্ম আল-শেখ ওয়ার্ক প্রোগ্রামের অধীনে অভিযোজনসংক্রান্ত বৈশ্বিক লক্ষ্যের (জিজিএ) একটি কাঠামো প্রতিষ্ঠার জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলো দৃঢ় আহ্বান জানিয়েছে। মিসরের তরফে অভিযোজনের জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয়েছে। অগ্রগতি কিছু হবে; কিন্তু অভিযোজনের জন্য অর্থায়ন দ্বিগুণ করার লক্ষ্য এ বছর পূরণ হবে না। ধনী দেশগুলোর ঔপনিবেশিক শোষণ ও লুণ্ঠনের শিকার দরিদ্র দেশগুলো। চরম জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করার জন্য প্রশ্নে তারা অসহায় অবস্থায় পর্যবসিত। কারণ, তাদের অর্থসংস্থান নেই। প্রয়োজনীয় অর্থ ছাড়া আগামী কয়েক দশকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতিতে আক্রান্ত দেশগুলো টিপিং পয়েন্টের দিকে দ্রুত ধাবমান হবে। টিপিং পয়েন্ট এমন এক অবস্থা, যা ছোট ছোট ক্ষতি বা নেতিবাচক পরিবর্তনগুলো বড় আকারের বিপর্যয়ের মুখে দাঁড় করানো। সংকট প্রলম্বিত হলে জলবায়ু বিশৃঙ্খলাকে অপরিবর্তনীয় হয়ে উঠতে পারে।
জলবায়ু সংকটের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলো একটি সমাধান সামনে নিয়ে এসেছে। তারা বলছে, যারা মূলত এই সংকট সৃষ্টি করেছে, তাদের তৈরি অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতির জন্য একটি তহবিল গঠন করতে হবে, নাম ‘অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি অর্থায়ন তহবিল’। ‘অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি’ জলবায়ু সংকটের বিধ্বংসী প্রভাবকে বোঝায়। এগুলো এমন ক্ষয়ক্ষতি, যা অভিযোজন প্রক্রিয়ায় তথা বর্তমান ও ভবিষ্যতের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিরসন করা সম্ভব নয়।
লস অ্যান্ড ড্যামেজ চলতি সম্মেলনের অফিশিয়াল অ্যাজেন্ডা বা মূল আলোচ্যসূচিতে দৃঢ়ভাবেই রয়েছে। তবে এ সম্মেলনে এর নিষ্পত্তি হবে না।
অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি আলোচনার কেন্দ্রে থাকলেও সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর প্রতিনিধিদের তুলনায় তেল ও গ্যাস কোম্পানিগুলোর লবিস্ট ছিল বেশি। শার্ম আল-শেখের সম্মেলনে তেল ও গ্যাসশিল্পের ৬৩৬ জন প্রতিনিধি রয়েছেন, যা আগের বছরের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেশি। গ্লাসগোতে এ সংখ্যা ছিল ৫০৩।
দূষণকারী লবিস্টদের নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় নিরবচ্ছিন্ন অধিকার দেওয়া হলে জলবায়ু সংকটের অর্থপূর্ণ মোকাবিলা ব্যাহত হবে। জাতিসংঘের (ইউনাইটেড নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ বা ইউএনএফসিসি) ক্রিটিক্যাল বা গুরুত্বপূর্ণ কাজকে প্রভাবিত করে কার্যকারিতাকে দুর্বল করে দেবে।
যুক্তরাষ্ট্র জলবায়ু অর্থায়নে তার দায়বদ্ধতা পূরণে বারবার ব্যর্থ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এখনো গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের অর্থ পাওনা রয়েছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বক্তৃতায় অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি বিষয়ের কোনো উল্লেখ নেই। তবে মিথেন গ্যাস কমানোর পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন। এই শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস নিয়মিতভাবে তেল ও গ্যাস উত্তোলনকালে নিজ থেকেই ও কৃষি থেকে নির্গত হয়। মিথেন গ্যাস বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মতো দীর্ঘস্থায়ী না হলেও নিঃসরিত হওয়ার পর ২০ বছরে গড়ে ৮০ গুণ বেশি তাপ আটকে রাখে।
বার্লিনভিত্তিক সংস্থা ক্লাইমেট অ্যানালিটিকসের মতে, যুক্তরাষ্ট্রে অনুমোদিত নতুন গ্যাস প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে ২০৩০ সালের মধ্যে মিথেন নির্গমন ৫০০ শতাংশ বাড়তে পারে। চীনের জলবায়ুবিষয়ক দূত শি ঝেনহুয়া যুক্তরাষ্ট্রের দূত জন কেরির সঙ্গে আলোচনা-পরবর্তী সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্রকে আলোচনার ‘বাধাগুলো দূর করার’ আহ্বান জানিয়েছেন। তার ভাষায়, ‘যুক্তরাষ্ট্র দরজা বন্ধ করে দিয়েছে এবং চীন এটি খোলার চেষ্টা করছে।’
মার্কিন কংগ্রেসের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান পরিদর্শনের জেরে বিশ্বের বৃহত্তম কার্বন নিঃসরণকারী এই দুই দেশের সম্পর্কে তিক্ততা বেড়েছে। ইন্দোনেশিয়ার বালিতে আগামী সপ্তাহে অনুষ্ঠেয় জি-২০ সম্মেলনে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের দেখা হবে। তাদের আলোচনায় তাইওয়ান আলোচ্যসূচির শীর্ষে থাকবে। কূটনৈতিক স্থবিরতা ইতিমধ্যেই জলবায়ু আলোচনার ওপরও ছায়া ফেলেছে।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে একটি অভিন্ন কৌশল বাস্তবায়নের প্রচেষ্টায় যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তার ভাষায়, ‘সহযোগিতা বা ধ্বংস’ কিংবা ‘জলবায়ু সংহতি চুক্তি বা জলবায়ু আত্মহত্যা’—যেকোনো একটিকে বেছে নিতে হবে।