মাংসের বিকল্প হিসেবে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে কাঁঠালসহ উদ্ভিদজাত খাদ্য
মতিনুজ্জামান মিটু : পশ্চিমা বিশ্বে মাংসের বিকল্প হিসেবে দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে কাঁঠাল। বিভিন্ন সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী পরিচালক মো. আখতারুজ্জামান জানান, উদ্ভিদভিত্তিক মাংস। টফু এবং সয়া মিট বা কাঁঠালের ইচর। উদ্ভিদভিত্তিক মাংস এমন কিছু যা উদ্ভিদ বা ছত্রাক থেকে উদ্ভূত প্রাণীজ মাংসের স্বাদ এবং পুষ্টির বিকল্প।
পুষ্টির ক্ষেত্রে উদ্ভিদজাত মাংসকে এমনভাবে তৈরি করা হয়ে থাকে যাতে প্রাণিজ মাংসের বেশ কয়েকটি উপাদান থাকে। যার মধ্যে প্রোটিন, ফ্যাট, বি-ভিটামিন এবং আয়রন উল্লেখযোগ্য। উদ্ভিদভিত্তিক মাংসে কোলেস্টেরল না থাকলেও কিছু স্যাচুরেটেড ফ্যাট রয়েছে। এছাড়া তাতে প্রাণী উৎসের মাংসের চেয়ে বেশি সোডিয়াম থাকে। অন্যদিকে, উদ্ভিদভিত্তিক বিকল্পগুলোর মধ্যে প্রায় সব প্রাণিজ খাদ্যের চেয়ে একটি উপাদান বেশি থাকে। তা হলো ফাইবার।
বেশির ভাগ প্রাপ্তবয়স্কদের খাওয়ার জন্য প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় গড়ে নূন্যতম ১৫ গ্রাম ফাইবার দরকার। তাই উদ্ভিদভিত্তিক বিকল্পগুলো বেশি খাওয়া হলে এপ্রয়োজনীয়তা পূরণ করার পথে সহায়ক হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা প্রতিনিয়ত প্রাণিজ মাংস না খেয়ে মাঝে মাঝে উদ্ভিদভিত্তিক মাংস সাপ্তাহিক মেনুতে নিয়মিত সংযোজনের জন্য পরামর্শ দেন। যা লালমাংসের পরিমাণ কমাতে সহায়তা করে।
সিঙ্গাপুরভিত্তিক ফুড টেক স্টার্টআপ ‘কারানা ফুডস’ জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং কাঁঠাল থেকে তৈরি মাংসের বিকল্পের মাধ্যমে কৃষক, ভোক্তা এবং শেফদের উন্নয়নে কাজ করছে। ‘কারানা ফুডস’র প্রধান টেকসই উপদেষ্টা আনিয়ামাডালিনস্কার মতে, এটি একটি সত্যিই সুস্বাদু উদ্ভিদভিত্তিক বিকল্প। কাঁঠালের স্বাদ এবং বহুমাত্রিক গুণাগুণ ‘কারানা’র পণ্যকে অনন্য করে তোলে। শেফরা রান্নায় সৃজনশীল হয়ে কাঁঠালকে আকর্ষণীয় খাবারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করছেন যা গ্রাহকদের অবাক করে। যেহেতু এফল উৎপাদন সহজ এবং একটি কাঁঠাল গাছ থেকে বছরে ২০০টি পর্যন্ত কাঁঠাল পাওয়া যেতে পারে। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে তাই খাদ্য ঘাটতি পূরণে কাঁঠাল চাষের উদ্যোগ নেওয়া উচিত। প্রতিদিনের খাদ্যে পর্যাপ্ত প্রোটিন পাওয়া অনেক চ্যালেঞ্জিং। ভালও স্বাস্থ্যের জন্য প্রতিদিন প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে উদ্ভিদভিত্তিক মাংস হিসেবে কাঁঠাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
উদ্ভিদভিত্তিক মাংস পরিবেশের ওপর তুলনামূলক কম বিরূপ ফেলায় উন্নত বিশ্বে জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। উন্নত বিশ্বের দুটি সর্বাধিক জনপ্রিয় বিকল্প মাংসের তৈরী বার্গার হলো ইম্পসিবল বার্গার ও বিয়ন্ড বার্গার। যা ৪০ হাজার রেস্তোরাঁ ও মুদি দোকানগুলোতে বিক্রি হয়। তারা উদ্ভিদ উৎসের উপাদান ব্যবহার করার সময়, প্রোটিনের মূল উপাদানগুলোর মধ্যে ভিন্নতা তৈরি করে।
বিয়ন্ড বার্গার মটর, মুগডাল এবং ভাতের মতো উপাদান দিয়ে তৈরি করা হয়। তবে ইম্পসিবল বার্গারে ঘন সয়া প্রোটিন, নারকেল তেল এবং সূর্যমুখী তেল অন্তর্ভুক্ত থাকে। তবে অন্যতম প্রধান পার্থক্য হলো ইম্পসিবল বার্গার মাংসের বিকল্প হিসেবে মাংসের স্বাদকে বজায় রাখতে সক্ষম হচ্ছে। চর্বিযুক্ত গরুর মাংসের বার্গার এবং ইম্পসিবল বার্গারের সঙ্গে ক্যালোরি গণনার ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে সমান, তবে সব উদ্ভিদভিত্তিক মাংসেও পর্যাপ্ত পরিমাণে সোডিয়াম এবং স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে। বর্তমানে নিশ্চিত করা হচ্ছে, উদ্ভিদভিত্তিক খাবারগুলো ভবিষ্যতের খাদ্য হবে।
বহু বছর ধরে উদ্ভাবনের পরে ব্র্যান্ডগুলো কাঁঠাল, সয়াবিনের শিকড় এবং মটর প্রোটিনের মতো উদ্ভিদের উপাদানগুলো থেকে তৈরি খাদ্য মাংসের বিকল্প তৈরি করতে পারছে। উদ্ভিদভিত্তিক মাংসের চাহিদা থাকার সবচেয়ে উৎসাহজনক লক্ষণ হলো বড় মাংস উৎপাদনকারীরা উদ্ভিদভিত্তিক বিকল্পগুলোতে বিনিয়োগ করছেন। হোয়াইট ক্যাসেল তার রেস্তোরাঁগুলোতে ইম্পসিবল বার্গার নিয়ে এসেছে, বার্গার কিং তার প্রায় ৭৩০০ রেস্তোরাঁগুলোতে বিয়ন্ড বার্গারের জায়গা দিয়েছে এবং ওয়েন্ডির মতো অনন্য ব্র্যান্ড মাংসের বিকল্প নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। সুপারমার্কেটগুলোতে সাধারণ মাংস বিভাগে উদ্ভিদভিত্তিক মাংস প্রতিস্থাপন শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে একইভাবে বিক্রয়ও বাড়বে বলে আশা করা যায়। উদ্ভিদভিত্তিক মাংস খাওয়া বেশির ভাগ লোকেরা নিরামিষাশী নয়, তারা সার্বজনীন ভোক্তা খাদ্যের বৈচিত্র্য চান। সা¤প্রতিক বছরগুলোতে, গবেষণার একটি ক্রমবর্ধমান ফলাফল লাল মাংস খাওয়াকে হৃদরোগ, ক্যান্সার এবং ডায়াবেটিসের মতো সমস্যার সঙ্গে যুক্ত করেছে। জাতিসংঘের মতে মাংসের উৎপাদন, বনাঞ্চল, জমির অবনতি এবং জলের দূষণের দিকে পরিচালিত করে। জলবায়ু পরিবর্তন যেমন বিশ্বজুড়ে কৃষিক্ষেত্রকে কমায়, জাতিসংঘ দেশগুলোকে মাংস উৎপাদনে বিনিয়োগের পরিবর্তে বেশি পুষ্টিকর ফসল বাড়িয়ে তাদের খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থাকে আরও টেকসই করতে উৎসাহ দিচ্ছে।
সব প্রোটিন অ্যামিনো অ্যাসিড দিয়ে গঠিত, যদিও প্রতিটি অ্যামিনো অ্যাসিডের পরিমাণ প্রোটিন উৎসের ভিত্তিতে পরিবর্তিত হয়। প্রাণিজ প্রোটিনগুলো সম্পূর্ণ, তবে উদ্ভিদের প্রোটিনগুলো সম্পূর্ণ নয়। মোট প্রায় ২০টি অ্যামিনো অ্যাসিড রয়েছে। যা মানবদেহ প্রোটিন তৈরিতে ব্যবহার করে। এঅ্যামিনো অ্যাসিডগুলো প্রয়োজনীয় বা অপ্রয়োজনীয় হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়। দেহ নিজ থেকে অপ্রয়োজনীয় অ্যামিনো অ্যাসিড তৈরি করতে পারে তবে প্রয়োজনীয় অ্যামিনো অ্যাসিড তৈরি করতে পারে না, যা খাদ্যের মাধ্যমে গ্রহণ করা দরকার।
সুস্বাস্থ্যের জন্য, দেহের সঠিক অনুপাতে প্রয়োজনীয় সব অ্যামিনো অ্যাসিডের দরকার। মাংস, মাছ, হাঁস-মুরগি, ডিম এবং দুগ্ধের মতো প্রাণিজ প্রোটিনের সম্পূর্ণ উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ এগুলোতে দেহে কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় সব অ্যামিনো অ্যাসিড রয়েছে। বিপরীতে, উদ্ভিদ প্রোটিন উৎস যেমন : শিম, মসুর এবং বাদামগুলো অসম্পূর্ণ হিসাবে বিবেচিত হয়। কারণ এগুলোতে দেহের প্রয়োজনীয় অ্যামিনো অ্যাসিডগুলোর এক বা একাধিক অভাব রয়েছে। তবে সয়া প্রোটিনকে সম্পূর্ণ প্রোটিন হিসেবে গণ্য করে।
উদ্ভিদে প্রচুর পুষ্টিগুণ পাওয়া যায় যা প্রাণী হতে আসা খাদ্যে পাওয়া যায় না। উভয় খাদ্য সুষম পরিমাণে খাওয়া প্রয়োজনীয় সব পুষ্টি গ্রহণের সেরা উপায়। ভিটামিন বি ১২, ভিটামিন ডি, ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, ডিএইচএ, হিম-আয়রন এবং দস্তা প্রাণীর প্রোটিন উৎসগুলোতে বেশি থাকে। আবার মাংস বিভিন্ন রোগের কারণ হতে পারে। লাল মাংস একটি উচ্চ মানের প্রোটিন উৎস। বেশ কয়েকটি পর্যবেক্ষণমূলক গবেষণা লাল মাংস খাপওয়াকে হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং প্রাথমিক মৃত্যুর ঝুঁকির সঙ্গে সংযুক্ত করেছে।
গবেষণামতে, নিরামিষাশীদের শরীরের ওজন, কোলেস্টেরল এবং রক্তচাপের মাত্রা কম থাকে যার কারণে লাল মাংস ভোজীদের চেয়ে তাদের হৃদরোগ থেকে স্ট্রোক, ক্যান্সার এবং মৃত্যুর ঝুঁকি কম থাকে।
উদ্ভিদের প্রোটিনযুক্ত উচ্চ খাদ্যগুলো আপনার ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে পারে। ২০ বছরেরও বেশি বয়সী ১২ লাখ পুরুষ এবং মহিলাকে অনুসরণ করে একটি পর্যবেক্ষণ গবেষণায় দেখা যায়, বেশি বাদাম খাওয়া ওজন কমার সঙ্গে যুক্ত ছিল।
এ ছাড়াও, প্রতিদিন খাদ্য তালিকায় মটরশুঁটি, ছোলা, মসুর বা ডাল পরিপূর্ণতা বাড়াতে পারে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং ওজন কমাতে পারে। নিরামিষাশী থাকা লোকেরা সাধারণ জনগণের চেয়ে বেশি স্বাস্থ্য সচেতন হন।
উদ্ভিদভিত্তিক মাংস বেছে নেওয়ার পক্ষে একটি যুক্তি রয়েছে তা হলো পরিবেশগত দায়বদ্ধতা। হার্ভার্ড গবেষকরা নোট করেছেন, ‘মাংস ও দুগ্ধ গ্রহণ কমানো জরুরি প্রয়োজন’ এবং পশুর উৎসর পরিবর্তে উদ্ভিদ উৎস থেকে প্রোটিন পেতে পরিবেশের জলবায়ু ও তাপমাত্রার ঝুঁকি কমানোর ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণভাবে সহায়তা করবে। আন্তর্জাতিক প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট অনুসারে, প্রাণিসম্পদ পালন পৃথিবীর ভূমি পৃষ্ঠের ৪৫ শতাংশ ব্যবহার করেছে এবং ২০১১ সালে বিশ্বব্যাপী গ্রিনহাউজ গ্যাসের ১৮শতাংশেরও বেশি অবদান রেখেছে। উদ্ভিদ উৎস হতে তৈরি একটি বার্গার যে পরিমাণ জমি ব্যবহার করে তৈরি করা যায় সে সাইজের একটি প্রাণী উৎস হতে তৈরি বার্গারের ক্ষেত্রে ১৪ গুণ বেশি জমি ব্যবহার করতে হয়। একটি সুইমিং পুলের সমান পরিমাণ পানি ব্যবহার করে উদ্ভিদ উৎসের ৬০,৮৩৭টি বার্গার তৈরি করা যায় আর প্রাণী উৎসের মাত্র ৩১২টি বার্গার তৈরি করা যায়।
জাতিসংঘের মতে, মাংস শিল্পটি গ্রীনহাউজ গ্যাস নির্গমনের বৃহত্তম সর্বাধিক উৎস। ক্যালোরির ভিত্তিতে গরুর মাংস বায়ুমন্ডলে তোফুর চেয়ে ১৭.৭ গুণ বেশি পরিমাণে জিএইচজি, শিমের চেয়ে ৫০ গুণ বেশি এঐএ এবং বাদামের চেয়ে প্রায় ১৮০ গুণ বেশি এঐএ নিঃসরণে অবদান রাখে।
মাংসের উৎপাদন বনাঞ্চল, জমির অবক্ষয় এবং জলের দূষণের দিকেও নিয়ে যায়। একক ক্যালোরি মাংস উৎপাদন করতে পনি থেকে ফসল, জমি পর্যন্ত প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ দরকার। যদি সেই প্রাণিসম্পদ গুলোর পরিবর্তে উদ্ভিদভিত্তিক খাবারের জন্য ব্যবহার করা হয়, পৃথিবী কম জমিতে আরও বেশি ক্যালোরি তৈরি করতে সক্ষম হবে।
বর্তমানে, প্রাণিসম্পদের জন্য বিশ্বের কৃষিক্ষেত্রের ৮০শতাংশ জমি দরকার। এজমির কিছু অংশ উদ্ভিদভিত্তিক খাবারগুলোর জন্য ব্যবহার করা হলে পৃথিবীর জনগণকে খাওয়ানোর দরকারি ফসলের জমির পরিমাণ কমানো এবং কৃষকদের ল্যান্ডস্কেপগুলো আবার ফসল উৎপাদনে ব্যবহার করা সম্ভব।