দেশে চাষের জমির সঙ্গে কমছে মাটির উর্বরতা, বাড়ছে সারের ব্যবহার
মতিনুজ্জামান মিটু: দেশে দিন দিন মানুষ বাড়ছে এবং শিল্পায়ন, নগরায়ন, বাড়িঘর নির্মাণ, রাস্তাঘাট তৈরিসহ নানা কারণে চাষের জমি কমছে। এদুই সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন। অন্য দিকে মাটির উর্বরতা শক্তিও কমছে। এবছরের বিশ্ব মৃত্তিকা দিবসকে সামনে নিয়ে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট(এসআরডিআই)এর মহাপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত.) মো. কামারুজ্জামান জানান, মৃত্তিকা সব স্থলজ প্রাণির খাবারের প্রধান উৎস এবং বাস্তুতন্ত্রের ধারক ও বাহক। বিশ্বের সব জীব মাটি থেকে শুরু এবং মাটিতেই শেষ। এটি শুধু খাদ্য নয় ওষুধেরও প্রধান উৎস।
বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস-২০২২ এর গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি জানান; মাটির স্বাস্থ্য, টেকসই ব্যবস্থাপনা ও অবক্ষয় সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোই এদিনের উদ্দেশ্য। প্রকৃপক্ষে, সব স্থলজ প্রাণির জন্য মাটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এবছরের প্রতিপাদ্য ‘মাটি : খাদ্যের সূচনা যেখানে’ (সয়েলস: হয়ার ফুড বিগিনস)। এ প্রতিপাদ্যের লক্ষ্য মাটির স্বাস্থ্য ও টেকসই ব্যবস্থাপনার ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বিশ্বের সব মানুষের খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এ ছাড়া বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস সুস্থ বাস্তুতন্ত্র এবং মাটির উন্নত স্বাস্থ্য সম্পর্কে সমাজের সবাইকে সচেতন ও উৎসাহিত করতে সাহায্য করে।
বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস (ওয়ার্ল্ড সয়েল ডে) প্রতিবছর ৫ ডিসেম্বর উদযাপন করা হয়। এর প্রধান উদ্দেশ্য সুস্থ মাটির গুরুত্বের ওপর সংশ্লিষ্ট সবার মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করা এবং মৃত্তিকা সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনার প্রচারণার মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানো।
২০০২ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব সয়েল সায়েন্স (আইইউএসএস) মাটি নিয়ে প্রতি বছর একটি উৎসব বা অনুষ্ঠান করার জন্য একটি আন্তর্জাতিক দিবস নির্ধারণের সুপারিশ করে। থাইল্যান্ড এর রাজার নেতৃত্বে এবং গেøাবাল সয়েল পার্টনারশিপ এর কাঠামোর মধ্যে, এফএও বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বাড়ানোর প্ল্যাটফর্ম হিসাবে বিশ্ব মৃত্তিকা দিবসের আনুষ্ঠানিক যাত্রা বা সূচনাকে সমর্থন করে। ২০১৩ সালের জুন মাসে এফএও সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস পালনের ধারণাটিকে অনুমোদন করা হয় এবং জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৮তম অধিবেশনে এটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদনের অনুরোধ জানানো হয়। ডিসেম্বর ২০১৩ সালে, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ৫ ডিসেম্বর ২০১৪ কে প্রথম বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস হিসেবে মনোনীত করে।
থাইল্যান্ডের প্রয়াত রাজা ভূমিবল আদুলিয়াদেজ মৃত্তিকা সম্পদের গুরুত্ব প্রচার –প্রসারে সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। সবচেয়ে মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ মৃত্তিকার প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি, ভালোবাসা এবং আবেগ বিশ্বব্যাপী সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টিআকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। ৫ ডিসেম্বর থাইল্যান্ডের প্রয়াত রাজার জন্মদিনও বটে। ৫ ডিসেম্বর বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস ঘোষণার মাধ্যমে রাজার অনবদ্য কাজ ও স্মৃতির প্রতি সম্মান জানানো হয়। সেই থেকে বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস টেকসই মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব এবং এর প্রচার-প্রচারণার দায়িত্ব পালন করে আসছে। সারা বিশ্বে দিনটিকে মাটির স্বাস্থ্য এবং এর ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে বিজ্ঞানী, ছাত্র, কৃষকদেরকে অবহিত ও অনপ্রাণিত করার জন্য ব্যবহার করা হয়। দিবসটির গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য প্রতি বছর আলাদা আলাদা থিম ব্যবহার করা হয়।
মহাপরিচালক কামারুজ্জামান জানান, মানুষের জীবিকা ও খাদ্য নিরাপত্তা নির্ভর করে মাটির স্বাস্থ্য ও টেকসই ব্যবস্থাপনার ওপর। মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার জন্য মাটির গুরুত্ব অপরিসীম। দেশে দিন দিন মানুষ বাড়ছে এবং শিল্পায়ন, নগরায়ন, বাড়িঘর নির্মাণ, রাস্তাঘাট তৈরিসহ নানা কারণে চাষের জমি কমছে। এদুই সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন। অন্য দিকে মাটির উর্বরতা শক্তিও হ্রাস পাচ্ছে। এসব বিবেচনায় খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে টেকসই মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনাসহ শস্যের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। সেজন্য মাটির স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সচেষ্ট হতে হবে।
এসআরডিআই মহাপরিচালকের মতে, মাটি বাঁচলে পরিবেশ বাঁচবে, দেশ বাঁচবে। পরিবেশ বাঁচলে রক্ষা পাবে প্রাণি ও উদ্ভিদজগৎ। জীবিকা নির্বাহের জন্য সব জীব মাটির উপর নির্ভরশীল। মাটিতে হাজার হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ জন্মায়। উদ্ভিদ মাটি থেকে বিভিন্ন ধরণের পুষ্টি সংগ্রহ করে। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণি উদ্ভিদ থেকে তাদের পুষ্টি নেয়। উদ্ভিদ থেকে মানুষ খনিজ, ভিটামিন এবং প্রোটিন নেয়, যা তাদের বেঁচে থাকার জন্য দরকার। অর্থাৎ খাদ্যের জন্য মানুষ মাটির উপর নির্ভরশীল।
মানুষ যখন ফসল সংগ্রহ করে তখন ফসলের সঙ্গে সঙ্গে মাটির কিছু পুষ্টি উপাদানও তারা নিয়ে যায়। একে বলা হয় মাটির পুষ্টি রপ্তানি। এর ফলে মাটিতে পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি দেখা দেয়। উদ্ভিদ মাটি থেকে যে পুষ্টি নেয়, তা সার বা অন্য কোন উপায়ে মাটিতে ফেরত দিতে হবে। এতে মাটির উর্বরতামান বজায় থাকবে।
পৃথিবীর খাদ্যের চাহিদা পূরণের জন্য মাটি অত্যাবশ্যক। বিশ্বের প্রায় ৯৫ ভাগ খাদ্য জোগান দেয় মাটি। সুস্থ মাটি পৃথিবীর ক্ষুধা দূর করতে এবং মানুষের জন্য স্বাস্থ্যকর একটি গ্রহ উপহার দিতে সক্ষম। মাটির পুষ্টির ভারসাম্যহীনতা একটি প্রধান বৈশ্বিক সমস্যা, যা পুষ্টির অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার, অপব্যবহার কিংবা অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে ঘটে থাকে। সারের অতিরিক্ত ব্যবহার বা অপব্যবহার বাস্তুতন্ত্রের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং জীব বৈচিত্র্যের ক্ষতি সাধনসহ গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন ও জলবায়ু পরিবর্তনে অবদান রাখে।
ক্রমবর্ধমান বিশ্ব জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটানো একুশ শতকের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহের জন্য ফসল উৎপাদন বাড়ানোর দরকার হবে। ক্রমবর্ধমান ভূমি ক্ষয়, মৃত্তিকার উর্বরতা হ্রাস এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কৃষি উৎপাদনের এই প্রয়োজনীয় বাড়ানো সহজসাধ্য নয়।
জনসংখ্যা বাড়ানো, মাটির ক্ষয়, খাদ্য পরিবর্তন, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদির সমন্বিত প্রভাব বিশ্বব্যাপী ভবিষ্যতের খাদ্য উৎপাদনের জন্য উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। ফসল উৎপাদনের ফলে দরকারি পুষ্টি উপাদান মাটি থেকে ক্রমান্বয়ে অপসারিত হয়। সার প্রয়োগের মাধ্যমে অপসারিত পুষ্টি উপাদানগুলোকে সম্পূর্ণ প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয় না এবং প্রতি বছর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, বারবার ফসল ফলানোর ফলে মাটির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পায়। ক্রমবর্ধমান খাদ্য চাহিদার সঙ্গে তালমিলিয়ে চলার জন্য চাহিদা এবং উৎপাদনের মধ্যে ব্যবধান কমাতে হবে। খাদ্যের বাড়তি চাহিদা মোকাবেলায় প্রচলিত ও আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটাতে হবে। ভবিষ্যতে খাদ্য ও খাদ্যের জোগানে মাটির অবদান বজায় রাখার জন্য প্রযুক্তিগত উন্নতি এবং অন্যান্য উদ্ভাবনী পদ্ধতি ব্যবহারের দরকার হবে।
অসমহারে ও যথেচ্ছভাবে রাসায়নিক সার প্রয়োগ, জৈবসার ব্যবহার না করা বা কম করা, ফসল চাষের নিবিড়তা বৃদ্ধি, প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভূমি কর্ষণ, শস্যপর্যায় নীতিমালা অনুসরণ না করা, উফশী ও হাইব্রিড জাতের ফসলের আবাদ বৃদ্ধি, ফসলের অবশিষ্টাংশ জমিতে ব্যবহার না করা, মাটির অ¤øমান নিয়ন্ত্রণ না করা, মাটি পরীক্ষা না করে রাসায়নিক সার প্রয়োগসহ নানা কারণ মাটির স্বাস্থ্য বিনষ্টের প্রধান কারণ।
মাটির স্বাস্থ্য নষ্ট হওয়ার কারণে মাটির উর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায়, পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়, উপকারী অণুজীবের সক্রিয়তা কমে যায়, মাটিতে পুষ্টি উপাদানের ভারসাম্যহীনতা দেখা যায়, ফসলের ফলন ও গুণগতমান কমে যায় এবং ফসলের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়।
মাটির স্বাস্থ্য সংরক্ষণসহ ফসলের বেশি ফলনের জন্য মাটি পরীক্ষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মাটি পরীক্ষা ছাড়া জমিতে পরিমাণমতো সার দেওয়া যায় না। তাই সার সুপারিশ দেওয়ার জন্য মাটি পরীক্ষা অবশ্যই করতে হবে। এখানে উল্লেখ্য, মাটির স্বাস্থ্য সংরক্ষণসহ ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) বিভাগীয় ও আঞ্চলিক গবেষণাগারে মাটি পরীক্ষা করে পরীক্ষালব্ধ ফলাফলের ভিত্তিতে সুষম সার সুপারিশ দেওয়া হয়। মাটি পরীক্ষা করার ফলে মাটিতে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ, মাটির অ¤øমান ও মাটিতে থাকা জৈব পদার্থের পরিমাণ জানা যায় এবং সর্বোপরি মাটিতে ফসলের চাহিদা অনুযায়ী পরিমাণমতো সুষম সার দেওয়া যায়।
সুষম সার প্রয়োগে মাটির উর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ে, সারের অপচয় কম হয়, ফসলের উৎপাদন খরচ কমে যায়, উপকারী অণুজীবের কার্যাবলী বাড়ে, পুষ্টি উপাদানের ভারসাম্যতা বজায় থাকে, মাটির স্বাস্থ্য ভালও থাকে এবং সর্বোপরি ফসলের ফলন ও গুণগতমান বাড়ে।