শিশুসহ তরুণদের দেহেও বাসা বাঁধছে ডায়াবেটিস : ডা. আব্দুল্লাহ
শাহীন খন্দকার : দেশে দেশে ডায়াবেটিস রোগীদের চিকিৎসায় এক বছরে যে পরিমাণ অর্থ খরচ হয়, তা দিয়ে পদ্মা সেতুর মতো একাধিক সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। প্রধান মন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইমিরেটাস অধ্যাপক ডা.এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, শিশুদের মধ্যে ৫ শতাংশ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগী রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। এর বাইরেও বিশেষ ধরনের ডায়াবেটিস রয়েছে যেটা গর্ভাবস্থায় হয়। এটি সাধারণত প্রেগন্যান্সির ২৪ থেকে ২৮ সপ্তাহে হয়। অনেক ক্ষেত্রে এটি চলে যায় আবার কখনও কখনও তা সন্তান প্রসবের পর থেকেও যায়।
তিনি বলেন, কিভাবে বুঝবেন সন্তান এই রোগে আক্রান্ত, হঠাৎ করেই মোটা হয়ে যাওয়া, রাত জাগাসহ শিশুর ওজন কমে যাওয়া, দৃষ্টিশক্তিতে সমস্যা, অতিরিক্ত দুর্বলতা, মাথাব্যথা, খেলাধুলায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, মেজাজ খিটখিটে ইত্যাদি ল²ণ দেখে বুঝবেন।
এবিএম আব্দুল্লাহ আরও বলেন, শিশুদের ক্ষেত্রে আগে নির্ণয় করতে হবে কোন টাইপ ডায়াবেটিস। টাইপ ওয়ান হলেও ইনসুলিন। যদি টাইপ-টু হয়ে যায়,সেক্ষেত্রে হাঁটাহাঁটি বা খেলাধুলা করতে দিতে হবে শিশুকে। শিশুরা কেন এই রোগে আক্রান্ত হয়, প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, যে সব শিশু ছয় মাসের পর টাইপ ওয়ানে আক্রান্ত হওয়ার কারণ অগ্ন্যাশয়ের বিটাসেল (যেখান থেকে ইনসুলিন তৈরি হয়) ধ্বংস হওয়া। এটা অটো ইমিউনিটির কারণে হয়। তাই প্রথম দুই বছর শিশুকে অবশ্যই মায়ের বুকের দুধ দিতে হবে।
ডায়াবেটিসের কারণ সর্ম্পকে বলেন, প্রধানত বংশগত কারণে রোগটি হয়ে থাকে। মা বা বাবার যে কোনো একজনের ডায়াবেটিস থাকলে সন্তানের ঝুঁকি থাকে ১০ শতাংশ। মা-বাবা দুজনেরই থাকলে ঝুঁকি থাকে ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ। ডায়াবেটিস এমন একটি শারীরিক অবস্থা যা সারা জীবনের জন্যে বয়ে বেড়াতে হয় এবং সারা বিশ্বে এর কারণে প্রতি বছর ১০ লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যে কোন ব্যক্তিই এই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারেন। শরীর যখন রক্তের সব চিনিকে (গøুকোজ) ভাঙতে ব্যর্থ হয়, তখনই ডায়াবেটিস হয়। এই জটিলতার কারণে মানুষের হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক হতে পারে। এছাড়াও ডায়াবেটিসের কারণে মানুষ অন্ধ হয়ে যেতে পারে, নষ্ট হয়ে যেতে পারে কিডনি এবং অনেক সময় শরীরের নি¤œাঙ্গ কেটেও ফেলতে হতে পারে।
ডা. আব্দুল্লাহ বলেন, সারা বিশ্বেই এই সমস্যা বেড়ে চলেছে। বর্তমানে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৪২ কোটিরও বেশি। ৩০ বছর আগের তুলনায় এই সংখ্যা এখন চার গুণ বেশি, এই হিসাব বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার। ডায়াবেটিসের এতো ঝুঁকি থাকার পরেও যতো মানুষ এই রোগে আক্রান্ত তাদের অর্ধেকেরও বেশি এই রোগটি সম্পর্কে সচেতন নয়। তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, শরীরে যখন ইনসুলিন তৈরি হতে না পারে অথবা এটা ঠিক মতো কাজ না করে তখনই ডায়াবেটিস হয়। এবং এর ফলে রক্তের মধ্যে চিনি জমা হতে শুরু করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে ১৯৮০ সালে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় ১১ কোটি। ২০১৪ সালে সেটা বেড়ে হয় ৪২ কোটিরও বেশি। ১৯৮০ সালে ১৮ বছরের বেশি বয়সি মানুষের ডায়াবেটিস হওয়ার হার ছিল ৫ শতাংশেরও কম কিন্তু ২০১৪ সালের তাদের সংখ্যা বেড়ে দাড়িয়েছে ৮ দশকি ৫ শতাংশ। ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশন বলছে, প্রাপ্ত বয়স্ক যে সব মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত তাদের প্রায় ৮০ শতাংশ মধ্য ও নি¤œ আয়ের দেশের, যেখানে খুব দ্রæত খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন ঘটছে। সংস্থাটি বলছে, ২০১৬ সালে ডায়াবেটিসের কারণে প্রায় ১৬ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
বড়দের কেনো ডায়াবেটিস হচ্ছে প্রশ্নের জবাবে বলেন, অতিরিক্ত মোটা হয়ে গেলে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। যারা ¯িøম তাদের তুলনায় মোটা মানুষদের ঝুঁকি দশ গুণ বেশি। স্ট্রেস বা মানসিক চাপও রোগটির একটি বড় কারণ। অতিরিক্ত মানসিক চাপে স্ট্রেস হরমোন তৈরি হয়। এই হরমোনগুলো বেশি তৈরি হলেও তা ডায়াবেটিসের কারণ হতে পারে।
প্রয়োজনের চেয়ে কম ঘুমকেও বিপজ্জনক বলছেন চিকিৎসকরা। অনেকেই অতিরিক্ত রাত জাগেন এবং সঠিক নিয়মে ঘুমান না। এতে তার ডায়াবেটিস হতে পারে। তরুণ বা যুবকদের সর্ম্পকে এই মেডিসিন বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, তরুণ বা যুবকরা ডায়াবেটিসে আক্রান্তের লক্ষণ প্রায়ই বোঝা যায় না অনেক ক্ষেত্রেই। সাধারণত অন্য রোগের চিকিৎসা করতে গিয়ে রক্ত পরীক্ষায় ধরা পড়ে সেটি। ডেঙ্গু বা করোনার চিকিৎসা বা বিদেশ যাত্রার আগে মেডিক্যাল পরীক্ষায় ধরা পড়ছে রোগটি।
আধুনিক জীবনের নানা সুযোগ সুবিধা কায়িক পরিশ্রম কমিয়ে জীবনকে সহজসাধ্য করলেও তা তৈরি করছে নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি। তিনি বলছেন, সম্প্রতি এক সমিজ্ঞায় দেখা গেছে শুয়ে বসে থাকা, ফাস্ট ফুডে আসক্তি, খেলাধুলা না করাসহ নানা কারণে শিশু, কিশোর ও তরুণদের মধ্যেও ডায়াবেটিসের প্রকোপ বাড়ছে।
বিএসএমএমইউর সাবেক মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান আরও বলছেন, ১২ শতাংশের বেশি যুবক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এর কারণ যুবকরা এখন খেলাধুলা বা কায়িক শ্রম না করা, তারা ফাস্টফুডে আসক্ত, সেই সঙ্গে মোবাইল, ইন্টারনেটে সময় কাটাচ্ছে বেশি।
ইমেরিটাস অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ আরও জানিয়েছেন, লক্ষণ বলতে তেমন কিছু নাই। অনেক সময় কিছুই বোঝা যায় না। ধারণা করা হয়, বাংলাদেশে অন্তত ১২ শতাংশ মানুষ রোগটিতে আক্রান্ত। চলতি বছর ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশের ১ কোটি ৩১ লাখ মানুষের ডায়াবেটিস আছে। তাছাড়া হাইপোগøাইসেমিয়াতেও মানুষ মারা যায়। এটি সাধারণভাবে সুগার ফল বলে পরিচিত।
প্রতিরোধের উপায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, দিনে পাচঁ বেলা অল্প করে বার বার খেতে হবে। সঠিক নিয়মে হাঁটাহাঁটি করতে হবে। ওষুধ এবং ইনসুলিনের মাত্রা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক নিয়মে এডজাস্ট করতে হবে। তিনি বলেন, ৮৫ শতাংশ ডায়াবেটিস প্রতিরোধযোগ্য। সপ্তাহে অন্তত ৫ দিন ৪৫ মিনিট হাঁটতে হবে। সেই সঙ্গে সুষম খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ছয় ঘণ্টা ঘুমাতে হবে।