গ্যাস সংকট কাটলে বিজয়পুরের মৃৎশিল্পে বাড়বে কর্মসংস্থান
অর্থনীতি ডেস্ক : গ্যাস সংকটে কুমিল্লার বিজয়পুর মৃৎশিল্পের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বর্তমানে বিজয়পুর রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় লিমিটেডে ৬০ জন কারিগর যুক্ত আছেন। কর্তৃপক্ষের দাবি, গ্যাসের সংযোগ পুনরায় স্থাপিত হলে নতুন করে কর্মসংস্থান হবে ৫০০ মানুষের। কর্মসংস্থানের পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি বাড়বে। কমবে ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পের বিলুপ্তির ঝুঁকি।
সূত্র জানায়, ২০১৭ সালে গ্যাস লাইনে সমস্যার কারণে সমিতির গ্যাসের চাপ শূন্য হয়ে যায়। সাধারণত মাটির পণ্য টেকসই ও নিখুঁত করতে কমপক্ষে ১২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার দরকার হয়। গ্যাসের চাপ না থাকাতে লাকড়ি দিয়ে মাটি পোড়ানোর কাজ করা হচ্ছে। যেখানে ৪০০ ডিগ্রি তাপমাত্রাও পাওয়া যাচ্ছে না। যার কারণে কাজের মান ঠিক থাকছে না। অনেক পণ্যে দাগ পড়ছে। কিছু কিছু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতির সভাপতি তাপস কুমার পাল বলেন, গ্যাস সংকটে পর্যাপ্ত উৎপাদন করতে পারছি না। গ্যাস দিয়ে পোড়ানো পণ্যের মান ভালো হয়। খরচ কম। নষ্টও হয় কম। আমাদের চাহিদা ব্যাপক। মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েন মাটির পণ্যের জন্য। কিন্তু উৎপাদন কম হওয়ায় দিতে পারি না। তিনি জানান, ১৯৯১ সালে গ্যাস সংযোগ পাই। বেলতলি থেকে লাইনটি পাঁচ কিলোমিটার পার হয়ে বিজয়পুর আসে। সেই লাইনে আবাসিক ও অবৈধ লাইন সংযুক্ত হওয়ায় ২০১৫ সালে চাপ কমে যায়। ২০১৭ সালে গ্যাসের চাপ শূন্য হয়ে যায়। এ নিয়ে আমরা সমবায় অধিদপ্তর ও বাখরাবাদ গ্যাস কোম্পানিতে দৌড়ঝাঁপ করছি। পাঁচ বছরেও কোনো সমাধান হয়নি।
তাপস জানান, গ্যাস সংযোগ হলে এ সমিতির মাধ্যমে কর্মসংস্থান হবে ৫০০ মানুষের। বর্তমানে ঢাকার দুটি প্রতিষ্ঠান আমাদের পণ্য রপ্তানি করছেন। তাদের মাধ্যমে আমাদের উৎপাদিত পণ্য যাচ্ছে জাপান, কানাডা, আমেরিকা, আরব আমিরাত ও হল্যান্ডে। গ্যাস সমস্যা কেটে গেলে আমরা নিজেরাই সরাসরি পণ্য রপ্তানির সক্ষমতা অর্জন করতে পারবো। পাশাপাশি আরও বেশি সংখ্যক দেশে পণ্য তৈরি করা সম্ভব হতো। বিজয়পুর রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় লিমিটেড সূত্রে জানা যায়, এ সমিতিতে প্রায় এক হাজার রকমের মাটির জিনিসপত্র তৈরি হয়। বিভিন্ন রকম শো-পিসের পাশাপাশি মাটির টেরাকোটা তৈরি করা হয়। যাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় মাটির টাইলস। মাটির টাইলস ঘর ঠাণ্ডা রাখে বিধায় এর চাহিদা ব্যাপক। হাড়ি পাতিল, বল-বাটি, মগ-জগ থেকে বের হয়ে তারা নান্দনিক সব শো-পিস তৈরি করেন। তারা তৈরি করেন মিনি শাপলা, মিনি লাউ ফুলাদানি, মিনি স্যান্ড কেউরি, লাইট স্যান্ড, রজনি রশি আমব্রেলা, মিনি হেমবাবু, আলপনা টব, প্লেইন টব, কাটিং হারিকেন, জামদানি টব, মট ল্যাম্প,ঝুলনা বাটি, ফুল ও ফলগাছের নানারকম টব। তবে তাদের উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ চাহিদা রয়েছে দইয়ের পাতিল, কাপ ও মগের।
স্থানীয় সূত্র মতে, কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার বিজয়পুরের মৃৎশিল্পের ঐতিহ্য ৪০০ বছরের। বিজয়পুর এলাকার সাতটি গ্রামের আট শতাধিক পাল সম্প্রদায় পরিবারের মানুষ মাটির হাড়ি পাতিল তৈরি করতেন। বর্তমানে কাজ করছেন শতাধিক পরিবার। গ্রামগুলো হচ্ছে তেগুরিয়াপাড়া, গাংকুল, দক্ষিণ বিজয়পুর, উত্তর বিজয়পুর, বারোপাড়া, দুর্গাপুর ও নোয়াপাড়া।
সমবায় আন্দোলনের পথিকৃত ড. আখতার হামিদ খান ১৯৬১ সালের ২৭ এপ্রিল যুবকদের সংগঠন প্রগতি সংঘের ১৫ জন যুবককে নিয়ে গড়ে তোলেন বিজয়পুর রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতি। তারা প্রতি জনে ১টাকা শেয়ার এবং ৫০ পয়সা আমানত দিয়ে সমিতির কাজ শুরু করেন। মোট ২২ টাকা ৫০ পয়সা মূলধন নিয়ে সমিতিটির যাত্রা শুরু হয়। ১৯৭১ সালে রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতিটি ধ্বংস করে দেয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু এ সমতিতে ৭৫ হাজার টাকা প্রণোদনা দেন। তারপর পুনরায় ঘুরে দাঁড়ায় এ সমিতি। বর্তমানে সমিতির সদস্য সংখ্যা ২৩০ জন। এর বর্তমান মূলধন আড়াই কোটি টাকার বেশি। সম্পত্তির পরিমাণ এক একর।
বিজয়পুর রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতির কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, কর্মচারীরা হাঁস, ঘোড়া, ময়ূর ও মনীষীদের প্রতিকৃতি তৈরি করছেন। কেউ ছাঁচ দিচ্ছেন। কেউ আঁকছেন আলপনা। আলাদা আলাদা কক্ষে পোড়ানো ও কাঁচা মাটির পণ্য রাখা হয়েছে। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও এ কাজে স্বাবলম্বী হচ্ছেন।
প্রোডাকশন বিভাগের চন্দন পাল জানান, আমি ২০ বছর ধরে এ প্রতিষ্ঠানে কাজ করছি। গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর থেকে কাজের গতি কমে গেছে। পুনরায় গ্যাস সংযোগ হলে কাজের গতি বাড়বে। সদর দক্ষিণ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা শুভাশিস ঘোষ বলেন, বিজয়পুর মৃৎশিল্প কুমিল্লার একটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান। এটি পরিদর্শন করেছি। এখানে গ্যাসের চাপ কম থাকায় তারা উৎপাদন বাড়াতে পারছেন না। তাদের এই সংকট নিরসনে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে কথা বলবো।
বাখরাবাদ গ্যাস সিস্টেম কোম্পানি লিমিটেডের উপ-মহাব্যবস্থাপক (ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিস) প্রকৌশলী মর্তুজা রহমান খান বলেন, যতটুকু জানি সংযোগ দেয়ার বিষয়ে তাদের একটা ফাইল চলমান রয়েছে। ফাইল দেখে বিস্তারিত বলতে পারবো। সূত্র : বাংলানিউজ