
কাতার বিশ্বকাপে শ্রমিক মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়ার বাংলাদেশের মিডিয়া কি শ্রমিক মৃত্যু নিয়ে কথা তুলেছে কখনো

বিশ্বজিৎ দত্ত: এক মৃত্যু উপত্যকায় চলছে বিশ্বকাপ। কাতারের আয়োজন নিয়ে এমনই প্রশ্ন তুলেছে আন্তর্জাতিক মিডিয়া। প্রবাসী শ্রমিকদের মৃত্যু মিছিল নিয়ে কথা কিন্তু শুরু হয়েছে বহু আগে। সাতটি স্টেডিয়াম-সহ নানা নির্মাণ কাজে ২০১০-২০ সময়কালে অন্তত সাড়ে ছ’হাজার অভিবাসী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে কাতারে। এর মধ্যে রয়েছেন ভারতের ২৭১১ জন, নেপালের ১৬৪১ জন, বাংলাদেশের ১০১৮ জন, শ্রীলঙ্কার ৫৫৭ জন। পাকিস্তান দূতাবাস থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী পাকিস্তানি শ্রমিক মারা গিয়েছেন অন্তত ৮২৪ জন। ফিলিপিন্স বা কেনিয়ার মতো দেশ থেকে আসা শ্রমিকের তথ্য মেলেনি, অতএব মোট মৃতের সংখ্যা আরও বেশি, দাবি উঠেছে। মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর হিসাবে মৃত্যুর সংখ্যা অন্তত ১৫,০২১।
শুধুমাত্র কাতারের গরমের কথা মাথায় রেখে বিশ্বকাপ হচ্ছে শীতে, কারণ গ্রীষ্মে কাতারের গড় তাপমাত্রা হামেশাই ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশেপাশে উঠে যায়। তা বলে পরিকাঠামো নির্মাণ তো গ্রীষ্মে বন্ধ থাকেনি। প্রচণ্ড গরম আর কর্মস্থলে উপযুক্ত সুরক্ষার অভাব শ্রমিকদের কতটা বিপর্যস্ত করেছে, মৃত্যুর সংখ্যা তার ইঙ্গিত মাত্র। তার উপর, সারা বিশ্ব থেকে আসা সমর্থক, সাংবাদিক, কর্মকর্তারা যে সব রাস্তা দিয়ে স্টেডিয়ামে যাবেন, সেই সব এলাকায় বসবাসকারী শ্রমিকদের দু’ঘণ্টার নোটিসে জায়গা খালি করে দেওয়ার ফতোয়াও জারি করেছে কাতার সরকার।
কাতারে অভিবাসী শ্রমিক প্রায় ৩৮ লাখ, জনসংখ্যার ৮৫%। কাতার-সহ পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোতে তেল, গ্যাসের পাইপলাইন ও আনুষঙ্গিক পরিকাঠামোর নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে যুক্ত কয়েক লাখ প্রবাসী ভারতীয় নির্মাণ শ্রমিক এরপরেই রয়েছে বাংলাদেশি। কিন্তু এ বিষয়ে বাংলাদেশের দূতাবাসের কাছে যথেষ্ট তথ্য নেই। অভিবাসী শ্রমিকদের বিষয়টি দেখার জন্য দূতাবাসে একটা পৃথক সেল থাকে, এবং পূর্ণ সময়ের জন্য একজন কর্মকর্তাও থাকেন। কিন্তু তিনি কি কাজ করেছেন এর কোন রিপোর্ট কখনো পাওয়া যায়না।
কাতারে শ্রমিক ইউনিয়ন নিষিদ্ধ। স্বাস্থ্য সুরক্ষা, জীবন বিমার মতো সুবিধাও নেই। ২০১৬ অবধি বহাল ছিল ‘আল-কাফালা’ নামে একটি ব্যবস্থা, যার বলে নিয়োগকর্তার অনুমোদন ছাড়া দেশত্যাগ নিষিদ্ধ ছিল। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার চাপে এই ব্যবস্থা উঠেছে, প্রবাসী শ্রমিকের নিরাপত্তার জন্য নতুন আইন হলেও সেগুলি সুরক্ষায় কার্যকর নয়। ২০১৮ সালে কাতারে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করতে গিয়ে মৃত্যু হয় মোশারফ হোসেনের। তার বড় ছেলে সেসময় আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় দাবি করেছিলেন মৃত্যুর পর কাতার সরকার তাদেও কোন ক্ষতি পূরণ দেয়নি। শুধুমাত্র নিয়োগকারী সংস্থা ৬৮৬ ডলার দিয়েছিল। কাতারের যে অবস্থা দেশেও শ্রমিকরা তেমনি অবস্থাতেই আছে। চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে বিএম কন্টেইনাওে আগুন দূঘটনার শিকার হয়ে অর্ধশতাধিক মানুষ মারা যান। নারায়ণ গঞ্জের হাশেম ফুড কারখানায় মারা যান আরাে অর্ধ শতাধিক মানুষ। রাণা প্লাজায় বিল্ডিং ধ্বসে হামিম গ্রুপের ও তানজিম ফ্যাশানে আগুনে পুড়ে মারা গেছে শতাধিক শ্রমিক।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) হিসাবে গত বছর বাংলাদেশে ১ হাজার ৫৩ জন শ্রমিকের কর্মক্ষেত্রে মৃত্যু হয়েছে। যা আগের বছরের চেয়ে ৪৪ শতাংশ বেশি। ২০২০ সালে মৃত্যু হয়েছিল ৭২৯ জনের। বিলসের পরিচালক নাজমা ইয়াসমিন তাদেও রিপোর্টে উল্লেখ করেন, নিরাপত্তা বিষয়ে মালিক ও কর্তৃপক্ষের ঔদাসীন্যই এর কারণ। তিনি বলেন, পরিবহণ শ্র্রমিকরাই বেশী দুর্ঘটনার শিকার হন। এরপরে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন,গার্মেন্ট শ্রমিক ও নির্মাণ শ্রমিক।
সরকারের তরফে দু’একরের চেয়ে বড় নির্মাণক্ষেত্রে, এবং ৩০-৪০ মিটার উঁচু বিল্ডিং তৈরি হলে নির্মাণ শ্রমিকদের সুরক্ষাজনিত যন্ত্রপাতি দেওয়ার কথা। কিন্তু কোথাও শ্রমিক সুরক্ষা বিধি মানা হচ্ছে না। না সড়ক পথে, না কারখানায়, না নির্মান কাজে। এসব কর্মক্ষেত্রে পরিদর্শন হয় না বললেই চলে। শ্রম দফতরের একই কথা পর্যাপ্ত লোকবল নাই।
