আসছে অসাম্প্রদায়িক ও জেন্ডার সংবেদনশীল পাঠ্যক্রম
অর্থনীতি ডেস্ক : ২০২৩ সাল থেকে শুরু হতে যাওয়া শিক্ষাক্রমে বদলে ফেলা হচ্ছে শিক্ষাপদ্ধতি, পাঠ্যবই, মূল্যায়ন প্রক্রিয়া সবই। নতুন পাঠ্যপুস্তক হতে যাচ্ছে সাম্প্রদায়িকতামুক্ত ও জেন্ডার-সংবেদনশীল। শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যবইকে আধুনিক, যুগোপযোগী, সংবেদনশীল ও অসাম্প্রদায়িক করতে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতামত ও পর্যবেক্ষণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সারাবাংলাকে একথা নিশ্চিত করেছেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। তিনি বলেন, লিঙ্গ সমতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যে আন্তর্জাতিক কমিটমেন্ট রয়েছে তা মাথায় রাখা হয়েছে। কোন বিষয়ের মাধ্যমে যেন জেন্ডার পরিচিত প্রোথিত না হয় সেটি মাথায় রেখে সাজানো হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানের মাধ্যমে মেয়েরা ঘরের কাজ করবে আর ছেলেরা কৃষিকাজ সেটি যেন কারও মাথায় না ঢোকে তা লক্ষ্য রাখা হয়েছে। বয়সসীমা অনুযায়ী সব মানুষকেই যে সব কাজ করতে হবে তা মাথায় রেখেই কাজ করেছি। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য (শিক্ষাক্রম) ও সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষা) মো. মশিউজ্জামান বলেন, জেন্ডার বিষয়ে রিভিউ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেন্ডার বিভাগের শিক্ষক। আবার সামগ্রিকতা রিভিউ করেছেন আইইআর-এর একজন শিক্ষক। প্রতিটি পাঠ্যপুস্তক সম্পর্কে তাদের মতামতের ওপর ভিত্তি করে পরিমার্জন বা পরিবর্তন করা হয়েছে। নতুন পাঠ্যপুস্তকে শুধু নারী-পুরুষই নয়, ট্রান্সজেন্ডারদের (ভিন্ন লিঙ্গ) বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে। ট্রান্সজেন্ডারদের নিয়ে সমাজে যেসব ভুল ও অস্পষ্ট ধারণা আছে সেগুলো কাটানোর জন্য ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে ট্রান্সদের নিয়ে কাজ করে এমন ব্যক্তিদের মতামতের উপর ভিত্তিতে কন্টেইন্ট তৈরি করা হয়েছে।
অন্যদিকে পাঠ্যবইয়ে ধর্মশিক্ষা নিয়ে বিতর্কের বিষয়ে উপমন্ত্রী বলেন, এটা আফগানিস্তান না, এটা বাংলাদেশ। এখানে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিষয়ই পড়ানো হবে। আমরা মনে করছি না, ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিছু এখানে আছে। কিছু কিছু গোষ্ঠী পাঠ্যবইয়ে সাম্প্রদায়িকতা, অসাম্প্রদায়িকতার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে। আবার অনেকেই ধর্মশিক্ষাকে গুরুত্ব কম দেওয়া হবে এমন অপপ্রচার চালাচ্ছে। কিন্তু আমরা শুধু ধর্মশিক্ষা না, আমরা পরীক্ষার মূল্যায়নের প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনতে চাই। সেই লক্ষ্যেই শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন করা হয়েছে। কিছু কিছু বিষয়ে মার্ক দেওয়ার পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসবে। মুখস্ত প্রক্রিয়া থেকে সরে আসা হচ্ছে। ধর্মশিক্ষার ক্ষেত্রেও মুখস্থর বাইরে এসে নৈতিকতার চর্চা কতটুকু করতে পারছি সেটাতে গুরুত্ব দিচ্ছি। ২০১৭ সালের পয়লা জানুয়ারি বই উৎসবের পরপরই বিতর্কের সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে বানান ভুল, বিভ্রান্তিকর ও তথ্যবিকৃতির অভিযোগ ওঠে। এছাড়াও বাদ যায় বাংলা সাহিত্যের প্রথিতযশা অনেক সাহিত্যিকের লেখা। সেসময় গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে আসে হেফাজত ইসলাম ও আরও কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দলের দাবির প্রেক্ষিতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক থেকে ‘হিন্দুত্ববাদী’ ও ‘নাস্তিক্যবাদী’ লেখা বাদ দেওয়া হয়। হেফাজত ইসলাম ও অন্যান্য কয়েকটি ধর্মিভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের দাবি ছিল এসব লেখা বাদ দিয়ে ইসলামি ভাবধারার রচনা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এরই প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের পাঠ্যবই থেকে বাদ পড়ে জ্ঞানদাস, ভারতচন্দ্র, লালন ফকির থেকে শুরু করে হুমায়ুন আজাদের মতো বরেণ্য লেখকদের লেখা। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে সমালোচনা হলেও এই পাঠ্যবইকে স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য দেয় হেফাজতে ইসলাম। ২০১৭ সালে নতুন পাঠ্যবই আসার পর দেশের নানা জায়গায় তান্ডব চালায় হেফাজতে ইসলাম। এবারও তেমন কোন আশঙ্কা আছে কিনা জানতে চাইলে শিক্ষা উপমন্ত্রী বলেন, হেফাজতের কোন মাদরাসায় জাতীয় পাঠ্যক্রমের কোন বই পড়ানো হয় না। তাই যে পাঠ্যবই তারা পড়ায় না, সেটা নিয়ে তাদের তাণ্ডবের কোন মানে নাই। আলিয়া মাদ্রাসায় আমাদের বই পড়ানো হয়, তাই তাদের আলোচনা-সমালোচনা শুনি আমরা। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের শিক্ষককে দিয়েও পাঠ্যবই পর্যালোচনা করিয়েছি। মাদ্রাসা শিক্ষকদের সঙ্গে পাইলটিং করা হয়েছে। এখন তারা যদি গো ধরে বসে থাকে যে
তারা অনেক কন্টেন্ট পড়বে না, তা তো হতে পারে না। রাষ্ট্রের একটি দায়িত্ব আছে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, বিজ্ঞান, লিঙ্গ সমতার বিষয়টি তাদের পড়তেই হবে। বিশ্বাস-অবিশ্বাস ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু জ্ঞানার্জন করতেই হবে। তারপর জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে ব্যক্তি তার জীবন পরিচালনা করবে। এর মানে এই না যে আমরা শেখাবোই না। এর আগে ১৯৭২ সালে কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনে সংবিধানের বর্ণিত রাষ্ট্রের চার মূলনীতি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে শিক্ষার মূলনীতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পরে ১৯৭৮ সালে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাদ দিয়ে ধর্মশিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ১৯৮৮ সালে ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম করার পর ধর্ম ও নৈতিকতার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। ১৯৯৭ সালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও অসাম্প্রদায়িকতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।