যুগে যুগে কর্তৃত্ববাদী শাসকদের উন্নয়নের বয়ান
সাইমুম পারভেজ
যুগে যুগে কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী সরকারগুলোর টিকে থাকার একটি অন্যতম বয়ান হচ্ছে উন্নয়ন। দৃষ্টিগোচর উন্নয়ন সাধন, বিশেষ করে অবকাঠামো উন্নয়ন, যেমন রাস্তা, বড় সেতু, ভবন এবং বিশাল আকারের মূর্তি ইত্যাদি তৈরির মাধ্যমে তারা জনমানসে জায়গা করে নিতে চান। বর্তমান বিশ্বে “চাইনিজ মডেল” এর দোহাই দিয়ে উন্নয়নের বিনিময়ে গণতন্ত্রহীনতা বা কম গণতন্ত্রে জনগণের সন্তুষ্ট হওয়া উচিত, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নিজেদের বাক-স্বাধীনতা নিয়ে সোচ্চার হওয়া কম প্রয়োজন- এ রকম তত্ত¡ নিয়ে অনেকে হাজির হন। সা¤প্রতিক সময়ে আওয়ামী লীগ কর্তৃত্ববাদী সরকারের সমর্থক বুদ্ধিজীবিদের অনেকেই উন্নয়নের দোহাই দিয়ে নির্বাচনী জালিয়াতি ও গণতন্ত্রহীনতার কলংককে ঢেকে রাখতে চান। উন্নয়নের বয়ানকে সমানে আনতে বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি উন্নত অর্থনীতির দেশের সাথে তুলনা করেন এই সরকারের মন্ত্রীরা। এই উন্নয়নের পথযাত্রায় দেশের মানুষ নয়, বরং মূলত ধনিক শ্রেণীই লাভবান হচ্ছে। তাই ক্ষমতার আশেপাশে থাকা যেকোন গোষ্ঠীর বিনিয়োগের বিরুদ্ধে আন্দোলনকেও ‘উন্নয়ন-বিরোধী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির অভূতপূর্ব অগ্রগতি হয়েছে বলে আমরা শুনে আসছি। উন্নয়নের এই স্তুতি দেশের গÐি ছড়িয়ে দেশের বাইরেও শোনা যায়। বিশ্বব্যাংক আর আইএমএফও তাদের উন্নয়নের সফলতা দেখাতে বাংলাদেশের কথা উল্লেখ করে। মানবউন্নয়ন সূচকের নানা ধারায় বাংলাদেশ কিভাবে দ্রæতগতিতে উন্নতি করছে তা নিয়ে অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেন।সুশাসন, শক্তিশালি রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়াও বাংলাদেশ কিভাবে উন্নয়ন করছে তা অনেকের কাছে একটি ধাঁধা। তবে বাংলাদেশের এই দ্রæত উন্নতির প্রতিফলন কি সমাজের সব স্তরে রয়েছে নাকি অল্প কিছু মানুষই ধন-সম্পদের পাহাড় গড়ছেন তা একটি জরুরি প্রশ্ন। জিডিপি বা মাথাপিছু আয়ভিত্তিক উন্নয়নের পরিমাপে অতিধনীর সম্পদের বায়বীয় ভাগ পাচ্ছে অতিদরিদ্ররা। নিউইয়র্কভিত্তিক ওয়েল-এক্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান ২০১৯ সালে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। এই রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বের প্রথম ১০টি দ্রæত বর্ধনশীল অর্থনীতির মধ্যে বাংলাদেশ তৃতীয়। যে কয়েকটি দেশে সবচেয়ে বেশি নতুন ধনী, নতুন মিলিওনিয়ার তৈরি হচ্ছে তার মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষপর্যায়ের একটি দেশ। আর এই কথিত উন্নয়নের মান নিয়েও প্রশ্ন তোলা দরকার। ২০২০ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর গবেষণায় দেখা যায় করোনা মহামারিতে দারিদ্রের হার বেড়ে ৪২ শতাংশ হয়েছে। আমরা এমন সময়ে উন্নয়নের উদযাপন করছি যখন আগুনে পড়ে মানুষ মারা যাচ্ছে, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে, বিদ্যুৎ খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচের পরেও বিদ্যুৎবিহীন জীবন কাটাতে হচ্ছে। আর এর মধ্যেই চলছে দুর্নীতি আর লুটের মচ্ছব। মৃত্যু যখন কড়া নাড়ছে অনিশ্চিত জীবনের দরজায়, তখনও লোভ আমাদের পিছু ছাড়ে না। এমনকি করোনা মহামারি আসার আগেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সাথে সাথে ধনী-গরিব বৈষম্যও বেড়েছে। গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০১৭-১৮: প্রথম অন্তর্বতীকালীন পর্যালোচনা’ অনুযায়ী বাংলাদেশে ধনীরা আরও ধনী আর গরিবরা আরো গরিব হচ্ছেন। সবচেয়ে দরিদ্র পাঁচ শতাংশের খানা প্রতি আয় (হাউজহোল্ড ইনকাম) ২০০৫ সালে ছিল ১১০৯ টাকা। ২০১৬ সালে তা কমে ৭৩৩ টাকা হয়। আর ধনী পাঁচ শতাংশের ২০০৫ সালে খানা প্রতি আয় ছিল ৩৮ হাজার ৭৯৫ টাকা। এই আয় ২০১৬ সালে দ্বিগুণের বেশি বেড়ে দাঁড়ায় ৮৮ হাজার ৯৪১ টাকায়। তাই যে ব্যবস্থার মধ্যে বাংলাদেশের মানুষ বসবাস করছে, তা যেন একচক্ষু বিশিষ্ট। এই একচোখে কেবল ধনিক শ্রেণীর সুবিধা দেখে আর উপরে উঠার সিঁড়ি তৈরি করে দেয়। খেটে খাওয়া মানুষের জীবনযাপনে নাভিশ্বাস উঠে, আর প্রতিবাদ করলেই ধেয়ে আসে জুলুম।উন্নয়নের এই বয়ান এতই শক্তিশালী যে, নতুন অবকাঠামোকে অনেক সময় তীর্থস্থানের মত মর্যাদা দেয়া হচ্ছে। দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে না দেখে অবকাঠামোর সাথে জাতীয়তাবাদী আবেগকে যুক্ত করে উন্নয়নের বয়ানকে পূর্ণতা দেওয়া হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে মেট্রোরেল, কর্ণফুলি টানেলের মত নতুন নতুন মেগাপ্রোজেক্ট এর উদ্বোধন এই বয়ানকে আরো শক্তিশালী রূপ দিতে পারে।
বেলজিয়ামের ফ্রাই ইউনিভার্সিটি ব্রাসেলস-এর রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগের পোস্ট-ডক্টরাল গবেষক।