ওষুধের মূল রাসায়নিক উপাদান পাওয়া যেতে পারে পাটগাছ পাতা থেকে
মতিনুজ্জামান মিটু: বর্ষজীবী উদ্ভিদ পাট প্রধানত আঁশ উৎপাদন ও পাতা খাদ্য হিসেবে চাষ করা হলেও এর ঔষধিগুণের কথা অনেকেরই অজানা। বাংলাদেশ, ভারত ও চীনসহ বিশ্বের অনেক জায়গায় পাট উৎপাদিত হয়। পাট পাতার ব্যবহার ও ঔষধিগুণ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের কারিগরি শাখার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জাকারিয়া আহমেদ এবং ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সুরঞ্জন সরকার জানান, পাট প্রধানত আঁশ উৎপাদনে চাষ করা হয়, যার কচি সুস্বাদু ও রসালো পাতা সবজি হিসেবেও খাদ্যে ব্যবহৃত হয়। তাই পাট আঁশ ও রান্না উভয়ই উদ্দেশ্যেই কাজে লাগে। পাটজাতীয় উদ্ভিদগুলো খাদ্য এবং ঔষধ হিসেবেও সমানভাবে কার্যকর। এছাড়া গাছগুলো নিরাপদ, মাদকমুক্ত ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন। সাশ্রয়ী মূল্যের কারণে সাধারণত উন্নত এবং উন্নয়নশীল উভয় দেশেই এসব ঔষধি গাছের প্রতিনিয়ত চাহিদা বাড়ছে। প্রসাধনী, সুগন্ধি ও রংয়ে ঔষধি উদ্ভিদের নির্যাস বিশেষ ভূমিকা আছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। বিশ্বে পাট পাতার ব্যবহার সম্পর্কে বিজ্ঞানলব্ধ গবেষণার বিেওত এবৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদ্বয় জানান, শুষ্কপাটের পাতা চায়ের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়। ফিলিপাইনে সাধারণত বাঁশের অঙ্কুর ও অলিটোরিয়াসের জাতের পাটের পাতা একসঙ্গে মিশিয়ে শাক হিসেবে খাওয়া হয়। অন্যদিকে উত্তর আফ্রিকায় ও মধ্যপ্রাচ্যে মালুখিয়া নামে পরিচিত কচি পাটপাতা সবুজ শাক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া পাটপাতা লেবানন, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, জর্ডান এবং তিউনিসিয়ার রান্নাতেও ব্যবহৃত হয়। তুরস্ক এবং সাইপ্রাসে, পাটপাতা মোলোখিয়া নামে পরিচিত। যা মোলোচা হিসাবে এক ধরনের মুরগির স্টু রান্নাতে ব্যবহৃত হয়। ফারাওদের সময় থেকে পাটপাতা একটি প্রধান মিসরীয় খাবার। জাপানে পাটের শুকনো পাতা কফি এবং চায়ের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ইউরোপে স্যুপ তৈরিতে পাটের পাতা ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
পাটের পুষ্টিমান বিষয়ে এবিজ্ঞানীরা জানান, প্রায় সারা বছরই এদেশে পাটশাক পাওয়া যায়। পাটের পাতা শুধু শাক হিসেবেই নয় বরং পাটের পাতায় রয়েছে আয়রন, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সেলেনিয়াম, ফসফরাস, ভিটামিন ই, কে, সি, বি-৬ ও নিয়াসিনসহ প্রচুর পরিমাণ পুষ্টিগুণ। প্রতি ১০০ গ্রাম পাটপাতায় ক্যালরির পরিমাণ ৭৩ কিলোজুল, আমিষ ৩.৬ গ্রাম , লোহা ১১ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ২৯৮ মিলিগ্রাম ও ক্যারোটিন ৬৪০০ (আইইউ)। আরও রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও খাদ্যআঁশ।
পাট একটি সুপরিচিত বাস্ট ফাইবার উদ্ভিদ কিন্তু বৈজ্ঞানিক তথ্য অপ্রতুলতার জন্য ঔষধ হিসেবে খুবই কম পরিচিত। গাছের প্রতিটি অংশই ঔষধ হিসেবে কার্যকর। আয়ুর্বেদী শাস্ত্র মতে এই গাছের ভেষজ গুণকে অসাধারণ মূল্য দেওয়া হয়। পাটগাছ বিশেষ করে পাতা ও বীজ নৃতাত্তি¡ক ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পাটপাতা রেচক বা কোষ্টকাঠিন্য, মাথাব্যথা, চিকেনপক্স বা গুটিবসন্ত ও ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং গুঁড়াকৃমির চিকিৎসাসহ শারীরিক অসুস্থতায় পাটগাছের বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করা হয়। পাটপাতার জলীয় বা অ্যালকোহলিক নির্যাস, যার মধ্যে পলিস্যাকারাইড ও অলিগোস্যাকারাইড জৈব পদার্থগুলো সমৃদ্ধ থাকে, মানব ত্বকের জন্য প্রসাধনী বা চুলের ময়েশ্চারাইজার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
অন্ত্রের রোগ নিরাময়ে পাটশাক, খাওয়ার রুচি বাড়িয়ে মুখের স্বাদ ফিরিয়ে আনে ও মেদ বৃদ্ধির আশঙ্কা কমায়। এর তেতো স্বাদ মুখের লালাক্ষরণ বাড়িয়ে কার্বোহাইড্রেডকে ভাঙতে সাহায্যের মাধ্যমে হজমে সহায়তা করে। পাটপাতাতে ঔষধি গুণাগুণ থাকার কারণে এটি তিক্ত টনিক হিসেবে পাকস্থলী প্রশমক, কোষ্টকাঠিন্য দূরীকারক, পাকস্থলীয় বায়ুনাশক বা রক্তনালির সংকোচক রোধক এবং অন্ত্রের অ্যান্টিসেপটিক ঔষধ হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। প্রাচীন ভারতবর্ষীয়রা পাটগাছকে ছাই করে, মধুর সঙ্গে মিশিয়ে অন্ত্র পরিষ্কার করার জন্য ব্যবহার করে। পাতার গুঁড়া, ৫ থেকে ১০টি বীজদানা, গুঁড়া হলুদের সঙ্গে সমান অংশে মিশিয়ে, আমাশা নিরাময়ের জন্য ব্যবহৃত হয়। দেখা গেছে, এক গ্রাম পাটপাতা শুকনা আধকাপ পানিতে ভিজিয়ে কিছুক্ষণ পরে পাটপাতার পানি ছেঁকে খেলে আমাশয় রোগ ভালো হয়। তাছাড়া দেড় গ্রাম পরিমাণ পাট পাতার গুঁড়া ভাতের সঙ্গে খেলে বারবার টয়লেটে যাওয়ার প্রবণতা অনেকখানি কমে যায়। এছাড়াও এক গ্রাম পাতা গুঁড়া এবং এক গ্রাম হলুদ গুঁড়া একসঙ্গে মিশিয়ে ঠান্ডা পানির সঙ্গে দিনে দু’বার করে খেলে রক্ত আমাশয় ভাল হয়। গবেষণায় প্রমাণি হয়, দেড় থেকে দুইগ্রাম পাটের বীজের গুঁড়া, এক চামচ মধু ও সিকি চামচ আদার রস একসঙ্গে মিশিয়ে সামান্য ঠান্ডা পানির সঙ্গে তিন ঘণ্টা পর পর খেলে পেট খারাপ ভাল হয়; শুকনো গুঁড়া পাটের পাতা দুই গ্রাম ও এক গøাস কুসুম কুসুম গরম পানির সঙ্গে সকালে বাসিপেটে খেলে কোষ্ঠ পরিষ্কার হয়। ৫০ মিলিলিটার গরম পানিতে দুই গ্রাম পাট পাতা সারারাত ভিজিয়ে রেখে সকালে ছেঁকে নিয়ে খালিপেটে খেলে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই লিভারের দোষ ভালো হয়। অন্য এক গবেষণামতে, ২০ থেকে ২৫ মিলিলিটার টাটকা কচি পাতার রস আধকাপ পানিতে মিশিয়ে সামান্য গরম করে একবার সকালে ও আর একবার বিকেলে খেলে অগ্নিমন্দা ভাল হয়।
গবেষকরা লাইকোপিন নামক একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট পাট শাকে পেয়েছেন, যা খেলে শরীরে সৃষ্ট প্রদাহ কমে এবং অক্সিডেটিভ ক্ষতি থেকে শরীরের কোষগুলোকে রক্ষা করে বা শারীরি প্রদাহ কমায়। একটি ঢাকনাযুক্ত পাত্রে ত্রিশ থেকে চল্লিশ গ্রাম কচি পাটপাতা কুচি কুচি করে কেটে ১৭০ মিলিলিটার পানি দিয়ে সিদ্ধ করে, ৪০ থেকে ৫০ মিলিলিটার পরিমাণ হলে নামিয়ে ঠান্ডা করতে হবে। ঠান্ডা ঘন সুপটি ছেঁকে সবটুকুই রোগীকে একসঙ্গে খাইয়ে দিতে হবে। দিনে দুইবার করে তিন দিন খেলেই জ্বর কমে যাবে। অলিটোরিয়াস জাতীয় পাটপাতা থেকে ছয়টি ফেনোলিক অ্যান্টিঅক্সিডেটিভ জৈবযৌগ পাওয়া গিয়েছে।
গবেষণায় দেখায় যায়, ৫-ক্যাফেওয়েলকুইনিক অ্যাসিড একটি অন্যতম প্রধান ফেনোলিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। ২০ গ্রাম অলিটোরিয়াস জাতীয় পাটপাতা বাতাসে শুকিয়ে পানিতে ১:২০ অনুপাতে সাধারণ তাপমাত্রায় তিন দিন ভিজিয়ে রাখার পর নির্যাসটি সুপারঅক্সাইড অ্যানায়ণ র্যাডিকাল স্ক্যাভেঞ্জিং-এর বিরুদ্ধে প্রায় ৯০শতাংশ প্রতিরোধে গড়ে। তাই পাটশাক মানবদেহে সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা বাড়ায় এবং রোগ প্রতিরোধ করে। পাটশাকে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন, সোডিয়াম ও অন্যান্য উপাদান পর্যাপ্ত পরিমাণে গবেষণায় পাওয়া গেছে এবং এই ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম হাড় সুগঠিত করে এবং হাড়ের ক্ষয় রোধ করতে সাহায্য করে, আয়রন ও সোডিয়াম হাড় গঠন ও ক্ষয়পূরণ করে।
বেশি করে গাছের পাতা ও ফল খেলে বিশেষত গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল এলাকায় ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে। জাপানের গবেষকেরা পাটের পাতা থেকে দুটি অ্যান্টিটিউমার বর্ধিতকরণ যৌগ শনাক্ত করেছেন, যা হলো ফাইটোল এবং মনো-গ্যালাক্টোসিলডিয়াসিলগিøসারল। গবেষণালব্ধ প্রমাণ থেকে পাওয়া যায়, গরম জলে সিদ্ধ পাট পাতার জুস অ্যান্টিটিউমার বর্ধিতকারী উপাদানের সক্রিয়তা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাড়ায় এবং গরম জলে সিদ্ধ পাট পাতার জুস টিউমার বর্ধিতকারী রাসায়নিকের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে কার্যকর। অনেক গবেষক এআরএইচ-৭৭ কোষে অলিটোরিয়াস জাতের পাটপাতার ও বীজের নির্যাসের দেহের অভ্যন্তরীণ সাইটোটক্সিক প্রভাব পর্যবেক্ষণ করেছেন, যেখানে দেখা যায় পাতার নির্যাসে উচ্চ মাত্রার সমুদয় ফেনল উপাদান এবং ফ্রি-রেডিক্যাল স্ক্যাভেঞ্জিং প্রক্রিয়ার (এফআরএসএ) সঙ্গে সম্পর্কিত।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ পাটশাকে উচ্চ মাত্রায় পটাশিয়াম লবণ থাকায় রক্তসঞ্চালন ও রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করে। এর জন্য উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা দূর হয়। তাছাড়া পাট বীজ থেকে কর্চোরি, কর্কোরজেনিন, ক্যাপসুলারিন, কর্কোরিটিন, অলিটোরিসাইড, কর্কোসুলারিন এবং কর্কোটক্সিন নামক বেশ কিছু জৈবযৌগ পাওয়া যায়। আহরিত এই জৈবযৌগ কার্ডিওটোনিক ওষুধ হিসাবে কাজ করে। এটি সোডিয়াম-পটাশিয়াম এটিপিসকে বাধা দিয়ে কার্ডিয়াক পেশির সংকোচন শক্তির ওপর কাজ করে। পাটশাক রক্তের কোলেস্টেরল কমাতে সহায়তা করে থাকে এবং নিয়মিত পাটশাক খেলে হার্টঅ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে।
অ্যান্টি মাইক্রোবিয়াল কার্যকারিতা পেট্রোলিয়াম ইথার দিয়ে প্রক্রিয়াজাত পাটশাকের নির্যাস, বিভিন্ন ধরণের ব্যাকটেরিয়া যেমন- ই. কোলি স্ট্যাফিলোকক্কাস অরিয়াস এবং ইয়ারসিনিয়া এন্টারোকোলিটিকা প্রভৃতি’র বিরুদ্ধে কাজ করে। ইথাইল অ্যাসিটেট এবং পানি দিয়ে প্রক্রিয়াজাত পাটশাকের নির্যাস ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া যেমন- জিওট্রিকাম কনডিডাম এবং বোট্রিটিস সিনেরিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করে। পাটশাকের মিথানোলিক নির্যাস পাতার ব্যাকটেরিয়ারোধী ও ছত্রাকরোধী হিসেবে কাজ করে।
এবিজ্ঞানীরা জানান, নতুন ওষুধ তৈরির জন্য ওষুধের মূল রাসায়নিক উপাদান পাটগাছ ও পাটগাছের পাতা থেকে পাওয়া যেতে পারে। পাটের রাসায়নিক উপাদান উৎপত্তি স্থান ও গাছের বিভিন্ন অংশের ওপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়। পাটের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যযুক্ত শুদ্ধ অনেক রাসায়নিক যৌগ এখনও বিশদভাবে অধ্যয়ন করা হয়নি। এখন পর্যন্ত জীবন্ত কোষের মধ্যে সংঘটিত প্রক্রিয়ার অধীনে পৃথক পৃথক যৌগগুলোর ক্রিয়া করার প্রক্রিয়া সম্পর্কিত ফার্মাকোকিনেটিক্স গবেষণা সীমিত আকারে প্রচেষ্টা করা হয়েছে। পাটশাকের বিষাক্ততা ও নিরাপত্তার বিষয়গুলোর ওপর গবেষণার জন্য জোর দেওয়া উচিত।