সুনামগঞ্জে শতাধিক জলমহাল নষ্ট হচ্ছে উন্নয়ন প্রকল্পের নামে অনিয়মের অভিযোগ
দীপক চৌধুরী : সুনামগঞ্জে ২০ একরের উর্ধ্বে থাকা জলমহালগুলোর মধ্যে বিপুলসংখ্যক জলমহাল উন্নয়ন স্কিমে দেওয়ায় হিতে বিপরীত হয়েছে। এসব জলমহাল এখন খাঁ খাঁ করছে। প্রশাসনের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে তৃণমূলের জেলে সম্প্রদায়ের মানুষ বিপদে পড়েছে।
সুনামগঞ্জের হাওর-বাওর আর নদী মাছে ভরা ছিল অতীতে। আর এখন জেলেরা অসহায়। তারা সরকারের তরফ থেকে চাল-ডাল বা কোনো অর্থসাহায্য পাচ্ছে না। অন্যদিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে জলমহালগুলো উন্নয়ন স্কিমে দেওয়ায় জেলার বাইরের গডফাদারদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে হাওর-বাওর-নদী। তৃণমূলের জেলেরা হচ্ছে বঞ্চিত।
সূত্র জানায়, সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক ১৪৩০ বঙ্গাব্দ থকে ১৪৩৫ বঙ্গাব্দ মেয়াদে উন্নয়ন প্রকল্পে ইজারা গ্রহণের আবেদন আহŸান করেছেন। এমন সিদ্ধান্তের কারণে অসহায় এসব জেলেদের জীবনে নেমে এসেছে অন্ধকার। নিবন্ধিত প্রকৃত মৎস্যজীবীদের ঘরে এখন কান্না। তবে জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, তদন্ত করে দেখার সুযোগ রয়েছে। দীর্ঘদিন যাবৎ জেলা থেকে সাধারণ আবেদনে তিন বছরের জন্য ইজারা দেওয়া জলমহালগুলো কেন উন্নয়ন স্কিমে দেওয়া হচ্ছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এর কোনো উত্তর দেননি। সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রায় ৪৬টি জলমহাল সম্পূর্ণ ধ্বংসের পথে। এসব জলমহাল এক সময় দেশি মাছে ভরপুর থাকতো। এখন দেশীয় মিঠা পানির মাছ দূরের কথা চাষের মাছও মিলছে না। উন্নয়ন হয়নি, দুর্নীতি আর অনিয়ম হয়েছে। বড়বড় হাওরে কীভাবে উন্নয়ন প্রকল্প হয় এ প্রশ্ন এলাকার জেলেদের।
গডফাদাররা দুতিন বছর ব্যবসা করে মুনাফা লুটে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এসব জলমহালে এখন দেশি মাছ নেই। জলমহালের তীরঁেঘষে বসবাসকারী বাসিন্দারা এখন দৈনন্দিন জীবনে জীবিকা নির্বাহ করতে পারছেন না।
এমন কিছু নদী শ্রেণির জলমহাল রয়েছে যা কখনো উন্নয়ন প্রকল্পে আসতে পারে না। কারণ এসব জলমহাল বহতা নদী। সরেজমিনে দেখা গেছে, সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর সংযোগকারী কালনি নদী একটি ¯্রােতস্বিনী অংশ । শুস্ক মৌসুমেও এ নদীর সর্বত্র প্রায় ১০০ থেকে ১২০ ফুট পানি থাকে। বাস্তবে এটি সংস্কারের কোনো প্রয়োজন নেই, সুযোগ নেই এবং সরকারী জলমহাল নীতি-২০০৯ এর সম্পূর্ণ পরিপন্থী। কিন্তু এগুলো উন্নয়ন স্কিমে দেওয়ার জন্য ঘোষণা করা হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, শেখ রফিকুল আলম ও আব্দুল আহাদ সুনামগঞ্জে জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন অতীতে। সেই সময়েও এসব জলমহাল উন্নয়ন স্কিমে দেওয়া হয়নি। কারণ তারা সরেজমিনে এলাকার জেলেসহ সকল শ্রেণির মানুষের কথা বলেছেন ও শুনেছেন। কিন্তু বিএনপি-জামায়াতের আশীর্বাদপুষ্ট গডফাদারেরা তখনো এসব জলমহাল উন্নয়ন স্কিমে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলাস্থ ‘শয়তান খালী নদী ৫ম খÐ’ জলমহালটি কখনো উন্নয়ন স্কিমে ছিল না। কারণ বিভিন্ন সময়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও মন্ত্রণালয়ের সরেজমিনে তদন্তের পর প্রতীয়মান হয়েছে এটি উন্নয়ন স্কিমে দেওয়া যায় না। সর্বশেষ জলমহালটি উন্নয়ন স্কিমে নাকি সাধারণ আবেদনে জেলা থেকে ইজারা দেওয়া দরকার তা নির্ধারণ করার জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব ( সায়রাত) মো. দেলোয়ার হোসেনকে আহŸায়ক করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (সায়রাত) মো. দেলোয়ার হোসেন, শোয়াইব আহমদ খান, উপসচিব ( খাসজমি-২) ও মো. রাশেদুল ইসলাম, উপসচিব (সায়রাত-১) উক্ত জলমহাল সরজমিনে তদন্ত করেন।
তারা সরেজমিনে দেখে ও স্থানীয়দের সাক্ষ্য নেওয়ার পর বুঝতে পারেন ৯০ ফুট থেকে ১২০ ফুট গভীর এই জলমহালটি উন্নয়ন স্কিমে দেওয়ার প্রয়োজনই নেই। শুধু তাই নয়, অবিশ^াস্য হলেও সত্য শয়তানখালী চতুর্থ খÐ নদীও উন্নয়ন স্কিমে দেওয়া হয়েছে। অথচ ছয় বছরে ছয় টুকরি মাটিও ফেলা হয়নি।
এরকম অর্ধশত জলমহাল রয়েছে যা উন্নয়ন স্কিমে দেওয়া হয়েছে । অথচ সরকারের জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতি ২-এর সম্পূর্ণ পরিপিন্থী। দিরাই এলাকার বাসিন্দা তরুণ যুবক রুসেন মিয়া জানান, সাধারণ আবেদনে যে ন্যায়বিচারটি হয়ে থাকে উন্নয়ন স্কিমে সেটি হয় না। সুষম বণ্টন হয় না। উন্নয়ন প্রকল্পে এনে কেউ সংশ্লিষ্ট জলমহালের স্বার্থে এক টাকারও মাটি কাটে না। গাছ লাগানো হয় না। গভীর নদী উন্নয়ন স্কিমে দেওয়া হয় কীভাবে তা বোধগম্য নয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের অপরিকল্পিত কারণেও মিঠাপানির মাছ হারিয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, প্রশাসনের কোনো নজর নেই এদিকে। দেখভাল করা হয় না। শয়তানখালি নদী চতুর্থ খন্ড জলমহালটি কীভাবে উন্নয়ন স্কিমে দেওয়া হয়েছে? এটা তো একটি শতফুট গভীর নদী ফাল্গুন মাসেও। এই নদীর বুকে শতশত নৌকাচলে সুতরাং এখানে অভয়াশ্রম হয় না।
স্থানীয় জেলে রনজিৎ বিশ^াস বলেন, দেশীয় মিঠা পানির মাছ এ দেশ থেকে উধাও হচ্ছে প্রশাসনের ভুল সিদ্ধান্তে। যে জলমহালটি সাধারণ আবেদনে দিলে জেলেরা উপকৃত হবে সেটি অন্যায়ভাবে উন্নয়ন স্কিমে গডফাদারদের স্বার্থে দেওয়া হয়ে থাকে।
এলাকার জেলেদের কষ্টের কথা জানিয়ে স্থানীয় জেলে ভাটিধলের মৎস্যজীবী পুরঞ্জন পাল বলেন, উন্নয়ন স্কিমে যেসব শর্ত দেওয়া হয় এসবের একটিও মানা হয় না। নদী শ্রেণির জলমহাল উন্নয়ন স্কিমে দেওয়া হচ্ছে অন্যায়ভাবে।
জেলে আতাবুর মিয়া জানান, উত্তরবঙ্গ বা দক্ষিণ বঙ্গের সঙ্গে আমাদের মিলিয়ে ফেললে হবে না। কারণ আমাদের সুনামগঞ্জ জেলাটি হাওর অঞ্চল। এর নদী-নালা-খাল-বিল গভীর।
তৃণমূলের বাসিন্দা জেলে গৌরাঙ্গ পাল বলেন, সুনামগঞ্জে অর্থাৎ এ অঞ্চলে কিছু কিছু জলমহাল রয়েছে যেগুলো উন্নয়ন স্কিমে বেশি রাজস্ব দিয়ে নিয়ে একশ্রেণির ধান্দাবাজেরা কয়েক বছর চালিয়ে থাকে। কিন্তু কেউই খনন করে না। এরপর খাজনার টাকা বেশি হয়ে যায় ফলে জেলেরা ইজারা নেয় না, কেউই ইজারা নেয় না।
স্থানীয় আরেক জেলে নিতাই পাল জানান, নদীকে বিল উল্লেখ করে উন্নয়ন স্কিমে নেওয়া হয়। প্রশাসন সরেজমিনে না দেখে বেআইনিকাজে গডফাদারদের সতায়তা করে থাকে। এ বিষয়ে ভূমিমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। সম্পাদনা: সালেহ্ বিপ্লব